সবরের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ
সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া বা বিরত রাখা।
শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেড়া থেকে বিরত রাখা।
কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ্য ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
জুনায়েদ বাগদাদী রহ. কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা।’
জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।’
কারও মতে, ‘সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা।’
আবার কারও মতে, ‘বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।
এক বুযুর্গ এক ব্যক্তিকে অন্যের কাছে তার সমস্যা নিয়ে অনুযোগ করতে শুনলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি ভাই, স্রেফ যে দয়া করে না তার কাছে দয়াকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছো। এর বেশি কিছু করোনি।’
এ সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ করো, তখন মূলত সদয়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ করো।’
অভিযোগ করাটা দুই ধরনের। একটি হলো, আল্লাহ তা’আলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন,
قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
‘সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।'[17]
অপরটি হলো, নিজের মুখের বা শরীরের ভাষায় মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটি সবর পরিপন্থী।
সবর বা ধৈর্য ধারণ করা আকীদার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জীবনে বিপদ-মুসিবত নেমে আসলে অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর নিকট প্রতিদান পাওয়ার আশা করতে হবে। ইমাম আহমদ রহঃ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নব্বই স্থানে সবর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।”
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, الصبر ضياء “সবর হল জ্যোতি।” (মুসনাদ আহমদ ও মুসলিম)
উমর রা. বলেন, “সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।” (বুখারী)
আলী রা. বলেন,“ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত। এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।”
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَا أَعْطَى اللَّهُ أَحَدًا مِنْ عَطَاءٍ أَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ
“আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেন নি।” (সুনান আবু দাঊদ, অনুচ্ছেদ: নিষ্কলুষ থাকা। সহীহ)
সবরের প্রকারভেদ
সবর প্রথমত দু’প্রকার—
(১) দৈহিক সবর; যেমন দৈহিক কষ্ট সহ্য করা এবং তাতে সুদৃঢ় থাকা।
(২) মানসিক সবর; যেমন মনকে কুপ্রবণতা ও কুপ্রবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে রাখা।
প্রথম প্রকার সবর আবার দু’শ্রেণীতে বিভক্ত ।
১. নিজে কোন কঠিন কাজ কিংবা এবাদত পালন করা।
২. অপরের কঠিন প্রহার অথবা মারাত্মক যখম বরদাশত করা।প্রথম প্রকার সবর সবর শরীয়ত অনুযায়ী হলে উত্তম নতুবা নয় । কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার সবর সর্বাবস্থায় উত্তম। এ সবর যদি উৎকৃষ্ট খাদ্য ভক্ষণ ও যৌনাঙ্গের বাসনা থেকে করা হয়, তবে এর নাম হয় “ইফত” (সাধুতা)। যদি কোন বিপদাপদে এ সবর করা হয়, তবে একে সবরই বলা হয় এবং এর বিপরীত অবস্থাকে বলা হয় হা-হুতাশ করা। যদি বিত্ত-বৈভবের তাড়না সহ্য করার ক্ষেত্রে এ সবর করা হয়, তবে একে বলা হয়, “যবতে নফস” (আত্মসংযম)। এর বিপরীত অবস্থাকে বলা হয় আস্ফালন ।
যদি যুদ্ধক্ষেত্রে সবর করা হয়, তবে একে বলা হয় বীরত্ব ও শৌর্য। এর বিপরীত অবস্থাকে বলা হয় কাপুরুষতা। যদি ক্রোধ হযম ব্যাপারে সবর হয়, তবে এর নাম সহনশীলতা, যার বিপরীত হচ্ছে ক্রোধান্ধতা। যদি যামানার কোন আপদে সবর করা হয়, তবে এর নাম অসম সাহসিকতা এবং এর বিপরীত হচ্ছে স্বল্প সাহসিকতা। প্রয়োজনাতিরিক্ত জীবনোপকরণের বেলায় সবর করা হলে তার নাম সংসার নির্লিপ্ততা। এর বিপরীত সংসারাসক্তি।
সারকথা, ঈমানের অধিকাংশ গুণাবলীই সবরের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই একবার জনৈক ব্যক্তি ঈমান কি প্রশ্ন করলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : সবর। এরূপ বলার কারণ এই যে, ঈমানের কর্মসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ ও ভারী কর্ম হচ্ছে সবর। আল্লাহ তা’আলা সবরের প্রকার সমূহকে একত্রে উল্লেখ করে সবগুলোর নাম রেখেছেন সবর । এরশাদ হয়েছে-
যারা কষ্টে, দুর্ভিক্ষে এবং যুদ্ধের সময় সবর করে, তারাই সাচ্চা এবং তারাই খোদাভীরু ।
শয়তানী প্রেরণার সাথে ধর্মীয় প্রেরণার সংঘর্ষের দিক দিয়ে সবরের তিন প্রকার অবস্থা হয়ে থাকে।
( ১) শয়তানী প্রেরণাকে এমনভাবে পরাভূত করে দেয়া যাতে তার মধ্যে মোকাবিলা করার কোন ক্ষমতা অবশিষ্ট না থাকে। সার্বক্ষণিক সবর দ্বারা এই অবস্থা অর্জিত হয় । এরূপ অবস্থায়ই বলা হয় من صبر ظفر যে সবর করে সে সফলকাম হয় । খুব কম লোকই এ অবস্থায় পৌঁছতে পারে । যারা পৌঁছতে সক্ষম হয়, তারা সিদ্দীক ও নৈকট্যশীল । তাঁরা আল্লাহ তা’আলাকে নিজের পালনকর্তা জেনে তাঁর উপরই সদা প্রতিষ্ঠিত থাকেন এবং কখনও সরল পথ বর্জন করেন না।
(২) শয়তানী প্রেরণায় বিজয়ী হওয়া এবং ধর্মীয় প্রেরণার মধ্যে মোকাবিলা করার শক্তি অবশিষ্ট না থাকা। এ অবস্থায়ই মানুষ নৈরাশ্যের শিকার হয়ে সর্বপ্রকার মোজাহাদা ও চেষ্টা-চরিত্র থেকে বিরত থাকে এবং গাফেলদের তালিকা ভুক্ত হয়ে যায়।
বাস্তবে এরূপ লোকদের সংখ্যাই অধিক। এরাই রিপু ও খেয়াল-খুশীর পূজারী। এদের প্রতিই নিম্নোক্ত আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে- আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে সরল পথের দিশা দিতে পারতাম; কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এ উক্তি সত্যে পরিণত হয়েছে যে, আমি মানব ও জিন দ্বারা জাহান্নাম ভর্তি করে দেব । এরূপ লোকেরাই আখেরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে গ্রহণ করে এবং চরমভাবে মার খায়। কেউ তাদেরকে পথপ্রদর্শন করতে চাইলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ করা হয় : অর্থাৎ, তুমি সে ব্যক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যে আমার উপদেশের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে এবং পার্থিব জীবন ছাড়া অন্য কিছু কামনা করে না তাদের জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই ।
এ অবস্থার পরিচয় হচ্ছে চেষ্টা-চরিত্র থেকে নিরাশ হওয়া এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গর্বিত থাকা। এটা চরম নির্বুদ্ধিতা। রসূলে (সাঃ) এরশাদ করেন : বিজ্ঞ সে ব্যক্তি, যে নিজেকে সংযত রাখে এবং মৃত্যুপরবর্তী অবস্থার জন্যে আমল করে। আর নির্বোধ সে ব্যক্তি, যে খেয়ালখুশীর অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছে বাসনা করে ।
অর্থাৎ, কেউ তাকে উপদেশ দিলে সে বলে, আমি তওবা করার খুব ইচ্ছা রাখি; কিন্তু তা হয়ে উঠে না। তাই এর আশাও করি না। আর তওবার প্রতি আগ্রহ না থাকলে বলে, আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু। অতএব, তওবার প্রয়োজন কি?
(৩) তৃতীয় অবস্থা হল, মোকাবিলা সমান সমান হওয়া । কখনও ধর্মীয় প্রেরণা বিজয়ী হবে এবং কখনও শয়তানী প্রেরণা। এরূপ ব্যক্তি জেহাদকারীদেরই অন্তর্ভুক্ত। বিজয়ীদের মধ্যে গণ্য নয়। তার অবস্থা নিম্নোক্ত আয়াতে বিধৃত হয়েছে— অর্থাৎ, তারা একটি সৎকাজ ও অপরটি অসৎকাজ মিশ্রিত করেছে । আর যারা কামনা-বাসনার সাথে জেহাদ করে না, তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তার চেয়েও অধম। কেননা, চতুষ্পদ জন্তুর জন্যে মারেফত ও ক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়নি যা দ্বারা তারা জেহাদ করবে। কিন্তু মানুষকে ক্ষমতা দান করা হয়েছে, যা সে কাজে লাগায় না।
সহজ ও কঠিন হওয়ার দিক দিয়েও সবর দু’প্রকার।
এক, এমন সবর, যা সহজলভ্য নয়, কঠোর পরিশ্রম সাপেক্ষ। এর নাম জোরপূর্বক সবর।
দুই, যা পরিশ্রম ছাড়াই অর্জিত হয়ে যায়। মানুষ যখন সদাসর্বদা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং শুভ পরিণামের দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তখন সবর সহজলভ্য হয়ে যায় । আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন- অর্থাৎ, অতএব যে দান করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং পুণ্যকর্মকে সত্য জ্ঞান করে, আমি তাকে সহজে লক্ষ্যে পৌঁছে দেব ।
মোটকথা, দীর্ঘদিন অভ্যাসের ফলে যখন সবর সহজ হয়ে যায়,“রেযা” অর্থাৎ সন্তুষ্টির মকাম হাসিল হয়। কারণ রেযার মর্তবা সবরের ঊর্ধ্বে ।
রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর সন্তুষ্টির মাধ্যমে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে অপ্রিয় বিষয়ে সবর করার মধ্যে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এখন জানা দরকার যে, কতক সবর ফরয, কতক নফল, কতক মাকরূহ এবং কতক হারাম।
শরীয়তের নিষিদ্ধ কর্মসমূহে সবর করা ফরয। মাকরূহ বিষয়াদিতে সবর করা নফল । যে পীড়ন শরীয়তে নিষিদ্ধ তাতে সবর করা হারাম। উদাহরণতঃ এক ব্যক্তির বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে অপর এক ব্যক্তি ব্যভিচার করার সংকল্প করল । এতে তার আত্মমর্যাদাবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু সে তা প্রকাশ করার ব্যাপারে সবর করল এবং চুপচাপ দেখে গেল । বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে সবর করা সম্পূর্ণ হারাম। যে পীড়ন শরীয়তে মাকরূহ—হারাম নয়, তাতে সবর করা মাকরূহ।
মোটকথা, সবরের কষ্টিপাথর জানা দরকার । সবর ঈমানের অর্ধেক কেবল একথা জেনে মনে করা উচিত নয় যে, সকল সবরই উত্তম ।