আল্লাহ তা’আলার ব্যাপারে শোকরের অর্থ
কেউ মনে করতে পারে যে, শোকর এমন ক্ষেত্রে কল্পনা করা যায়, যেখানে নেয়ামতদাতা থাকে এবং শোকর দ্বারা তার কিছু না কিছু উপকার হয়। উদাহরণতঃ আমরা বাদশাহ্দের শোকর কয়েক প্রকারের করতে পারি এবং প্রত্যেক প্রকারের মধ্যে বাদশাহ্দের কিছু না কিছু স্বার্থ হাসিল হয়।
প্রথমত, প্রশংসার মাধ্যমে শোকর করতে পারি। এতে বাদশাহ্দের উপকার এই যে, জনগণের মনে তাদের আসন মযবুত হয় এবং তাদের দানশীলতা সুখ্যাত হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, সেবা ও খেদমতের মাধ্যমে শোকর করতে পারি। এতেও তাদের কোন কোন উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়তা হয়।
**তৃতীয়ত,**চাকর-বাকরের আকৃতিতে বাদশাহদের সামনে দণ্ডায়মান হয়ে শোকর করতে পারি। এতে তাদের দল ও নামযশ বৃদ্ধি পায়।
মোটকথা, শোকরের কারণে নেয়ামতদাতার এ ধরনের কোন না কোন উপকার হয়ে থাকে । কিন্তু আল্লাহ তা’আলার ক্ষেত্রে এরূপ হওয়া দু’কারণে অসম্ভব। প্রথম কারণ এই যে, আল্লাহ তা’আলা সকল স্বার্থ ও উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তাঁর সেবাযত্ন, সাহায্য, জাঁকজমক বৃদ্ধি এবং নওকর-চাকরের আধিক্যের প্রয়োজন নেই। আমরা তাঁর সামনে রুকু-সেজদা করলে তাঁর কোন উপকার হয় না ৷ সুতরাং তাঁর জন্যে শোকরও না থাকা উচিত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, আমরা আপন এখতিয়ার দ্বারা যত কাজ করি, সেগুলোও আল্লাহ তা’আলার অন্যতম নেয়ামত। কেননা, আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শক্তি-সামর্থ, ইচ্ছা-প্রয়াস এবং নড়াচড়ার উপকরণাদি সমস্তই আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি।
সুতরাং তাঁর নেয়ামতের শোকর তাঁরই নেয়ামত দ্বারা কেমন করে হতে পারে? অতএব বুঝা গেল, উপরোক্ত দু’কারণে আল্লাহ তা’আলার জন্যে শোকর অসম্ভব। এখন এমন উপায় দরকার, যাতে এই অসম্ভাব্যতা না থাকে এবং শোকরও আদায় হয়।
এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য এই যে, হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)-ও এমনি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর দরবারে আরয করেছিলেন : ইলাহী! আমরা তোমার নেয়ামতের শোকর কিভাবে আদায় করব? কেননা, যখন শোকর করব, তখন তোমার কোন নেয়ামত দ্বারাই করব; অর্থাৎ, আমাদের শোকর তোমার অপর একটি নেয়ামত হবে, যার শোকর করা ওয়াজিব হবে। আল্লাহ তা’আলা জওয়াবে এই মর্মে ওহী পাঠালেন যে, তোমরা যখন এটা জেনে নিয়েছ, তখন আমিও ধরে নিলাম, আমার শোকর করেছ। এই ওহীর বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা এলমে মোকাশাফার উপর নির্ভরশীল। তাই আমরা এ পর্যন্তই কলম গুটিয়ে নিচ্ছি এবং এলমে মোয়াসালায় বোধগম্য একটি বিষয় উল্লেখ করছি। পয়গম্বরগণকে দুনিয়ায় প্রেরণ করার উদ্দেশ্য মানুষকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান করা। এই তাওহীদ পর্যন্ত পৌঁছার পথে রয়েছে অনেক দুরতিক্রম্য বাধা। শরীয়ত পুরাপুরিভাবে এসব বাধা অতিক্রম করার পন্থা বর্ণনা করে। এতে শোকর, শাকের ও যার শোকর করা হয়—পৃথক পৃথক মনে হয়।
বিষয়টি একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝা যাক । মনে কর, জনৈক বাদশাহ তাঁর কাছ থেকে দূরে অবস্থানকারী এক গোলামের কাছে সওয়ারী, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং পাথেয় হিসেবে নগদ টাকা-পয়সা প্রেরণ করল, যাতে সে পথের দূরত্ব অতিক্রম করে শাহী দরবারের নিকটে চলে আসে। এ নৈকট্যের সম্ভাব্য কারণ দুটি।
(১) বাদশাহের উদ্দেশ্য দরবারে এসে গেলে কিছু কিছু শাহী দায়িত্ব পালন করবে।ফলে, রাজকার্যে সুবিধা হবে।
(২) তার নিকটে আসার মধ্যে বাদশাহের কোন ফায়দা নেই এবং তাতে সাম্রাজ্যের কোন শ্রীবৃদ্ধিও হবে না। বরং এতে স্বয়ং গোলামের উপকার রয়েছে। সে বাদশাহের নৈকট্য লাভে ধন্য হতে পারে। আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি বিধান ও তাঁর নৈকট্য লাভের ব্যাপারটিকেও এই দ্বিতীয় পর্যায়ে মনে করতে হবে।
প্রথম পর্যায়ে গোলাম কেবল সওয়ারীতে সওয়ার হয়ে বাদশাহের কাছে চলে আসলেই শোকরকারী হবে না, যে পর্যন্ত বাদশাহের উদ্দিষ্ট রাজকার্যের দায়-দায়িত্ব পালন না করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে যদিও কোন উপকার বাদশাহের কাম্য নয়, তবু গোলাম শাকের (শোকরকারী) ও কাফের (অস্বীকারকারী) হতে পারে। যদি সে বাদশাহের প্রদত্ত সামগ্রী যথাযথ খাতে ব্যয় করে, তবে সে শাকের হবে; অন্যথায় কাফের।
সুতরাং সে যদি বাদশাহের পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে, তবে সে প্রভুর শোকরকারী হবে। কেননা, প্রভুর নেয়ামতকে সে তারই অভীষ্ট কাজে ব্যয় করেছে। পক্ষান্তরে যদি গোলাম বাদশাহের সওয়ারীতে সওয়ার হয়ে বাদশাহের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে বিপরীত দিকে চলে এবং দূরে চলে যায়, তবে সে নেয়ামত অস্বীকারকারী হবে। আর যদি সওয়ার না হয় এবং নিকটে অথবা দূরে না যায়, তবু সে নেয়ামতের কাফের বলে গণ্য হবে।কেননা, সে প্রভুর নেয়ামতকে অকার্যকর করে রেখেছে। এমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহর নিকটে থাকার মধ্যেই তার সৌভাগ্য নিহিত রেখেছেন। এরপর নৈকট্যের স্তর লাভের জন্যে এমন সব নেয়ামত সরবরাহ করেছেন, যেগুলো ব্যবহার করতে সে সক্ষম। কিন্তু মানুষ কামনা-বাসনার কারণে মহান দরবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষের এই দূরত্ব ও নৈকট্যকে আল্লাহ তা’আলা এভাবে বর্ণনা করেছেন : অর্থাৎ, আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে হীনতম করে দেই; কিন্তু তাদেরকে নয়,যারা ঈমানদার ও সৎকর্মপরায়ণ। তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।
এ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা’আলার নেয়ামতসমূহের মাধ্যমে মানুষ হীনতম স্তর থেকে উন্নতি করে নৈকট্যের তথা সৌভাগ্যের স্তরে পৌঁছতে পারে। এতে উপকার মানুষেরই হবে। মানুষ নৈকট্যশীল হোক,কিংবা দূরবর্তী, তাতে আল্লাহ তা’আলার কোন ফায়দা নেই ।
এখন মানুষের ইচ্ছা। সে যদি নেয়ামতকে আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করে, তবে শোকরকারী হবে। কারণ, সে প্রভুর মরযী অনুযায়ী কাজ করেছে। আর যদি নাফরমানীতে ব্যবহার করে, তবে নেয়ামতের অস্বীকারকারী হবে। কারণ, সে প্রভুর মরযীর বিরুদ্ধে কাজ করেছে। আর যদি নেয়ামতকে অকার্যকর করে রাখে এবং আনুগত্য ও নাফরমানী কোন কিছুতে ব্যবহার না করে, তবে এতেও সে নেয়ামতের অস্বীকারকারী হবে। কারণ, সে নেয়ামতকে বিনষ্ট করে।