মৃত্যু কামনা করা জায়েয নেই
মানুষ বিভিন্ন কারণে অধৈর্য হয়ে যায়। অধৈর্য হয়ে মানুষ নিজেদের মৃত্যু কামনা করে থাকে। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে ধৈর্য ধারণ সম্পর্কে অনেক আয়াত নাজিল করেছেন। অনেক সময় মানুষ নানা কারণে ধৈর্য হারিয়ে আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করে থাকে; যা কোনো ভাবে কাম্য নয়।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক হাদিসে মৃত্যু কামনা করাকে অবৈধ বলেছেন। মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ করেছেন। আর মৃত্যু কামনা নিষেধ করার মূল করণও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। আর তাহলো-
মুহাম্মাদ ইবনে রাফি (রাহঃ) ……… হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি এই মর্মে, আবু হুরায়রা (রাযিঃ) নবী (ﷺ) থেকে আমাদের কাছে যা বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে এবং তা আসার পূর্বে যেন তার জন্য দুআ না করে। কেননা তোমাদের কেউ মারা গেলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। আর মুমিন ব্যক্তির বয়স দীর্ঘায়িত হলে এতে তার কল্যাণই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে কোনও কষ্টের কারণে মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কোন রকম কষ্ট তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। কষ্ট দুনিয়াবী হতে পারে এবং পরকালীনও হতে পারে। দুনিয়াবী কষ্ট বিভিন্ন রকমের। অসুখ-বিসুখের কষ্ট, খাদ্যকষ্ট, মানসিক কষ্ট ইত্যাদি। পরকালীন কষ্ট বলতে এমন কোনও ফিতনাকে বোঝায়, যে কারণে নিজের দীন ও ঈমান রক্ষা কঠিন হয়ে যায়। এখানে মূলত দুনিয়াবী কষ্টের কথা বোঝানো হয়েছে। দুনিয়াবী কষ্টের কারণে মৃত্যু কামনা করা জায়েয নয়। কেননা আগের হাদীছসমূহ দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি দুনিয়াবী কষ্টের ভেতর কল্যাণ নিহিত থাকে। দুনিয়ার জীবনটাই তো পরীক্ষার জীবন।
এখানে মানুষকে যেমন সুখ-সাচ্ছন্দ্য দ্বারা পরীক্ষা করা হয়, তেমনি পরীক্ষা করা হয় কষ্ট-ক্লেশ দ্বারাও। দেখা হয় সুখ-সাচ্ছন্দ্যে সে কেমন শোকর আদায় করে আর কষ্ট-ক্লেশে কতটুকু ধৈর্য ধরে। শোকর দ্বারা যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়, তেমনি তা লাভ হয় সবর দ্বারাও। কষ্ট-ক্লেশে সবর করলে গুনাহ মাফ হয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এটা তো আখিরাতের অতিবড় লাভ। মৃত্যুকামনা দ্বারা সেই লাভ পরিত্যাগ করা কোনও বুদ্ধির কথা নয়। মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহর পথের যাত্রী। প্রতি কদমে সে আল্লাহর নৈকট্যের দিকে অগ্রসর হয়। প্রতিটি নেককাজ দ্বারা তার নৈকট্য বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর নৈকট্য লাভই তার পরম লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য মৃত্যু দ্বারা ব্যহত হয়। যা পরম লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে, আল্লাহর পথের পথিক তা কিভাবে চাইতে পারে? কষ্টের কারণে? কোনও কষ্টই স্থায়ী নয়। যেই কষ্টে পড়ে মৃত্যু কামনা করা হয়, আল্লাহ চাহেন তো একদিন তা ঘুচে যাবেই।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ-{فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا (5) إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا (6)} [الشرح: 5، 6]“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তিও থাকে।”অন্যত্র ইরশাদ-‘আল্লাহ সংকটের পর স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করে দেবেন।”{سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْرًا (7)} [الطلاق: 7]যখন দুঃখ-কষ্ট কেটে যাবে, সেই সুখের দিনে কত ইবাদত-বন্দেগী করা সম্ভব! দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। স্বস্তির সংগে বেঁচে থাকলে এখানে আখিরাতের কত ফসল বোনা যায়। সম্ভব হয় কত পুণ্যসঞ্চয় করা। আর মৃত্যুকামনা দ্বারা আখিরাতের সঞ্চয় লাভের সুযোগ উপেক্ষা করা হয়। এটা কোনও প্রশংসনীয় কাজ নয়; বরং একদিক থেকে এটা আখিরাতের কল্যাণলাভের প্রতি অনাগ্রহেরও ইঙ্গিত বহন করে। তাই হাদীছে মৃত্যুকামনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া এর দ্বারা বিপদ-আপদে অধৈর্য এবং আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্টিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যা সম্পূর্ণ নাজায়েয। অধিকন্তু জীবন একটা নি’আমত। নি’আমত বিলুপ্তির আকাঙ্ক্ষা করা নিন্দনীয়। এক হাদীছে ইরশাদ-«لا يتمنى أحدكم الموت، ولا يدع به من قبل أن يأتيه، إنه إذا مات أحدكم انقطع عمله، وإنه لا يزيد المؤمن عمره إلا خيرا»‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু আসার আগে তার আকাঙ্ক্ষা না করে এবং তার জন্য দু’আ না করে। কেননা মৃত্যু হলে আমল বন্ধ হয়ে যায়। আর মু’মিনের আয়ু তার কেবল কল্যাণই বৃদ্ধি করে।অপর এক হাদীছে আছে-لا يتمنى أحدكم الموت إما محسنا فلعله يزداد، و إما مسيئا قلعله يستعيب‘তোমাদের কেউ মৃত্যু কামনা করবে না। সে যদি সৎকর্মশীল হয়, তবে (বেঁচে থাকলে) আশা করা যায় আরও বেশি সৎকর্ম করতে পারবে। আর যদি অসৎকর্মশীল হয়, তবে তাওবা করবে ও নিজেকে সংশোধন করে ফেলবে।
এসব হাদীছ দ্বারা বোঝা যায়, মু’মিন ব্যক্তির পক্ষে দীর্ঘায়ু সর্বাবস্থায় কল্যাণকর। কেননা আয়ু যত দীর্ঘ হয়, ততই বেশি পুণ্য সংরক্ষিত হয়। সেই হিসেবে দীর্ঘজীবি ব্যক্তি বেশি পুণ্যবান হয়ে থাকে। তাই এক হাদীছে আছে-خياركم من طال عمرا و خشن عمله“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যার আয়ু দীর্ঘ হয় এবং আমল হয় উত্তম।”হাঁ, মৃত্যুকামনা যদি দীন ও ঈমান হেফাজতের লক্ষ্যে হয় বা আল্লাহর সাক্ষাতলাভের অধীর আগ্রহে এবং তাঁর সান্নিধ্যের আস্বাদ উপভোগের উদ্দেশ্যে হয়, তা জায়েয আছে। সাহাবায়ে কিরামের অনেকে এরকম মৃত্যুকামনা করেছেন। তবে সে ক্ষেত্রেও ‘হে আল্লাহ! আমাকে মৃত্যু দাও’ বা ‘হে আল্লাহ! আমাকে আর বাঁচিয়ে রেখ না এরূপ শব্দে সাধারণভাবে মৃত্যুকামনা ঠিক নয়। বরং হাদীছে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, সেভাবেই শর্তযুক্তভাবে দু’আ করা উচিত। অর্থাৎ বলবে, হে আল্লাহ! বেঁচে থাকা যতদিন আমার পক্ষে কল্যাণকর হয়, ততদিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখ আর যখন মৃত্যুই আমার জন্য কল্যাণকর হবে, তখন আমাকে মৃত্যু দিও।বেঁচে থাকা কল্যাণকর হওয়ার মানে দীন ও ঈমান রক্ষার সংগে বেঁচে থাকা। এরূপ বেঁচে থাকা অবশ্যই কাম্য। আর মৃত্যু কল্যাণকর হওয়ার মানে বেঁচে থাকলে ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকা।
এ অবস্থায় ঈমানের সংগে মৃত্যুই কল্যাণকর। যখন দেশে ঈমান-আমল রক্ষার পরিবেশ না থাকে, চারদিকে বদ্দীনী পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ে, বহুমুখী ফিতনা বেঈমানীর দিকে ডাকে, ফলে ঈমান-আমল রক্ষা কঠিন হয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবেই তখন বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় হয়ে যায়।এক হাদীছে আছে-وإذا كان أمراء كم شراركم و أغنياءكم بخلاءكم و أموركم إلى نسائكم فيظن الأرض خير لكم من ظهرها’যখন তোমাদের নেতৃবর্গ হয় নিকৃষ্ট লোক, তোমাদের ধনীরা হয় কৃপণ এবং তোমাদের কর্তৃত্ব থাকে নারীদের হাতে, তখন তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠ অপেক্ষা ভূগর্ভই শ্রেয়।”হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃক. দুনিয়ায় যত কষ্ট-ক্লেশই হোক না কেন, কিছুতেই মৃত্যু কামনা করা উচিত নয়। আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকাই মু’মিনের কর্তব্য।খ. কষ্ট-ক্লেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠলে এ হাদীছে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সেভাবে দু’আ করবে।
হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, মানুষ সৎকর্মশীল হোক আর পাপী হোক; কারো জন্যই মৃত্যু কামনা করা কল্যাণকর নয়। কারণ উভয়ের জন্য বেঁচে থাকায় কল্যাণের পথ খোলা থাকে।
তাছাড়া আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল মানুষের প্রতি কতটা মায়াশীল তাও এ হাদিস থেকে অনুমেয়। আবার কোনো বান্দা অন্যায় করুক এবং পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে কষ্টভোগ করুক; কুরআন-হাদিসের কোথাও এমনটিও কামনা করা হয়নি।
তাই আসুন, মৃত্যু কামনা নয়, শান্তি চাই। ইসলামের সুন্দর বিধি-বিধানে নিজেদের জীবন সাজাই। দুনিয়া ও পরকালের শান্তি লাভে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করি।
আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন কারণে ধৈর্যহারা, পথহারা, বিপদ-আপদ ও অসুখ-বিসুখে পতিত লোকদেরকে মৃত্যু কামনা করার মতো অবৈধ পন্থা অবলম্বন থেকে হেফাজত করুন। আমিন।