ইসলাম

গীবত ত্যাগ করার উপকারিতা

গীবত পরিহার করা এবং বাকশক্তিকে মানুষের নিন্দা করা থেকে বিরত রাখার মধ্যে অনেক বড় বড় উপকারিতা রয়েছে। গীবত ত্যাগকারী অনেক সম্মানের অধিকারী হয়। গীবত পরিত্যাগের কিছু উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হলো ।

১. গীবত করা মুসলমানের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করে সে এক জঘন্য পাপ থেকে বেঁচে যায়।

২. গীবত করা যেনায় লিপ্ত হওয়ার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করলো সে যেনার চাইতে মারাত্মক একটি অপরাধ থেকে নিজেকে রক্ষা করলো

৩. গীবতের ফলে রোযার মত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত।নষ্ট হয়ে যায়। অতএব যে ব্যক্তি গীবত পরিহার করলো সে তার রোযাকে রক্ষা করলো।

৪. গীবতের দ্বারা উযুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য হানাফী মাযহাব মতে কোন ব্যক্তি উযু করার পর গীবতে লিপ্ত হলে বা মিথ্যা বললে তার পুনরায় উযু করা উচিত। ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) বলেন, দু’টি কারণে উযু নষ্ট হয়। পায়খানা-পেশাবের রাস্তা দিয়ে কিছু নির্গত হলে এবং কোন মুসলমানকে কষ্ট দিলে। (বায়হাকী)।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, ঘুমের দ্বারা যেভাবে উযু নষ্ট হয়, তেমনিভাবে মিথ্যাচার ও গীবতের কারণেও উযু নষ্ট হয়ে যায় (দুররে মানছুর)। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করলো সে নিজের উযুকে রক্ষা করলো, যে উযু ছাড়া নামায পড়া যায় না, কুরআন স্পর্শ করা যায় না।

৫. গীবত ত্যাগের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে অর্থাৎ কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে যেতে পারে। কুরআন মজীদে গীবতকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

৬. গীবতের মাধ্যমে গীবতকারী অপর ব্যক্তিকে আহত করে। সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন, আমি কোন ব্যক্তির গীবত করার চেয়ে তাকে তীর দিয়ে আহত করাটা সহজতর অপরাধ মনে করি। অতএব যে ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করলো সে অন্যকে আহত করা থেকে বিরত থাকলো।

৭. যে ব্যক্তি নিজের বাকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে না এবং মানুষের গীবত করে বেড়ায় সে পরিশেষে অপমানিত হয়। অতএব গীবত ত্যাগ করে নিজেকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানো যায়।

৮. কোন ব্যক্তি গীবত ত্যাগ করে নিজের অন্তরাত্মাকে নির্মল ও পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : اِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذا أَذْنَبَ كَانَتْ نُقْطَةً سَوْداءَ فِي قَلْبِهِ “মুমিন ব্যক্তি যখন কোন গুনাহের কাজ করে তখন তার অন্তরাত্মায় একটি কালো দাগ পড়ে যায়” (ইবনে মাজাহ)। অতএব কোন ব্যক্তি গীবত পরিহার করলে তার অন্তরে দাগ পড়তে পারে না। ফলে তার অন্তর নির্মল ও স্বচ্ছ থাকে।

৯. যে ব্যক্তি গীবত করে না সে কিয়ামতের দিন লজ্জিত ও অপমানিত হবে না। কারণ সে মানুষের মান-সম্মানে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকেছে।

গীবত পরিহার ইবাদতের চেয়ে উত্তম

কোন কোন তাবিঈ বলেছেন, আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের লক্ষ্য করেছি যে, তাঁরা গীবত প্রতিহত করাকে নামায-রোযার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করতেন (ইহয়াউলূমিদ্দীন) তা সত্ত্বেও নামায সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত এবং কোন কোন মনীষী রোযাকে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) কয়েকটি কারণে গীবত পরিহার করাকে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করতেন।

যেমন নামায-রোযা আল্লাহ তাআলার এমন ইবাদত যা পরিত্যাগ করলে কেবল আল্লাহর অসন্তোষের শিকার হতে হবে। কিন্তু গীবতের বেলায় আল্লাহর নির্দেশ লংঘিত হয় এবং বান্দার অধিকারও খর্ব হয়। আল্লাহর নাফরমানি ক্ষমাযোগ্য। কারণ তিনি বান্দাদের প্রতি দয়াপরবশ ও করুণাময়। এমনকি তিনি তাঁর নাফরমান কাফের বান্দাদেরও সুখশান্তি দান করেন। গুনাহগার বান্দা দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলে, অনুতপ্ত হলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।

কিন্তু গীবত এমন একটি পাপাচার যে, তাতে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলেই পাপমুক্ত হতে পারে না। গীবতকারী যতক্ষণ গীবতকৃত ব্যক্তির নিকট ক্ষমা না চাইবে ততক্ষণ আল্লাহ পাক তার পাপ ক্ষমা করবেন না। কারণ সে গীবত করে এক ব্যক্তির মান-সম্মানে আঘাত হেনেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ঃ انَّ مِنْ أرْبَى الرِّبوا الاسْتِطَالَةُ فِي عَرْضِ الْمُسْلِم بِغَيْرِ حَقِّ . “অন্যায়ভাবে কোন মুসলমানের মান-ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সূদের পাপের চেয়েও মারাত্মক” (বায়হাকী)।

দ্বিতীয়তঃ পাপাচার ত্যাগ করা ইবাদত করার চাইতে অধিক ফযীলাতপূর্ণ অর্থাৎ কোন ব্যক্তি ইবাদত করে না কিন্তু শরীআতে নিষিদ্ধ পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখে, সে এমন ব্যক্তির চেয়ে উত্তম যে ইবাদতও করে এবং সগীরা-কবীরা সব গুনাহেও লিপ্ত থাকে, বিশেষত সেই সব গুনাহে যা গীবতের মত নিকৃষ্ট। এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলো, এক ব্যক্তি প্রচুর ইবাদতও করে আবার প্রচুর পাপাচারেও লিপ্ত থাকে এবং অপর ব্যক্তি কম ইবাদত করে এবং পাপাচারেও কম লিপ্ত হয়, এদের মধ্যে কে উত্তম? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কম ইবাদত করে এবং কম পাপ করে (তামবীহুল গাফিলীন)

তৃতীয়তঃ প্রতিটি পাপাচারই ব্যাধি। যে ব্যাধির প্রতিশেধক সম্পর্কে লোকেরা অবহিত সেই ব্যাধি কম মারাত্মক। কিন্তু যে ব্যাধির প্রতিশেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি তা অধিক মারাত্মক। তা থেকে নিরাময় লাভ করা দুষ্কর। গীবত এমন একটি রোগ যার প্রতিশেধক মানুষের জানা নাই। কারণ গীবতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয় তা মানুষ অনুমান করতে পারে না। তাই আমাদের বাকযন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ গীবতের মত ধ্বংসাত্মক গুনাহসহ অধিকাংশ গুনাহ আমাদের মুখের দ্বারা সংঘটিত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জিহ্বা স্পর্শ করে বলেন : ‘এটা এমন একটি অঙ্গ যার সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন’ (ইবনে মাজা)। অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : مَنْ وَقَاهُ اللهُ شَرِّ اثْنَيْنِ وَلَجَ الْجَنَّةَ . “আল্লাহ যাকে দু’টি জিনিস থেকে বাঁচাবেন সে জান্নাতের অধিকারী হবে।

গীবতে লিপ্ত হওয়ার কারণ ও তার প্রতিকার:

মানুষ বিভিন্ন কারণে গীবতে লিপ্ত হয়। যেমন কোন ব্যক্তির প্রতি কোন কারণে অসন্তুষ্ট হলে অসন্তুষ্ট ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষের গীবতে লিপ্ত হয়। এই অসন্তুষ্ট হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। শত্রুতা ও অহংকারের বশবর্তী হয়েও কোন ব্যক্তি অপরের গীবতে লিপ্ত হয়ে থাকে। এক ব্যক্তিকে গীবত করতে দেখে অপর ব্যক্তি তার সাথে তাল মিলিয়ে গীবতে লিপ্ত হতে পারে। কোন ব্যক্তিকে অপমান করার উদ্দেশ্যেও তার প্রতিপক্ষ গীবতে লিপ্ত হয়ে থাকে। যেসব কারণে মানুষ অপরের গীবত করে সেই সব কারণ নিজের মধ্য থেকে দূর করতে পারলেই অপরের দোষ চর্চার এই মারাত্মক রোগের প্রতিকার হতে পারে।(বিষয়টি ইমাম গাযালীর নিবন্ধে বিস্তারিত দেখুন)।

গীবতের কাফফারা

নিজের বাকশক্তিকে সংযত রাখা মানুষের কর্তব্য। তাহলে সে গীবতে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচতে পারবে এবং তার ঈমান, আমল ও আখেরাত বরবাদ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। সতর্কতা অবলম্বনের পরও যদি গীবত হয়ে যায়, তবে সাথে সাথে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিকট তওবা করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। অনন্তর যার গীবত করা হয়েছে, অকপটে তার নিকটও ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।কারণ গীবত এমন একটি অপরাধ যেখানে আল্লাহর অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয় (তাঁর নির্দেশ লংঘিত হয়) এবং বান্দার অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। এজন্য আল্লাহর নিকট তওবা করার সাথে সাথে বান্দার নিকটও ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। বান্দা ক্ষমা করলে তবেই শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।

সূত্রঃ বই- গীবত

লিখক :মাওলানা আবদুল হাই লাখনাভী (রহঃ)

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *