আমরা কেন হানাফী?
সর্বমহলে প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদ আছে, যেথায় ফুল সেথায় মধুকর ভোমরা। বস্তুতঃ যেথায় ফুল বা মধু আহরণের ব্যবস্থা আছে, সেখানে মধুকরের আনাগোনা হওয়া খুবই স্বাভাবিক ও কুদরতী বিষয়। অনুরূপভাবে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর গুণাগুণ, গভীর জ্ঞান, অসাধারণ বিচক্ষণতা ও অভূতপূর্ব গবেষণার চমক ছিল জগতনন্দিত ও সর্বজন স্বীকৃত। তাই তার কুদরতী প্রতিভা ও অপূর্ব গবেষণার সফল ছায়াতলে মুসলিম উম্মাহ দলে দলে সমবেত হয়ে তার গবেষণার ফসল তথা কুরআন-সুন্নাহর জটিল সমস্যার সঠিক সমাধান আহরণ করতে থাকে। তার জীবদ্দশাতেই বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক সমাধানের জন্য তার শরণাপন্ন হতে থাকে।
প্রায় এক লাখেরও বেশী শিষ্যবর্গ তার নিকট থেকে কুরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ও ইমাম যুফার (রহ.) প্রমুখ হচ্ছেন তার অন্যতম শিষ্য। এ ছাড়া তদানিন্তন যুগশ্রেষ্ট মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, ইমাম ও গবেষকগণ পর্যন্ত তার সমাধান, মতামত ও ফতওয়ার প্রতীক্ষায় থাকতেন। তার এবং তার নীতিমালায় সুপ্রতিষ্ঠিত শিষ্যবর্গের প্রদত্ত ফতওয়া বা কুরআন-সুন্নাহর সমাধানই হানাফী মাযহাব বা হানাফী ধারা হিসেবে চলতে থাকে। আর যারা এতে আকৃষ্ট হয়ে এ মাযহাব থেকে সমাধান গ্রহণ করতে থাকেন তারা হানাফী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সেই হানাফী মাযহাবের অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও অপূর্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে।
আজ গোটা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী লোক এ মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্যের অনুসারী। ইমাম আ’যম আবূ হানীফা (রহ.)-এর এ মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য আলোচনার অপেক্ষা মোটেই রাখে না। কিন্তু সাম্প্রতিককালের সৃষ্ট একটি চিহ্নিত সংখ্যালঘু ফিরকা সরলমনা জনসাধারণকে দ্বিধা বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে সমস্ত মাযহাবের ব্যক্তিবর্গ, ইমাম, দীনের ধারক বাহক বিশেষ করে হানাফী মাযহাবকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিগণিত করেছে। তাই হানাফী মাযহাবের অসংখ্য অগণিত শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে নিম্নে কিঞ্চত আলোকপাত করা হচ্ছে।?
১নং বৈশিষ্ট : কুরআনে কারীমের অগ্রাধিকার
হানাফী মাযহাবে কুরআনের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কারণ ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তি হল কুরআনে কারীম। কুরআন যে আল্লাহর কালাম তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তাই কোন বিষয়ে দলীল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধপূর্ণ হলে হানাফী মাযহাবে কুরআনে কারীমকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল। আশা করি বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। যেমন, নামাযে (ইমামের অনুসরণ করা অবস্থায়) মুক্তাদি সূরায়ে ফাতিহা পড়বে কি না? এ ব্যাপারে হাদীস বাহ্যিকভাবে বিরোধপূর্ণ। কিন্তু কুরআনে কারীমে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা রয়েছে- وَإِذَا قُرِءَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَانْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ.
“আর যখন কুরআন পড়া হয়, তখন মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ কর এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা সফল হতে পার।সূরা আ’রাফ ২০৪ ।
এ আয়াত নামাযের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই এর মর্মানুসারে ইমামের সশব্দে কুরআন পড়া অবস্থায় শ্রবণ করা ও চুপ থাকা যেমন ওয়াজিব, তেমনি নিঃশব্দে পড়া অবস্থায়ও কিছু না পড়ে নীরব ও চুপ থাকা ওয়াজিব। তাই এ আয়াতের মর্মকে প্রাধান্য দিয়ে হানাফী মাযহাবে ইমামের পিছনে নামায পড়াকালে মুক্তাদির জন্য সূরায়ে ফাতিহা পড়াও নিষিদ্ধ বলা হয়।
কুরআনে কারীমের অপর আয়াতে রয়েছে- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ. “হে মু’মিনগণ! তোমরা চুক্তি অঙ্গীকার পূর্ণ কর ।সূরা মায়িদা ১।
এ আয়াতের ভিত্তিতে হানাফী মাযহাবের একটি মাসআলা হল যে, কেউ যদি ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তথা একজন বলে ‘আমি বিক্রয় করলাম’ এবং অপর জন বলে, ‘আমি ক্রয় করলাম’ এমতাবস্থায় তাদের এ চুক্তি বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য এবং এ চক্তি ভঙ্গ করার কোন অবকাশ নেই। চাই তারা চুক্তিস্থলে বসা অবস্থায় হোক অথবা অন্য কোন সময়ে হোক না কেন। কেননা, আয়াতে চুক্তির অঙ্গীকার পূর্ণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে সময় ও অবস্থা প্রেক্ষিতে টাল বাহানা করার অবকাশ দেয়া হয়নি। মনে করুন, কোন মেয়ে যদি বলে, আমি বিবাহের অনুমতি দিলাম। আর ছেলে বলে, আমি গ্রহণ করলাম, সে ক্ষেত্রে বিবাহ চূড়ান্ত হয়ে যায়। টাল বাহানার অবকাশ থাকে না।
এভাবে উপরোক্ত আয়াতের আলোকে হানাফী মাযহাব অনুযায়ী সমস্ত চুক্তির অঙ্গীকার পূর্ণ করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে লা-মাযহাবীরা কুরআনে কারীমের এ সুস্পষ্ট আয়াত উপেক্ষা করত: হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে ক্রয়-বিক্রয়োত্তর বৈঠক ত্যাগ করা পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করা বা না করার অধিকার দিয়ে থাকে ।
পূর্ববর্তী আয়াতের এক আয়াত পর আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّه بِهِ والمُنخَيقَةُ وَالمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكِّيْتُمُوهُ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النَّصُبِ وَاَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالازْلَام ذلِكُمْ فِسْقٌ
“তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যে সব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উসর্গকৃত হয়, যা কণ্ঠ রাধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চ স্থান থেকে পতনের সময় মারা যায়, যা শিংয়ের আঘাতে মারা যায়, এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে। কিন্তু যাকে তোমরা যবেহ করেছ, যে জন্তু যজ্ঞবেদিতে যবেহ করা হয় এবং ভাগ্য নির্ধারণ শর দ্বারা বন্টন করা হয়। সব গোনাহের কাজ।” সূরা মায়িদা ৩।
এ আয়াতের ভিত্তিতে সমস্ত মৃত জীব ও শাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া প্রাণী মুসলমানদের জন্য আহার করা হারাম। কিন্তু একটি হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যার আলোকে লা-মাযহাবীরা গাভীর পেটে পাওয়া মৃত বাছুরের গোশত হালাল বলে থাকে। হাদীসটি হল : ذَكَاةُ الْحَنِيْنِ ذَكَاةُ أُمِّهِ . কিন্তু হানাফী মাযহাবে উপরোল্লিখিত সুস্পষ্ট আয়াতকে প্রাধান্য দিয়ে ঐ মৃত বাছুরের গোশত হারাম বলে আসছে। কেননা, এটিও অন্যান্য মৃত জীবের অবস্থায় যবেহ করে খেতে বলা হয়েছে।
এখানে হানাফী মাযহাবে কুরআনে কারীমকে দলীল হিসেবে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেয়ার মাত্র তিনটি উদাহরণ পেশ করা হল। এভাবে হানাফী মাযহাবে অসংখ্য মাসায়িল রয়েছে। যাতে কুরআনে কারীমের মর্মই প্রাধান্যতা ও অগ্রাধিকার পেয়েছে।
বৈশিষ্ট্য ঃ ২ হাদীসের যথাযথ মূল্যায়ন
হানাফী মাযহাবের ভিত্তিই হল সহীহ হাদীসের উপর আমল করা। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) ই সর্বপ্রথম বলেছেন- إذَا صَحَ الْحَدِيثُ فَهُوَ مَذْهَبِى. “সহীহ হাদীসই আমার মাযহাব হিসেবে গণ্য।”রদদুল মুহতার ১/৫০, শরহে উকূদে রাসমিল মুফতী ৪, ঈকাল হিমাম ৬২ ।
এর ভিত্তিতে তিনি হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন এবং যথাসাধ্য সহীহ হাদীসের আলোকে মাসআলার ভিত্তি রাখতেন। তবে যেসব বিষয়ে সহীহ হাদীস সংরক্ষিতভাবে পৌঁছেনি, সে ক্ষেত্রে হাসান ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত যয়ীফ বা দূর্বল হাদীস সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য। সেক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু হাদীস নির্বাচন ও যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব যে সতর্কতা ও উপকরণ অবলম্বন করেছে তা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে আমি শাফিঈ মাযহাবের মহামূল্যবান ও সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল-মীযানুল কুবরা’ প্রণেতা আব্দুল ওয়াহ্হাব শা’রানী (রহ.)-এর বিস্তারিত বক্তব্যের যৎসামান্য নিম্নে তুলে ধরছি-“আল্লাহ পাক কারো সাধনা কবুল করেন, আর কারো সাধনা কবুল করেন না। তাই বিফলরা সফলদের উপর হিংসাত্মক আক্রমণে লিপ্ত হয়। আমি হানাফী মাযহাবের সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছি। ইমাম আ’যম আবূ হানীফা (রহ.) তার মাযহাবের সব দলীল-প্রমাণ সর্বশ্রেষ্ঠ তাবেয়ীগণ থেকে আহরণ করেছেন। এসব বর্ণনার সূত্রে কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি থাকার কল্পনা করাও অসম্ভব। যদি বলা হয় কিছু সূত্রে দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছে, তবে জেনে রাখুন তা ইমাম আবূ হানীফার মৃত্যুর পরবর্তীতে কোন যুগে হয়েছে। আর এভাবে আপনি পেয়েছেন। এ পর্যায়ে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) থেকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত বিশুদ্ধ সূত্রে আক্রমণ করা যাবে না।
অনুরূপভাবে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর অনুসারীগণও যয়ীফ হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং সহীহ, হাসান ও বিভিন্ন সূত্রে গৃহীত যয়ীফ বা হাসান লি গাইরিহী হাদীস গ্রহণ করে থাকেন। আর এতটুকু অবকাশ সব মাযহাবেই রয়েছে।
অতএব, হে আমার ভাই! আবূ হানীফা ও তার সাথীবর্গের মাযহাবের প্রতি হঠকারিতা ও বিদ্বেষ বর্জন কর এবং হানাফীবিদ্বেষী মূর্খদের তাকলীদ তথা অনুসরণ থেকে সতর্ক থাক। এদের অনুকরণে হানাফী মাযহাবের দলীল প্রমাণকে দূর্বল বলা মানে দুনিয়া আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের রশি ধরা। তাই এসব হঠকারিতা ও বিদ্বেষ পরিত্যাগ করত হানাফী মাযহাবের দলীল-প্রমাণ অন্বেষণ কর, তাহলে বুঝতে সক্ষম হবে যে, হানাফী মাযহাবই সর্বাপেক্ষা সহীহ মাযহাব। আল মীযানুল কুবরা ১/৮৫ ।
প্রিয় পাঠক! এ অভিজ্ঞতাপূর্ণ তথ্য ও অনুসন্ধানের ফলাফল যিনি ব্যক্ত করেছেন, তিনি হানাফী মাযহাবের কোন আলিম নন। বরং তিনি শাফেঈ মাযহাবের একজন অন্যতম খ্যতিমান ও ক্ষণজন্মা বিজ্ঞ ইমাম। তিনিই হানাফী মাযহাবের এ বাস্তব ও সত্য বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে উদারতার পরিচয় দিলেন।
তাই যারা বলে হানাফী মাযহাবে সহীহ হাদীসের উপর আমল করা হয় না, তারা হয়ত হঠকারিতা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এ ক্ষোভ প্রকাশ করে। অথবা তারা সহীহ হাদীস জানে না বা সহীহ হাদীসের উপর আমল করার শর্তাবলী ও নীতিমালার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
চরম হিংসা ও বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একটি চিহ্নিত মহল সাম্প্রতিককালে হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যাচ্ছে যে, এ মাযহাবে হাদীসের যথাযথ মূল্যায়ন না করে কিয়াস-রায়ের প্রাধান্য দেয়া হয়! এ অভিযোগ নিছক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হিংসাত্মক, ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। যারা কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে আংশিক গবেষণাও করে বা হানাফী মাযহাব সম্পর্কে কিছু ধারনা রাখে তারাও এ ধরণের বর্বর উক্তি ব্যক্ত করতে পারে না। বরং কেবল হানাফী মাযহাবেই হাদীসের যথাযথ ও সঠিক মূল্যায়ন করা হয়। কোন বিষয়ে একটি দুর্বল হাদীস খুঁজে পাওয়া গেলেও যাবতীয় কিয়াস-রায়কে দুরে নিক্ষেপ করত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হাদীসকে প্রাধান্য দিয়ে হাদীসের ভিত্তিতে মাসআলা পেশ করা হয়। আর এ বাস্তব সত্যটুকু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ মর্মে বিশ্ববরেণ্য প্রথিতযশা ইমামগণও তা স্বীকার করতে বাধ্য। নিম্নে প্রমাণ হিসেবে তাদেরই কয়েকজনের উক্তি পেশ করছি।
আল্লামা ইবনে হাযাম তার উসূলে ফিকহের প্রসিদ্ধ কিতাব আল-ইহকামে এবং ইমাম যাহাবী (রহ.) ‘মানাকিবে আবূ হানীফা’য় লিখেন- إِن ضَعِيفَ الحَدِيثِ أَولَى عِندَ الأَمَامِ أَبِي حَنِيفَةَ مِنَ الرأي وَالْقِيَاسِ إِذَا لَمْ يُوْجَدْ فِى الْبَابِ غَيْرُهُ.
“কোন মাসআলায় বিশুদ্ধ হাদীস না পাওয়া অবস্থায় কিয়াস ও রায়ের তুলনায় দুর্বল হাদীসকে প্রাধান্য দেয়া ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর একটি মূলনীতি। আল ইহকাম ৭/৯২৯, আল মানাকিব ২১।
আরববিশ্ব ও লা-মাযহাবীদের স্বীকৃত ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেন- وَأَصْحَابُ أبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى مَجْمَعُونَ عَلَى أَنَّ مَذْهَبَ أَبِي حَنِيفَةَ أَنَّ ضَعِيفَ الْحَدِيْثِ عِنْدَهُ أَوْلَى مِنَ الْقِيَاسِ وَالرّأي.
“ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর সকল অনুসারীগণের ঐক্যমতে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর নিকট কিয়াস ও রায় অপেক্ষা দুর্বল হাদীস শ্রেষ্ঠ এবং তুলনামূলক প্রাধান্যযোগ্য। ইলামুল মুয়াক্কিঈন ১/৭৭।
অতঃপর ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) অনেকগুলো উদাহরণের আলোকে উপরোক্ত বিষয়কে আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। যেসব বিষয়ে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ কোন হাদীস নেই, আছে শুধু দুর্বল তথা যয়ীফ হাদীস। তাও আবার কিয়াস ও বাহ্যিক জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধপূর্ণ। এমতাবস্থায়ও ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কিয়াস ও বাহ্যিক জ্ঞান-বিজ্ঞান উপেক্ষা করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং হাদীস দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বিশুদ্ধ হাদীস না থাকায় তা গ্রহণ করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হাদীসের প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন ও গুরুত্বারোপ করেছেন।
এতদ্বসত্ত্বেও যদি বলা হয় যে, হানাফী মাযহাবে হাদীস অপেক্ষা কিয়াস ও রায়ের অগ্রাধিকার ও গুরুত্বারোপ করা হয়, তাহলে তা ইমাম আবূ হানীফা ও হানাফী মাযহাবের প্রতি ন্যাক্কারজনক অপবাদ ও হিংসাত্মক আক্রমণ বৈ আর কিছুই নয়। তাদেরকে আল্লাহর দরবারে অবশ্যই এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।
ইমাম শা’রানী আশ-শাফেঈ (রহ.) অত্যন্ত বিশুদ্ধ সনদে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর কয়েকটি উক্তি এ মর্মে উল্লেখ করেন। তিনি লিখেন যে,ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) বলেছেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যে বলবে আমি কুরআন-সুন্নাহর উপর কিয়াসকে প্রাধান্য দেই সে অবশ্যই আমার উপর মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপবাদ রটনা করল। কোন বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর উক্তি থাকতে কিয়াসের কোন প্রয়োজন আদৌ নেই। তবে কুরআন-সুন্নাহ ও সাহাবীগণের সুস্পষ্ট উক্তি না পেয়ে সমসাময়িক বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কিয়াস করতে হয়। যা সকল ইমামের নিকট গৃহীত একটি নীতিমালা ।
বৈশিষ্ট্য ঃ ৩ শ্রেষ্ঠ ও নির্ভুল দলীল প্রমাণের প্রাধান্য
আশা করি এ যাবৎ পেশকৃত তথ্যাবলীর আলোকে বিজ্ঞ পাঠকবর্গের নিকট সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, হানাফী মাযহাব শ্রেষ্ঠ ও নির্ভুল দলীল প্রমাণেরই একটি অনন্য সম্ভার। কুরআন-সুন্নাহ ও সাহাবাগণের উক্তির মোকাবিলায় এতে কিয়াস-রায়ের কোন স্থান নেই। সুস্পষ্ট ও আমলযোগ্য সহীহ হাদীসের বর্তমানে দুর্বল হাদীসের প্রয়োগ নেই।
মোটকথা, অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ ও নির্ভুল দলীল প্রমাণের প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেয়াই এ মাযহাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ নীতির আলোকেই ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কুরআনের বাণী ও হাদীসের মর্মের কার্যকরী বিধানে তুলনামূলক পার্থক্য করেছেন। কুরআনের দ্ব্যর্থহীন ও অকাট্য বাণীতে প্রমাণিত বিধানকে তিনি ফরয, আর এ ধরনের হাদীসের আলোকে প্রমাণিত বিধানকে তিনি ওয়াজিব বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম শা’রানী (রহ.) লিখেন, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর উপর আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হোক! তিনি আল্লাহর ও রাসূলে আকরাম (সা.) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীর মধ্যে ব্যবধান করে আল্লাহর বাণীকে ফরয আর রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বাণীকে ওয়াজিব নির্ণয় করে আল্লাহর বাণীকে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বাণী অপেক্ষা তুলনামূলক অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর তা কুরআন-সুন্নাহ সম্মত এবং তার শ্রেষ্ঠতম দলীল প্রমাণের প্রাধান্য দেয়ারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
অন্যত্র তিনি লিখেন: إِعْلَمُ يَا أَحَى إِنَّنِى طَالَعْتُ بِحَمْدِ اللَّهِ تَعَالَى أَدِلَّةَ الْمَذَاهِبِ الْأَرْبَعَةِ وَغَيْرِهَا لَا سَيِّمَا أدِلَّةَ مَذْهَبِ الإِمَامِ أَبِي حَنِيفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَإِنِّي خَصَّصْتُهُ بَمَزِيدِ اعْتِنَاءٍ وَطَالَعتُ عَلَيْهِ كِتَابَ تَحْرِيحِ أَحَادِيثِ كِتَابِ الْهِدَايَةِ لِلْحَافِظِ الزَّيْلَعِى وَغَيْرِهِ مِنْ كُتُبِ الشَّرُوْحِ فَرَأَيْتُ أَدِلَّتَهُ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ وَأَدِلَّةَ أَصْحَابِهِ مَا بَيْنَ صَحِيحٍ أَوْ حَسَنٍ أَوْ ضَعِيْفٍ كَثُرَتْ طُرُقُهُ حَتَّى لَحِقَ بِالْحَسَنِ أَوِ الصَّحِيحِ فِي صِحَّةِ الإِحْتِحَاجِ بِهِ مِنْ ثَلَاثَةِ طرقٍ أَوْ أَكْثَرَ إِلَى عَشَرَةٍ وَقَدِ احْتَجَّ جُمْهُورُ الْمُحَدِّثِينَ بِالْحَدِيثِ الضعِيْفِ إِذَا كَثرَتْ طُرُقُهُ .
“হে আমার ভাই! ভাল করে জেনে রাখ, আল-হামদু লিল্লাহ! আমি চারটি মাযহাবেরই দলীল প্রমাণ অধ্যয়ন করেছি। হানাফী মাযহাবের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছি। হাফিয যায়লা’য়ী (রহ.) কর্তৃক হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব হিদায়ার হাদীস সংকলন এবং এ মাযহাবের অন্যান্য ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) ও তার অনুসারীগণ কর্তৃক সংকলিত দলীল-প্রমাণ সহীহ ও হাসান (বিশুদ্ধ ও শুদ্ধ) হাদীসের ভিত্তিতেই পেয়েছি। আর পেয়েছি কিছু এমন যয়ীফ বা দুর্বল হাদীস যা এক থেকে দশটি পর্যন্ত সূত্রে বর্ণিত হওয়ার ফলে শুদ্ধ বা বিশুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের হাদীসের ভিত্তিতে সকল মুহাদ্দিসগণ দলীল পেশ করে থাকেন।”আল মীযানুল কুবরা ১/৮২।
তিনি আরও লিখেন, আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে আবূ হানীফা (রহ.)-এর সূত্রে প্রণীত তিনটি মাসানীদের (হাদীসের কিতাব) ই নির্ভরযোগ্য ও সত্যায়িত কপি অধ্যয়ন করেছি। এতে আমি প্রত্যক্ষ করেছি যে, ইমাম আবৃ হানীফা (রহ.) শ্রেষ্ঠ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ব্যতীত কারও নিকট থেকে হাদীস গ্রহণ করেননি। তাই তিনি লিখেন- إياك أن تُبَادِرَ إِلَى تَضْعِيْفِ شَيْءٍ مِنْ أدِلَّةِ مَذْهَبِ الْإِمَامِ أَبِي حَنِيفَةَ إلَّا بَعْدَ أن تُطَالِعَ مَسَانِيْدَهُ الثَّلَاثَةِ.ৎ
“সাবধান! ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর তিনটি হাদীসের মুসনাদ অধ্যয়ন করা ব্যতীত সে মাযহাবের কোন দলীলকে দুর্বল বলে হঠকারিতা করবে না।”আল মীযানুল কুবরা ১/৮৫।
ইমাম শা’রানী আরও লিখেন- وَتَتَبَّعْ أَدِلَّتَهُ كَمَا تَتَبَّعْنَاهَا تَعْرِفُ أَنَّ مَذْهَبَهُ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ مِنْ أَصَحُ الْمَذَاهِب. “হানাফী মাযহাবের দলীল-প্রমাণ অনুসন্ধান কর, যেভাবে আমরা করেছি। তাহলে বুঝতে পারবে যে, এ মাযহাবই সর্বাপেক্ষা সহীহ ও বিশুদ্ধ।’আল মীযানুল কুবরা ১/৮৫।
বৈশিষ্ট্য : ৪ সীমাহীন সতর্কতায় অটল
হানাফী মাযহাবে মাসআলা সংকলন ও যে কোন নীতিমালা প্রবর্তনে সীমাহীন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। অপর কোন মাযহাবে তা কল্পনাও করা যায় না। শাফেঈ মাযহাবের প্রখ্যাত আলিম ইমাম শা’রানী (রহ.) লিখেন, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর নিকট প্রায় চল্লিশ হাজার উলামা নিয়মিত সমাগম হত । তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দুরদর্শী ও বিচক্ষণ ছিলেন প্রায় চল্লিশ জন। কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছার লক্ষ্যে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) সতর্কতাহেতু সবার সম্মিলিত পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। সবাই ঐক্যমতে সম্মত হলে ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) বা অন্য কাউকে বলতেন যে, এ মাসআলা লিখে নাও।
( ইমামে আ’যম আবূ হানীফা (রহ.)-এর ফিকহী মজলিসে শূরার যে চল্লিশজন রোকনের কথা বিভিন্ন কিতাবে এসেছে। তাদেরকে একত্রিতভাবে এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে ডক্টর মিয়া মুহাম্মদ সিদ্দিকী এ ব্যাপারে গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি পুরোনো কিতাবসমূহ তালাশ করে চল্লিশজনের একটি তালিকা তৈরী করেছেন। হযরত মুফতী আযীযুর রহমান তাঁর লিখিত ‘ইমাম আবূ হানীফা’ গ্রন্থে ‘আমানিল আহবার’ ও ‘আল জাওয়াহিরুল মুযিয়্যা’র বরাত দিয়ে তাদের তালিকা পেশ করেছেন। আমি হযরত মাওলানা আলতাফ হুসাইন দামাত বারাকাতুহুম-এর কিতাব ‘মিফতাহুত তাফসীর’ থেকে এদের নাম উল্লেখ করছি। ১. ইমাম আবূ ইউসুফ মৃত্যু ১৮২ হিজরী ২. ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ শাইবানী মৃত্যু ১৮৯ হিজরী ৩. ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ মৃত্যু ২০৪ হিজরী ৪. ইমাম যফর ইবুনল হুযাইল মৃত্যু ১৮৫ হিজরী ৫. ইমাম মালিক ইবনে মিািগওয়াল মৃত্যু ১৫৯ হিজরী ৬. ইমাম দাউদ আত তায়ী মৃত্যু ১৬০ হিজরী ৭. ইমাম মিনদাল ইবনে আলী মৃত্যু ১৬৮ হিজরী ৮. ইমাম নছর বিন আব্দুল কারীম মৃত্যু ১৫৯ হিজরী ৯. ইমাম আমর ইবনে মায়মূন মৃত্যু ১৭১ হিজরী ১০. ইমাম হাব্বান ইবনে আলী মৃত্যু ১৭২হিজরী ১১. ইমাম আবূ উসামাহ মৃত্যু ১৭৩ হিজরী ১২. ইমাম যুহাইর ইবনে মু’আবিয়া মৃত্যু ১৭৪হিজরী ১৩. ইমাম কাসিম বিন মা’আন মৃত্যু ১৭৫ হিজরী.১৪. ইমাম হাম্মাদ ইবনে আবূ হানীফা মৃত্যু ১৭৬ হিজরী ১৫. ইমাম হাইয়াজ ইবনে বাসতাম মৃত্যু ১৭৭ হিজরী ১৬. শরীক ইবনে আবদুল্লাহ মৃত্যু ১৭৮ হিজরী ১৭. ইমাম আফিয়া ইবনে ইয়াযীদ মৃত্যু ১৮১ হিজরী ১৮. ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক মৃত্যু ১৮১ হিজরী ১৯. ইমাম নূহ ইবনে দাররাজ মৃত্যু ১৮২ হিজরী ২০. ইমাম হুশাইম ইবনে বুশাইর মৃত্যু ১৮৩ হিজরী ২১. ইমাম আবূ সাঈদ ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া মৃত্যু ১৮৪ হিজরী ২২. ইমাম ফুযাইল ইবনে ইয়াজ মৃত্যু ১৮৩হিজরী ২৩. ইমাম আসাদ ইবনে আমর মৃত্যু ১৬৮ হিজরী ২৪. ইমাম আলী ইবনে মুসহির মৃত্যু ১৮৯ হিজরী ২৫. ইমাম ইউসুফ ইবনে খালিদ মৃত্যু ১৮৯ হিজরী ২৬. ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস মৃত্যু ১৯২ হিজরী ২৭. ইমাম ফযল ইবনে মূসা মৃত্যু ১৯২ হিজরী ২৮. ইমাম আলী ইবনে যাবইয়ান মৃত্যু ১৯২ হিজরী ২৯. ইমাম হাফস ইবনে গিয়াস মৃত্যু ১৯৪ হিজরী ৩০. ইমাম ওয়াকী ইবনে জাররাহ মৃত্যু ১৯৭ হিজরী ৩১. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদুল কাত্তান মৃত্যু ১৯৮ হিজরী ৩২. ইমাম শুআইব ইবনে ইসহাক মৃত্যু ১৯৮ ইমাম আবূ হাফস ইবনে আবদুর রহমান মৃত্যু ১৯৯ হিজরী ৩৪. ইমাম আবূ মতী’ আল বালখী মৃত্যু ১৯৯ হিজরী ৩৫. ইমাম খালিদ ইবনে সুলাইমান মৃত্যু ১৯৯ হিজরী ৩৬. ইমাম আবদুল হামীদ মৃত্যু ২০৩ হিজরী ৩৭. ইমাম আবূ আসিম আন্ নাবীল মৃত্যু ২১২ হিজরী ৩৮. ইমাম মক্কী ইবনে ইবরাহীম মৃত্যু ২১৫ হিজরী ৩৯. ইমাম হাম্মাদ ইবনে দালীল মৃত্যু ২১৫ হিজরী ৪০. ইমাম হিশাম ইবনে ইউসুফ মৃত্যু ১৯৭ হিজরী।)
ইমাম শা’রানী (রহ.) অন্যত্র লিখেন, যে বলে হানাফী মাযহাবে সতর্কতার অভাব রয়েছে তার মধ্যে ইলম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনাও নেই।
তিনি আরও লিখেন- فَإِنِّي بِحَمْدِ اللَّهِ تَتَّبَعْتُ مَذْهَبَهُ فَوَجَدْتُهُ فِي غَايَةِ الْاِحْتِيَاطِ قَدْ اجمعَ السَّلَفُ وَالخَلَفُ عَلَى كَثرَةِ وَرِعِ الْإِمَامِ وَكَثرَةِ احْتِيَاطِهِ فِي
“আমি আল-হামদু লিল্লাহ! ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মাযহাব পরিপূর্ণভাবে অনুসন্ধান করেছি। দীন-ধর্মের ক্ষেত্রে আমি এ মাযহাবে চূড়ান্ত সতর্কতা প্রত্যক্ষ করেছি। আল মীযানূল কুবরা ১/৮৬।
তিনি আরও লিখেন- وَمَنْ فَتَشَ مَذْهَبَهُ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ وَجَدَهُ مِنْ أكثَرِ الْمَذَاهِبِ احتياطاً فِى الدِّينِ وَمَنْ قَالَ غَيْرَ ذَلِكَ فَهُوَ مِنْ جُمْلَةِ الْجَاهِلِينَ الْمُتَعَصِّبِيْنَ الْمُنْكِرِينَ عَلَى أَئِمَّةِ الْهُدَى بِفَهْمِهِ السَّقِيمِ.
“যে হানাফী মাযহাব গভীরভাবে অনুধাবন ও অনুসন্ধান করবে সে অবশ্যই ধর্মীয় ক্ষেত্রে এ মাযহাবকে সকল মাযহাবের তুলনায় সতর্কতা অবলম্বনকারী হিসেবেই পাবে। আর যে এ বাস্তবতার বিপরীত বলবে সে অবশ্যই অজ্ঞ,হবে।”আল মীযানুল কুবরা ১/৮৯।
বৈশিষ্ট্য: ৫ দলীল ভিত্তিক মাসায়িলের সুবিন্যস্ত সম্ভার
কোন মাযহাবের অনুসরণ করতে হলে, পুরো শরীয়তের ছোট বড় সব ধরনের সমস্যার সমাধান কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা এবং যাবতীয় উসূল ও নীতিমালা সে মাযহাব অনুসারে লিপিবদ্ধ আকারে সুবিন্যস্তভাবে সর্বসাধারণের নাগালে বিদ্যমান থাকা অতিব জরুরী। এ ব্যাপারে সার্বিক ব্যবস্থাপনা হানাফী মাযহাবে সমুন্নত রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইমাম আ’যম হানীফা (রহ.)-এর জীবদ্দশাতেই তার অন্যতম শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ও ইমাম যুফার (রহ.) ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) থেকে প্রদত্ত তাফসীর, হাদীস, আকায়িদ ও উসূল নীতিমালাসমূহ সনদ সহকারে গ্রন্থণা করতঃ স্বীয় উস্তাদ আবূ হানীফার সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল গবেষণালব্ধ মাসায়িল উম্মতের খিদমতে রাখতে নিবেদিত হন। কেবল ইমাম মুহাম্মাদ’ (রহ.)ই নয়শতা নিরান্নব্বইটি কিতাব রচনা করেন। ইসলামী শরীয়তের সকল বিষয়েই তার অমূল্য কিতাব রয়েছে। বিশেষ করে ফিকহের মৌলিক বিষয়ের সমন্বয়ে এবং ফিকহের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে পৃথক পৃথক রচনা তার রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ হল, আস সিয়ারুস সগীর, আস সিয়ারুল কাবীর, আল জামিউস সগীর,আল জামিউল কাবীর’, আল মাবসূত, আয যিয়াদাত?, আল ফাতাওয়াল হানাফিয়্যা ও মুআত্তা ইত্যাদি। এছাড়া রচনার খিদমত হানাফী মাযহাবে বরাবরই চলে আসছে। কেবল তাফসীরের জগতেই অর্ধশতাধিক প্রসিদ্ধ কিতাব রয়েছে হানাফীদের। তন্মধ্যে ইমাম আবূ বকর জাসাস আল হানাফী (রহ.) প্রণীত আহকামুল কুরআন, ইমাম নাসর ইবনে মুহাম্মদ সামারকান্দী হানাফীর (রহ.) প্রণীত তাফসীরে বাহরুল উলূম, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ নাসাফী হানাফী (রহ.) প্রণীত তাফসীরে মাদারিকুত্ তানযীল, আল্লামা মাহমূদ আলূসী হানাফী (রহ.) প্রণীত তাফসীরে রুহুল মা’আনী ও সউদী আরবের রাবেতা কর্তৃক প্রকাশিত শাইখ মুহাম্মদ আলী সাধূনী হানাফীর তাফসীর ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আকীদার জগতে রয়েছে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কর্তৃক প্রণীত আল ফিকহুল আকবার এবং ইমাম আবূ জা’ফর তাহাবী (রহ.) কর্তৃক প্রণীত আল আকীদাতুত তাহাবী যা এ বিষয়ে সর্বপ্রথম ভিত্তিমূলক রচনা হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত।
হাদীস ব্যাখ্যার জগতে ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) প্রণীত বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা উমদাতুল কারী, আল্লামা শিব্বীর আহমদ (রহ.) প্রণীত মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা ফতহুল মুলহিম, আল্লামা ইউসুফ বিননূরী (রহ.) প্রণীত তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যা মা’আরিফুস সুনান, আল্লামা খলীল আহমদ (রহ.) প্রণীত আবূ দাউদ শরীফের ব্যাখ্যা বাযলুল মাজহুদ, শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া (রহ.) প্রণীত মু’আত্তা মালিকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওজাযু মাসালিক ইত্যাদি আংশিক উদাহরণ মাত্র।
এভাবে হাদীসের বর্ণনাকারীদের পরিচয়ে লিখেছেন আল্লামা আলাউদ্দীন মুগলতাই হানাফী (রহ.) ইকমালু তাহযীবিল কামাল নামক বিশাল কিতাব এবং হাদীসের শাব্দিক বিন্যাসে লিখেছেন মালিকুল মুহাদ্দিসীন আল্লামা মুহাম্মদ তাহির আস সিদ্দীকী আল ফাত্তানী আল গুজরাতী আল হিন্দী হানাফী (রহ.) ‘মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার’ নামক সুপ্রসিদ্ধ হাদীস বিশ্বকোষ। এ মূল্যবান গ্রন্থটি বড় বড় পাঁচ খন্ডে বিভক্ত।
হাদীসের উসূল ও নীতিমালার জগতে রয়েছে মুহাম্মদ ইবরাহীম হালবী হানাফী (রহ.) প্রণীত কাল আসর, মুহাম্মদ আব্দুল হাই লাখনোভী (রহ.) প্রণীত যাফরুল আমানী এবং যুফার আহমদ উসমানী হানাফী (রহ.) প্রণীত কাওয়াইদ ফী উলূমুল হাদীস ইত্যাদি।
বৈশিষ্ট্য ঃ ৬ অপূর্ব তাত্ত্বিক গবেষণার অনন্য সমাহার
আল-কুরআনের ইরশাদ- আর তাদের নিকট যখন কোন সমস্যা দেখা দেয়, তখন তাতে নিজেরা কোন মন্তব্য না করে যদি রাসূল ও তাদের মধ্যে বিজ্ঞদের নিকট পৌছে দিত, তাহলে গবেষণায় যোগ্যতা সম্পন্নরা সে বিষয়ে গবেষণা করে কোন সিদ্ধান্তে উপণীত হত। وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوْا بِهِ وَلَوْ رَدُّوْهُ إِلَى الرَّسُوْلِ أَوْ إِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِيْنَ يَسْتَنبِتُوْنَهُ مِنْهُمْ. এ আয়াতের ভিত্তিতে সাধারণ লোক বা কুরআন-সুন্নাহর গবেষণায় অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়তের কোন জটিল বিষয়ে মন্তব্য ও তা সমাধানের প্রচেষ্টা করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে ইস্তিম্বাত ও গবেষণায় যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বও বর্তায় এ সব বিষয়ে সবাই ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর অপূর্ব তত্ত্বপূর্ণ অনন্য তথ্যবহুল ও নিখুত নির্ভুল গবেষণামূলক সমাধানের প্রতীক্ষায় থাকতেন।
ইমাম যাহাবী (রহ.) লিখেন, কূফার তদানীন্তন অন্যতম ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আ’মাশ (রহ.) কে কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কে জিজ্ঞেস কর। কেননা, তার ইলম প্রজ্ঞা ও গবেষণায় আল্লাহ পাক বরকত দিয়েছেন বলেই আমি মনে করি। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব আল-ফিকরুস্ সামীতে লিখেন-
إِنَّ أَبَا حَنِيْفَةَ قَدْ تَوَسَّعَ فِي الْقِيَاسِ وَالْإِسْتِنْبَاطِ بِمَا كَانَ لَهُ مِنْ حَوْدَةِ الْفِكْرِ الوَقَارِ وَحُسْنِ الْاعْتِبَارِ الصَّحِيحِ وَسُرْعَةِ الْخَاطِرِ وَتَدْقِيقِ النَّظْرِ وِ كَمَالِ الإِمَامَةِ فِيْهِ فَلِذَلِكَ اسْتَنْبَطَ فُرُوْعاً وَبَيَّنَ أَحْكَامَهَا
“ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গময় বিচক্ষনতা, উৎকৃষ্ট ও বিশুদ্ধতম চয়নশক্তি, দ্রুত ও সুনিপুন অনুধাবন ক্ষমতা এবং পরিপূর্ণ ইমামের আসনে আসীন ছিলেন। এ কারণে সমকালীন মাসআলা মাসায়িলের সর্বাপেক্ষা বেশী গবেষণামূলক সমাধান এবং অসংখ্য মাসায়িল ও বিধি-বিধান কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে তাত্ত্বিক গবেষণা করত: মুসলিম উম্মাহর খিদমতে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। আল ফিকরুস সামী ১/৪১৭।
বৈশিষ্ট্য : ৭ শ্রেষ্ঠ ও যুগোপযোগী সমাধানের অনন্য উপকরণ
সর্বকালে ও সকল মহলেই নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্ট সব সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধান কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে রয়েছে । কিন্তু তাও সত্য যে, সব সমস্যার সমাধান বিভিন্ন হিকমতের কারণে কুরআন-সুন্নাহে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে দেয়া হয়নি। তাই কোন ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর বর্ণিত বিষয়ও সবার পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব বা সহজসাধ্য নয়। ইতিপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এবং তার অনুসারী ইমামগণ এ সব উদ্ভুত সমস্যার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান পেশ করেছেন। এমনকি বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কিরাম বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানের আলোকে সুদৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর সমাধান ও গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং তার মাযহাবের নীতিমালা সর্বকালে ও সর্বমহলেই মাইলফলক হিসেবে সমাদৃত হবে।
এ মর্মে শাফিঈ মাযহাবের অন্যতম আলিম ইমাম শা’রানী (রহ.) লিখেন- إِنَّهُ يُحِبُ عَلَى كُلِّ مُكَلَّفٍ أَن يَشْكُرَ اللَّهَ تَعَالَى عَلَى إِبْحَادِهِ مِثْلَ الْإِمَامِ أَبِي حَنِيْفَةَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ فِي الدُّنْيَا لِيُوَسِّعَ عَلَى النَّاسِ تَبْعاً لتيسيرِ اللَّهِ تَعَالَى وَرَسُوْلِهِ ﷺ وَجَمِيعُ مَا سَكَتَ الشَّرْعُ عَنْهُ وَلَمْ يتعرض فيه لأمرٍ ولا نهي فهو عَافِية وتوسعة عَلَى الأُمَّةِ فَلَيْسَ لِأَحَدٍ أن يَحْجُرَهُ عَلَيْهِمْ..
“সমগ্র মুসলিম জাতির উপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এ জন্য ওয়াজিব যে, তিনি ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মত একজন মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছেন তার ও তার রাসূলের আনুগত্যের পথ সহজ সরল করার জন্য এবং যে বিষয়ে শরীয়তে সুস্পষ্ট নির্দেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞা নেই এর সুষ্ঠ সমাধানের জন্য । আর তা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তির উন্মুক্ত দ্বার। যার বিমুখ হওয়ার কারও জন্য সমীচীন নয়।” আল মীযানূল কুবরা ১/৮৮।
হানাফী মাযহাব সহজ সরল ও সর্বযুগে সর্বমহলে উপযোগী হওয়ায় এ মাযহাবের অনুসারী বর্তমানে বিশ্ব মুসলিমের দুই তৃতীয়াংশে চলে এসেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এর ক্রমোন্নতি সমুন্নত থাকবেই ইনশা আল্লাহ।
ইমাম শা’রানী আরো লিখেন- وَمَذْهَبُ الْإِمَامِ أَبِي حَنِيفَةَ أَوَّلُ الْمَذَاهِبِ تَدْوِيْناً وَآخِرُهَا انْقِرَاضاً كَمَا قَالَهُ بَعْضُ َأهْلِ الْكَشْفِ قَدِ اخْتَارَهُ اللَّهُ تَعَالَى إِمَاماً لِدِينِهِ وَعِبَادِهِ وَلَمْ يَزَلْ أَتْبَاعُهُ فِي زِيَادَةٍ فِي كُلِّ عَصْرٍ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَوْ حبِسَ أَحَدُهُمْ وَضُرِبَ عَلَى أنْ يَخْرُجَ عَنْ طَرِيْقِهِ مَا أَجَابَ فَرَضِيَ اللهُ عَنْهُ وَعَنْ أَتْبَاعِهِ.
“হানাফী মাযহাব সংকলণের হিসেবে সর্বপ্রথম এবং বিলুপ্তির দিক দিয়ে সর্বশেষ । আধ্যাত্মিক মনীষীগণের ভাষ্য মতে আল্লাহ পাক তার দীনের সংরক্ষণ ও বান্দাদের দিক নির্দেশনার জন্য ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) কে মনোনীত করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত সর্বকালেই তার অনুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। তার মাযহাব পরিত্যাগ করার জন্য কাউকে কারাবদ্ধ বা প্রহার করা হলেও কেউ তাতে সম্মত হবে না। আল্লাহ তার ও তার মাযহাবের অনুসারীদের প্রতি রাজী হোন।”আল মীযানুল কুবরা ১/৭৭।
বৈশিষ্ট্য ঃ ৮ মুসলিম বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ট ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সমাদৃত
ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর জীবদ্দশা থেকে অদ্যাবধি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, ফকীহ ও বিশেষজ্ঞ আলিমগণ বরাবরই হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করে আসছেন। কোন ধরনের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা ব্যতীতই অকল্পনীয়ভাবে এ মাযহাবের গ্রহণযোগ্যতা, ব্যাপকতা ও অসীম গুরুত্ব মুসলিম বিশ্বে অতি দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ মর্মে ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) লিখেন- لَمْ يَظْهَرْ لِأَحَدٍ مِنْ أئِمَّةِ الإِسْلَامِ الْمَشْهُورِينَ مِثْلُ مَا ظَهَرَ لِأَبِي حَنِيفَةَ مِنَ الْأَصْحَابِ وَالتَّلَامِيذِ وَلَمْ يَنْتَفِعِ الْعُلَمَاءُ وَجَمِيعُ النَّاسِ بِمِثْلِ مَا انْتَفَعُوا بِهِ وَبِأَصْحَابِهِ فِى التَّفْسِيرِ وَالْأَحَادِيثِ وَالْمُشْتَبِهَةِ وَالْمَسَائِل الْمُسْتَنْبَطَةِ وَالنَّوَازِلِ وَالْقَضَاءِ وَالْأَحْكَامِ.
“সুপ্রসিদ্ধ ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর ন্যায় ভক্তবৃন্দ ও খ্যাতি আর কারো হয় নি। তাফসীর, হাদীস, সমসাময়িক মাসআলা-মাসায়িল, বিচার বিভাগ ও শরীয়তের সার্বিক বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে উলামাগণ ও সর্বসাধারণ যেমন ব্যাপকভাবে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) ও তাঁর শিষ্যবর্গ থেকে উপকৃত হয়েছেন, আর কারো নিকট থেকে তা হয়নি।”আল খায়রাতুল হিসান ৭২।
وَالْعِلْمُ بَرَا وَبَحْراً شَرْقاً وغُرْباً قُرْباً وَبُعْداً تَدْوِيْنُهُ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى . “জলে-স্থলে, পূর্বে-পশ্চিমে, দূরে-অদূরে সর্বত্র শরীয়তের জ্ঞান তথা ইলম ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এরই সংকলন ও অবদান।
শাফি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ মিসরী (রহ.) লিখেন:
“ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) ও হানাফী মাযহাবের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য হতে ৮ নম্বর বৈশিষ্ট্য হল, তার মাযহাব এমন ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে কয়েকটি দেশে হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন মাযহাবের অনুসারীই নেই। যেমন, ভারত উপমহাদেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান) সিরিয়া, তুর্কিস্তান, রাশিয়া, বুখারা, জায়াকিস্তান এবং অধিকাংশ অনারব দেশের মুসলমানগণ এককভাবে হানাফী মাযহাবেরই অনুসরণ করে আসছেন।
বৈশিষ্ট্য : ৯ আল্লাহর কুদরতী নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত
নবী-রাসূলদের ধারাবাহিকতা রহিত হওয়ার সাথে সাথে ওহীর ধারাবাহিকতারও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তাই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে কোন সরাসরি ও নিশ্চিতভাবে অকাত হওয়ার কোন ব্যবস্থা বর্তমানে আর তবে কখনো কখনো আল্লাহ পাক মেহেরবানী করে তার ওলীগণকে কোন বিষয়ে ইলহাম ও স্বপ্নযোগে সুসংবাদ দিয়ে থাকেন। তা শরীয়তে ব্যাপক দলীল হিসেবে উল্লেখযোগ্য না হলেও ব্যক্তিগতভাবে সুসংবাদ ও মনের প্রশাস্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক স্বপ্নোল্লিখিত ঘটনা তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। কেননা, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশুদ্ধ হাদীসে ইরশাদ করেন, عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ فَقَدْ رَآنِي فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَتَخَيَّلُ بِي.
“যে আমাকে স্বপ্নে দেখেছে, অবশ্যই সে আমাকেই দেখেছে। কেননা, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।”১ তাই এ বিষয়ে নিয়ে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করেছি।বুখারী ৮/৪০২, হদীস নং ৬৯৯৪, মুসলিম ৪/১৭৭৫, হাদীস নং ২২৬৬।
হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী মাক্কী আশ-শাফেঈ (রহ.) ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর জীবনীগ্রন্থ “আল-খাইরাতুল হিসানে” লিখেন-“ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) অত্যন্ত বিনয় ও অনুনয়ের বশবর্তী হয়ে আত্মগোপনের প্রতি প্রভাবিত ছিলেন। এক পর্যায়ে স্বপ্নযোগে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীদারে ধন্য হলে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার সংকলিত বিষয়বস্তু জনগণের খিদমতে তুলে ধরার ইঙ্গিত করেন। ফলে তিনি এসব বিষয় গ্রহণ করার জন্য মুসলমানদেকে আমন্ত্রণ জানান।” আল-খাইরাতুল হিসানে।
ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) -এর কয়েকটি স্বপ্নের ঘটনা ইতিপূর্বেও আলোচনা করেছি। তম্মধ্যে একটি ঘটনায় তিনি উল্লেখ করেন- عَرَّفَنِي رَسُولُ اللهِ ﷺ أَنَّ فِي الْمَذْهَبِ الْحَنَفِى طَرِيقَةُ أَيْقَةُ فِي أَوْفَقُ الطَّرُقِ بِالسُّنَّةِ الْمَعْرُوفِةِ الَّتِي جُمِعَتْ وَنَفْحَتْ فِي زَمَانِ الْبَحَارِي وَأَصْحَابِهِ.
“রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে (হারামাইন শরীফাইন থাকাকালীন) স্বপ্নযোগে হানাফী মাযহাবের পরিচয় বর্ণনা করেন যে, শাফী মাযহাবে এমন উৎকৃষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, যা শরীয়তের সুস্পষ্ট সুন্নাত তরীকার সঙ্গে অতি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যেগুলো ইমাম বুখারী (রহ.) ও তার সমসাময়িকদের যুগে সুবিন্যস্ত ও আকর্ষণীয়ভাবে সম্পাদিত হয়েছে।
লা-মাযহাবীদের অন্যতম পুরোধা মুহাম্মাদ মুঈন তার স্বীয় কিতাব ছীরাতুল লাবীবে” লিখেন- إِنَّ مُعَاذَ الرَّازِى رَأَى النَّبِيِّ ﷺ فقال أين أطلبُكَ يَا رَسُول الله قَالَ عِنْدَ فِقْهِ أَبِي حَنِيْفَةَ.
“মু’আয রাযী নামক জনৈক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নযোগে দর্শন করতঃ জিজ্ঞেস করেন যে, আপনাকে কোথায় অনুসন্ধান করব? তদুত্তরে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আবূ হানীফা (রহ.)-এর ফিকহের আলোকে আমাকে অনুসন্ধান কর।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।