মাতা-পিতা অমুসলমান হলেও তাঁদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে
মাতা-পিতার সাথে সকল অবস্থায় ভাল ব্যবহার করা সন্তানের কর্তব্য। এমনকি, পিতা-মাতা অমুসলমান হলেও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে । এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ। অতএব তা মানা ওয়াজিব।
এরশাদ হয়েছে :
وَإِنْ جَاهَدَكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَاوَصَاحِبُهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيْلَ مَنْ آنَابَ إِلَيَّ ، ثُمَّ إِلَىمَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَه لقمن : ١٥
“তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার (আল্লাহর) সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদভাবে বসবাস করবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে, তার পথ অবলম্বন করো, অতপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদের অবহিত করবো।”-সূরা লুকমান : ১৫
উপরোক্ত আয়াত নাযিলের শানেনুযূল সম্পর্কে সাহাবী সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন : আমার সম্পর্কেই এ আয়াত নাযিল হয়। আমি আমার মায়ের সাথে ভাল ব্যবহার করতাম। আমি ইসলাম গ্রহণের পর আমার মা বললেন, হে সা’দ ! তুমি নতুন জিনিস (দীন) বের করেছো । তোমাকে এটা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে, তা না হলে আমি আমরণ পানাহার পরিত্যাগ করবো। তখন আমার জন্য তোমাকে ধিক্কার দেয়া হবে মাতৃহস্তা বলে। আমি বললাম, মা এমন করবেন না। আমি কোনো অবস্থায়ই আমার এ দীন পরিত্যাগ করবো না।
একথা শুনে তিনি এক দিন ও এক রাত না খেয়ে থাকলেন এবং আমাকে ফিরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি আরো এক দিন এক রাত এরূপ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। আমি তা দেখে বললাম, মা জেনে রাখুন, আপনার যদি একশোটি প্রাণ থাকতো এবং একটি একটি করে তা আপনার দেহ থেকে বের হতো তবু আমি কোনোক্রমেই আমার এ দীন পরিত্যাগ করতাম না। আপনার ইচ্ছা হলে খান, না হলে না খান। আমার কথা শুনে তিনি অবশেষে খাবার খেলেন। এর প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাযিল হয় ।
সহীহ মুসলিম শরীফে ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে : عَنْ طَرِيقِ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ حَلَفَتْ أُمُّ سَعْدٍ لَا تُكَلِّمُهُ أَبَدًا حَتَّى يَكْفُرَ بِدِينِهِ، قَالَتْ زَعَمْتَ أَنَّ اللهَ أَوْصَاكَ بِوَالِدَيْكَ فَأَنَا أُمُّكَ وَأَنَا أمُرُكَ بِهذَا فَنَزَلَتْ وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ –
“মুসআব বিন সা’দ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন ঃ সাদের মা হলফ করে বলেন, তিনি তাঁর দীন পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তাঁর সাথে কখনো কথা বলবেন না। তিনি (সা’দের মা) বললেন, তুমি জান আল্লাহ তোমার মাতা-পিতার সাথে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন, আর আমি তোমার মা, আমি তোমাকে এ দীন ত্যাগ করার হুকুম করি ৷ তখন এ আয়াত নাযিল হয়—“আমি (আল্লাহ) মানুষদের মাতাপিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।”-মুসলিম শরীফ
অন্য একটি হাদীস : عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرِ الصَّدِّيقِ قَالَتْ قَدِمَتْ عَلَى أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةً فِي عَهْدِ رَسُولِ اللهِ ﷺ فَاسْتَفْتُ رَسُولَ اللهِ قُلْتُ إِنَّ أُمِّي قَدِمَتْ وَهِيَ رَاغِبَةً أَفَأَصِلُ أُمِّنْ قَالَ نَعَمْ ، صَلِى أُمَّكِ ، قَالَ إِبْنُ عُيَيْنَةَ كَمَا فِي رِوَايَةٍ الْبُخَارِي فَأَنْزَلَ اللهُ فِيهَا : لَا يَنْكُمُ اللَّهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مَنْ دِيَارِكُمْ أَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ، إِنَّ الله يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ )
“হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর কন্যা হযরত আসমা রা. বললেন : আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় মুশরিক অবস্থায় আমার মা আমার কাছে আসেন। রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট এ ব্যাপারে ফতওয়া চেয়ে আরজ করলাম, আমার মা আমার নিকট এসেছেন। তিনি আমার ভাল ব্যবহার পেতে আগ্রহী। আমি কি তার সাথে ভাল ব্যবহার করবো ? রাসূলুল্লাহ স. বললেন, হ্যাঁ তোমার মায়ের সাথে তুমি ভাল ব্যবহার কর ।”-বুখারী মুসলিম, আবু দাউদ,
বায়হাকী ইবনে উ’য়াইনা বলেন, এর প্রেক্ষিতেই নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় :
لا يَنْهُكُمُ اللهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مَن دِيَارِكُمْ أَنْ تَبْرُوهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ، إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ )
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।”-সূরা মুমতাহিনা : ৮
উপরোক্ত হাদীসসমূহ থেকে সুস্পষ্ট হলো যে, পিতা-মাতার খেদমত করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য। এমন কি, পিতা-মাতা যদি বিধর্মীও হয় তবু যথারীতি তাদের খেদমত করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত এই যে, দীনের ব্যাপারে দীনের বিপরীত কোনো কথা বললে তা শোনা যাবে না, অথবা দীনের বিরুদ্ধে পিতা-মাতা জিহাদে অংশগ্রহণ করলে তখন তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে অথবা দীনের কারণে পিতা-মাতা যদি সন্তানকে হিজরত করতে বাধ্য করে তখন সন্তান তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে বাধ্য নয়। এগুলো হলো চরম বা ব্যতিক্রমী অবস্থা। অন্যথায় স্বাভাবিক অবস্থায় পিতা-মাতার অনুগত থাকা, তাঁদের খেদমত করা, তাঁদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য1
তথ্য সূত্রঃ
বই : মাতা-পিতা ও সন্তানের হক
অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রহমান