একাধিক মাযহাবের তাকলীদে সমস্যাদি
চলমান পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট এক মাযহাবের অনুসরণ না করে একাধিক মাযহাবের দ্বারে দ্বারে ঘুরলে যে নানান সমস্যা ও বিভিন্ন ফিতনা-ফাসাদের বিরাট আশঙ্কা রয়েছে, তা লা-মাযহাবীদের স্বীকৃত ও মান্যবর উলামারাও গভীর উদ্বেগের সাথে ব্যক্ত করেছেন। তন্মধ্যে তাদের স্বীকৃত ইমাম এবং অন্যতম পুরোধা কয়েকজনের মন্তব্য নিম্নে পেশ করছি-
১. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন, লা-মাযহাবীরা দাবী করে থাকে যে, তিনিও তাদের ন্যায় লা-মাযহাবী ছিলেন। তাদের ‘এ দাবী উদ্দেশ্য প্রণোদিত হলেও তিনি যে তাদের অন্যতম পুরোধা ও মান্যবর স্বীকৃত ব্যক্তি এতে কারো দ্বিমত নেই। তাই এ বিষয়ে তার মতামত পেশ করা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করি । ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) লিখেন- “তাদের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির অনুকূলে তারা ঐ ইমামের তাকলীদ তথা অনুসরণ করে যিনি (তাদের স্বার্থ ও চাহিদা মুতাবিক) বিয়ে ভঙ্গ হয়েছে বলে ফতওয়া দেন। আবার স্বার্থের বিপরীত হলে তারাই এমন ইমামের তাকলীদ করে থাকে যিনি বিয়ে বিশুদ্ধ বলেন। প্রবৃত্তির এমন লাগামহীন গোলামী সকল ইমামের ঐক্যমতানুযায়ী হারাম ও অবৈধ।”ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২/২৪১।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) অন্যত্র কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে প্রসঙ্গটি নিম্নরূপ বিশ্লেষণ করেন- “উপরোল্লিখিত বিষয়ের উদাহরণ এই যে, প্রতিবেশী যদি জমি বিক্রয় করে এবং সেও ক্রয় করতে আগ্রহী হয়, তখন সে বলে, (ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মাযহাব মতে) শরীয়ত হক্কে শুফ্ ‘আ তথা প্রতিবেশীকে ক্রয়াগ্রাধিকার প্রদান করেছে। তাই আমি ক্রয় করার জন্য প্রস্তুত। সময়ান্তের ঐ ব্যক্তিই অপর কোন ব্যক্তির প্রতিবেশীকে উপেক্ষা করে জমি ক্রয় করতে আগ্রহী হয়, তখন সে (ইমাম শাফেঈ (রহ.)-এর মাযহাব মতে) বলে, শরীয়ত প্রতিবেশীর হক্কে শুফ্‘আ বা ক্রয়ের কোন অগ্রাধিকার দেয়নি। এমন স্বেচ্ছাচারিতা মুসলিম উম্মাহর ইজমা তথা ঐক্যমত অবৈধ।”
ইবনে তাইমিয়্যা এ ধরনের আরও একটি উদাহরণ পেশ করে লিখেছেন যে, ঐ ব্যক্তি যদি বলে, এ মাযহাবের সহজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে অবগত ছিলাম না। আমি এখন থেকে নিয়মিত এ মাযহাবেরই অনুসরণ করব তবুও তার এসব কথার প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। কেননা, এসব প্রহসনে দীন ধর্মকে খেলনায় পরিণত করার দ্বার উম্মুক্ত হবে। আর হালাল হারাম প্রবৃত্তি ও স্বেচ্ছাচারিতার উপর নির্ভরশীল ।
অনুরূপভাবে ইবনে তাইমিয়্যার আরও অনেকগুলো মূল্যবান উক্তিতে ব্যক্তি বিশেষের মাযহাব উপেক্ষা করার বিষফল সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আশা করি ইবনে তাইমিয়্যার ভক্তবৃন্দরা এগুলোর প্রতি পূর্ণবিবেচনা ও সুদৃষ্টি নিবদ্ধকরবেন। ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়্যা ২/২৪১।
২. তথাকথিত আহলে হাদীস মতবাদের অন্যতম ইমাম নওয়ার সিদ্দীক খান ভুপালী (রহ,) লিখেন- “এ যুগে একটি যশলিপ্সু রিয়াকার দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যারা নিজেদের বেলায় দাবী করে যে, তারা (নির্দিষ্ট) মাযহাব না মেনেও কুরআন-সুন্নাহর উপর সরাসরি আমল করে থাকে। মূলত তারা মোটেও ইলম আমল ও আল্লাহর পরিচয়ের ধার ধারে না। ….. অবাক কাণ্ড! কিভাবে তারা নিজেদেরকে একত্ববাদী ও নিষ্ঠাবান বলে নামকরণ করে এবং অন্যদেরকে (মাযহাব অনুসারী) মুশরিক পর্যন্ত বলতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। …. অথচ তারাই ধর্মের প্রতি চরম হঠকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী। … এসব আচরণের নাম কখনও দীন হতে পারে না। বরং এগুলো দুনিয়ার মধ্যে বড় ধরণের ফিতনা-ফাসাদ বৈ আর কিছুই নয়।আল হিত্তা ফী যিকরিস সিহাহিস সিত্তা ১৩৯, ১৪০, নবাব সিদ্দীক হাসান খান।
৩.নবাব সিদ্দীক হাসান খানের উস্তাদ এবং আহলে হাদীস নামক দলের অন্যতম আলিম মুফতী সদরুদ্দীন (রহ.) বলেন-“চার মাযহাবের কোন নির্দিষ্ট মাযহাব নির্বাচন করা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। শুধু সাধারণ লোক নয়, বরং ইজতিহাদ ও গবেষণায় অক্ষম আলিমগণের জন্যও কোন মুজতাহিদ ইমামের তাকলীদ করা ওয়াজিব। বিশেষত মাযহাব চতুষ্টয় উম্মতের সুপ্রসিদ্ধ মুজতাহিদগণের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য, সুবিন্যস্ত ও লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। সুতরাং মাযহাব চতুষ্টয়ের কোন নির্দিষ্ট একটির তাকলীদ করা জরুরী। যারা মাযহাব চতুষ্টয়ের বাস্তবতা অস্বীকার করবে অথবা বিদ’আত বা ভ্রষ্টতায় লিপ্ত হয়ে হঠকারিতা করবে, তারাই বাস্তবে বিভ্রান্তকারী হিসেবে গণ্য হবে।”তাম্মীহুদ দাল্লীন ৪৫।
৪. মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী (রহ.) ভারতবর্ষে আহলে হাদীসের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী এবং ওকীলে আহলে হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ইশায়াতুস্ সুন্নাহ পত্রিকায় তিনি লিখেন-“পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার একথা বুঝে এসেছে যে, যারা দীনের পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলম ব্যতিরেকে পরিপূর্ণ গবেষকের দাবী করে এবং তাকলীদ ছেড়ে বসে তারা শেষ পর্যন্ত ইসলামকেই বিদায় দেয়। কুফরী, ধর্মদ্রোহীতা এবং ফাসিকীর আরো অনেক কারণ যদিও পৃথিবীতে বিদ্যমান, কিন্তু ধার্মিক লোকদের অধার্মিক হয়ে যাওয়ার সর্বাপেক্ষা বড় কারণ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও তাকলীদ ছেড়ে দেয়া। আহলে হাদীসের মধ্যে যারা পর্যাপ্ত পরিমাণ ধর্মজ্ঞান রাখে না অথবা যৎসামান্য জ্ঞান রাখে এবং নিজেদের লা-মাযহাবী বলে দাবী করে তারা যেন উক্ত পরিণতির ভয় করে। আর মনে রাখে যে, উক্ত দলের সর্বসাধারণ লোকেরা স্বাধীন এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে চলছে।
মুহতারাম পাঠক! এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে যুগশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ববরেণ্য প্রথিতযশা বেশ কয়েকজন উলামায়ে কিরাম এবং লা-মাযহাবীদের অনুসরণীয় চারজন বিশিষ্ট আলিমের মতামত উল্লেখ করেছি। অনুরূপ আরো অসংখ্য যুগশ্রেষ্ঠ উলামাগণের একই মতামত যুগ যুগ ধরে নির্ভরযোগ্য বই পুস্তকে সংকলিত হয়ে আসছে। আশা করি আহলে হাদীস ভাইয়েরা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের তাকলীদ না করার লাভ-লোকসান পুনরায় খতিয়ে দেখবেন।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।