ধোকা দেয়ার পার্থিব ও পরকালীন শাস্তি
ধোকা দেয়া বা প্রতারণা একটি জঘন্য অপরাধ যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি শুধু একজন ব্যক্তির সাথে নয়, বরং সমাজের নৈতিক ও আর্থিক ভিত্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইসলামের দৃষ্টিতে ধোকা দেয়া একটি মহাপাপ, যার শাস্তি শুধু পার্থিব জীবনে নয়, বরং পরকালেও রয়েছে। কুরআন ও হাদিসে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
ধোকা দেয়ার পার্থিব শাস্তি
১. আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া
ধোকা দেয়া ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:”নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আন-নিসা: ১০৭)
যে ব্যক্তি ধোকা দেয়, সে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়। এই অবস্থায় তার জীবনে বরকত থাকে না, এবং সে দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়।
২. মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারানো
ধোকা দেয়া ব্যক্তি তার নৈতিক অবস্থান হারায় এবং সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সহীহ মুসলিম: ১০১)
সমাজে প্রতারক ব্যক্তি একঘরে হয়ে পড়ে, এবং তার প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা আর থাকে না।
৩. পার্থিব ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া
ধোকা দিয়ে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও তা টেকসই নয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন: “আর মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।” (সূরা আল-বাকারা: ১৮৮)
অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদে বরকত থাকে না এবং তা একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তি আর্থিক ও সামাজিক সংকটে পড়ে।
ধোকা দেয়ার পরকালীন শাস্তি
১. কঠিন হিসাব ও শাস্তি
কিয়ামতের দিন প্রতারকদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। আল্লাহ বলেন: “ওয়াইলুন লিল মুতাফফিফীন” অর্থাৎ, “ধ্বংস মাপে কম দেয়া লোকদের জন্য।” (সূরা মুতাফফিফীন: ১)
যারা অন্যকে ঠকিয়ে সম্পদ লাভ করতে চায়, তারা পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে।
২. মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া
ধোকা দেয়া মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “মুনাফিকের তিনটি চিহ্ন আছে: যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন অঙ্গীকার করে, তা ভঙ্গ করে; এবং যখন তাকে আমানত দেয়া হয়, সে তাতে خیانت করে।” (সহীহ বুখারি: ৩৩)
প্রতারণাকারীকে আল্লাহ মুনাফিকদের কাতারে ফেলে দেন, যাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের সবচেয়ে নীচু স্তরের শাস্তি।
৩. জাহান্নামের শাস্তি
ধোকা দেয়া ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে জাহান্নামের অধিবাসী।” (তিরমিজি: ১৩১৫)
প্রতারণাকারীদের জন্য জাহান্নামের কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে, কারণ তারা অন্যায় করে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছে।
ধোকা দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি
ধোকা শুধু কথাবার্তায় নয়, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।
১. ব্যবসায় প্রতারণা:
পণ্যের দোষ গোপন করা, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার এক বিক্রেতার খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষা করে তাতে ভেজাল পান। তখন তিনি বলেছিলেন:”যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সহীহ মুসলিম: ১০১)
২. কথায় প্রতারণা: মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যকে ঠকানো।
৩. সম্পর্কে প্রতারণা: বিশ্বাসঘাতকতা বা নিজের সুবিধার জন্য অন্যের ক্ষতি করা।
ধোকা থেকে বাঁচার উপায়
১. আল্লাহর প্রতি তাকওয়া অর্জন
ধোকা থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হল আল্লাহর প্রতি ভয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। কুরআনে আল্লাহ বলেন: “তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।” (সূরা আত-তাওবা: ১১৯)
২. সৎ থাকা
সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা একজন মুমিনের প্রধান গুণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “সত্যবাদিতা ঈমানের পরিচয়, আর মিথ্যা কপটতার আলামত।” (তিরমিজি: ১৯৭১)
৩. তওবা করা ও সংশোধন করা
যদি কারো সাথে প্রতারণা করা হয়ে থাকে, তবে তা থেকে তওবা করা এবং যার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে তার হক আদায় করা জরুরি। আল্লাহ বলেন: “যারা তওবা করে, তাদের জন্য আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (সূরা আল-আনআম: ৫৪)
উপসংহার
ধোকা দেয়া একটি জঘন্য কাজ, যা পার্থিব জীবনে অপমান এবং পরকালে শাস্তির কারণ হয়। এটি থেকে বিরত থাকা একজন মুসলমানের ঈমানের অপরিহার্য দিক। আল্লাহ আমাদের সকলকে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার পথে চলার তাওফিক দিন এবং প্রতারণার অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স