ইসলাম

হাশরের মাঠের বিবরণ

হাশরের মাঠের বিবরণ

বিচার দিবসে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যে ময়দানে সমবেত করবেন এবং দুনিয়ায় অর্জিত সকল কৃতকর্মের হিসাব নিকাশ গ্রহণ করবেন তা কি ধরনের হতে পারে সে সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى أَرْضِ بَيْضَاءَ عَفْرَاءَ كَقُرْصَةِ النَّقِيِّ لَيْسَ فِيْهَا عَلَمُ لِأَحَدٍ

সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে সাদা ধবধবে রুটির ন্যায় যমীনের উপর একত্রিত করা হবে । তার মাঝে কারো কোন পরিচয়ের পতাকা থাকবে না। বুখারী হা/৬৫২১, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ৬/৫১ পৃঃ; মুসলিম হা/২৭৯০; মিশকাত হা/৫৫৩২।

হাশরের মাঠে জাহান্নামীদের যেভাবে সমবেত করা হবে

আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দার দুনিয়াবী জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের হিসাব-নিকাশের সেই বিভিষিকাময় কঠিন দিনে হাশরের ময়দানে সকলকে অন্ধ, মুক, বধির ও বস্ত্রহীন উলঙ্গ অবস্থায় সমবেত করবেন । আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنْ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى – قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا – قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيْتَهَا وَكَذَلكَ الْيَوْمَ تُنْسَى –

‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা হবে সংকীর্ণ এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। অনুরূপভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে’ (সূরা ত্বহা ২০/১২৪-১২৬)।

তিনি অন্যত্র বলেন, وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمَّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا حَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا –

‘আমি ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা, অন্ধ, বোবা ও বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম । যখনই তা নিস্তেজ হবে তখনই আমি তাদের জন্য আগুন বৃদ্ধি করে দিব’ (সূরা ইসরা ১৭/৯৭)।

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا نَبِيَّ اللَّهِ كَيْفَ يُحْشَرُ الْكَافِرُ عَلَى وَجْهِهِ قَالَ أَلَيْسَ الَّذِي أَمْشَاهُ عَلَى الرِّجْلَيْنِ فِي الدُّنْيَا قَادِرًا عَلَى أَنْ يُمْشِيَهُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، قَالَ قَتَادَةُ بَلَى وَعِزَّةِ رَبِّنَا –

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কাফিরদেরকে হাশরের মাঠে মুখের মাধ্যমে হাঁটিয়ে উপস্থিত করা হবে) তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! মুখের ভরে কাফিরদেরকে কিভাবে হাশরের ময়দানে উঠানো হবে? তিনি বললেন, দুনিয়াতে যে সত্তা দু’পায়ের উপর হাঁটান, তিনি কি ক্বিয়ামতের দিন মুখের ভরে হাঁটাতে পারবেন না? তখন কাতাদাহ (রাঃ) বললেন, আমাদের প্রতিপালকের ইয্যতের কসম! অবশ্যই পারবেন।(বুখারী , হাদিস ৬৫২৩, মুসলিম, হাদীস, ২৮০৬,মিশকাত,হাদীস ৫৫৩৭)

অন্য হাদীছে এসেছে, و عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تُحْشَرُوْنَ حُفَاةً عُرَاةٌ غُرُلاً قَالَتْ عَائِشَةُ، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ فَقَالَ الأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يُهِمَّهُمْ ذَاكِ –

হাশরের মাঠে উঠানো হবে শূন্য পা, উলঙ্গ দেহ এবং খানা বিহীন অবস্থায়। তাহলে পুরুষ ও নারীগণ একে অপরের দিকে তাকাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আয়েশা! এরকম ইচ্ছে করার চেয়ে তখনকার অবস্থা হবে অতীব সংকটময় । (কাজেই কি করে একে অপরের দিকে তাকাবে) (বুখারী, হাদীস,৬৫২৭)

হাশরের দিন সূর্যের অবস্থান ও মানুষের অবস্থা

পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। চৈত্র মাসে দিনের মধ্যভাগে এতো দূরে অবস্থিত সূর্যের নিচে মানুষের অবস্থান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ যেদিন সূর্য অবস্থান করবে মানুষের মাথার মাত্র এক মাইল উপরে তখন মানুষের অবস্থা কি হতে পারে তার কিছু চিত্র হাদীছে বর্ণিত।

الْمِقْدَادِ بْن الأَسْوَدِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ عَنِ تُدنَى الشَّمْسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الْخَلْقِ حَتَّى تَكُونَ مِنْهُمْ كَمِقْدَارٍ مِيْل قَالَ سُلَيْمُ بْنُ عَامِرٍ فَوَاللَّهِ مَا أَدْرِي مَا يَعْنِي بِالْمِيْلِ أَمَسَافَةَ الْأَرْضِ أَمِ الْمِيلَ الَّذِي تُكْتَحَلُ بِهِ الْعَيْنُ، قَالَ فَيَكُوْنُ النَّاسُ عَلَى قَدْرِ أَعْمَالِهِمْ فِي الْعَرَقِ فَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى كَعْبَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُوْنُ إِلَى حَفْوَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يُلْحِمُهُ الْعَرَقُ الْجَامًا قَالَ وَأَشَارَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ إِلَى فِيْهِ

মেকদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন সূর্যকে মানুষের এত নিকটে আনা হবে যে, মানুষ ও সূর্যের মধ্যে কেবল এক মাইলের ব্যবধান থাকবে। মুসলিম ইবনু আমর বলেন, ‘মাইল’ বলতে রাস্তার দূরত্ব, না যে কাঠির দ্বারা চোখে সুরমা লাগানো হয় তাকে বুঝানো হয়েছে আমি জানি না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, মানুষ সেদিন নিজ নিজ আমল অনুপাতে ঘামে থাকবে। তাদের মধ্যে কারো ঘাম হবে তার টাখনু পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো মুখ পর্যন্ত পৌঁছবে । মুসলিম,হাদীস,২৮৬৪

অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضی الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ الله صلى الله عليه وسلم قَالَ يَعْرَفُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَذْهَبَ عَرَقُهُمْ فِي الْأَرْضِ سَبْعِينَ ذِرَاعًا، وَيُلْحِمُهُمْ حَتَّى يَبْلُغَ آذَانَهُمْ

কিয়ামতের দিন এমনভাবে ঘামবে যে, তাদের ঘাম মাটিতে সত্তর গজ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে এবং তাদের ঘাম তাদের কান বরাবর পৌঁছে গিয়ে লাগাম পরিয়ে দিবে। বুখারী,হাদীস,৬৫৩২,মুসলিম,২৮৬৩

হাশরের মাঠে আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না

হাশরের মাঠে যখন মানুষের মাথার অতি সন্নিকটে সূর্য অবস্থান করবে, তখন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। আর সে ছায়ায় আল্লাহ্নি র্ধারিত বান্দারাই কেবল স্থান পাবে।

হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ يَقُوْلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّوْنَ بِجَلَالِي الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلا ظِلِّي

ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, আমার আনুগত্যের জন্য আপসে বন্ধুত্ব স্থাপনকারীরা আজ কোথায়? তাদেরকে আজ আমি নিজ ছায়া প্রদান করব যেদিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। মুসলিম,হাদিস,২৫৬৬

অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ سَبْعَةٌ يُظلُّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقَ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابًا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصب وَجَمَال فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَحْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ حَاليًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ –

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে নিজ ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। (১) ন্যায়-নিষ্ঠাবান নেতা (২) আল্লাহ্র ইবাদতে গড়ে উঠা যুবক (৩) ঐ ব্যক্তি যার অন্তর সব সময় মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে (তার মন সর্বদা মসজিদে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে) (৪) এমন দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিচিত্তে একে অপরকে ভালবাসে, তার উপরেই একত্রিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয় (৫) এমন ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দরী, মর্যাদাবতী সম্ভ্রান্তা নারী (ব্যভিচার) এর জন্য আহবান করলে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি (৬) যে ব্যক্তি এমনভাবে গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা দান করে তার বাম হাত তা জানতে পারে না (গোপনে দান করে) এবং (৭) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয় ৷ বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

অন্য হাদীছে এসেছে,

هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ لَهُ أَظَلَّهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَحْتَ ظِلٍّ عَرْشِهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ –

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো কষ্টকে লাঘব করবে (ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণকে হালকা করবে অথবা মিটিয়ে দিবে) আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না ।”মুসলিম হা/৩০০৬; তিরমিযী হা/১৩০৬; মিশকাত হা/২৯০৩।

অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِر قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ كُلُّ امْرِئ في ظلِّ صَدَقَتِهِ حَتَّى يُفْصَلَ بَيْنَ النَّاسِ.

উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, (ক্বিয়ামতের দিন) মানুষের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ ছাদাক্বা (দানের) ছায়াতলে অবস্থান করবে। মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৩৭১; সিলসিলা ছহীহা হা/৩৪৮৪।

সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে

হাশরের ময়দানে যেদিন আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দার হিসাব গ্রহণ করবেন সেদিন জাহান্নামকে উস্থিত করা হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكَّا دَكَّا وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا وَحِيْءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى – يَقُوْلُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي –

ইহা সংগত নয়, পৃথিবীকে যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে এবং যখন তোমার প্রতিপালক উপস্থিত হবেন ও সারিবদ্ধভাবে ফেরেশ্তাগণও উপস্থিত হবেন। আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে এবং সেদিন মানুষ উপলব্ধি করবে, তখন এই উপলব্ধি তার কি কাজে আসবে? সে বলবে, হায়! যদি আমি আমার এ জীবনের জন্যে অগ্রিম কিছু পাঠাতাম!’ (সূরা ফাজর ৮৯/২১-২৪)।

হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُؤْتَى بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لَهَا سَبْعُونَ أَلْفَ زِمَامٍ مَعَ كُلِّ زِمَامٍ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكِ يَجُرُّونَهَا –

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। যার সত্তর হাজার লাগাম থাকবে, প্রতিটি লাগামে সত্তর হাজার করে ফেরেশ্তা তাকে টানতে থাকবে’। মুসলিম হা/২৮৪২; মিশকাত হা/৫৬৬৬ ৷

সেদিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হিসাব গ্রহণ করবেন

আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন ভাল ও মন্দ কর্মের প্রতিফল। নির্ধারণ করেছেন ভাল কর্মের প্রতিদান স্বরূপ জান্নাত ও মন্দ কর্মের প্রতিদান স্বরূপ জাহান্নাম। অতঃপর সে দুনিয়াতে কি ধরণের কাজ সম্পাদন করেছে, তার জন্য কিয়ামতের দিন হিসাবের ব্যাবস্থা রেখেছেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ –

‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় ঘনিয়ে এসেছে, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে’ (সূরা আম্বিয়া ২১/১)।

তিনি অন্যত্র বলেন, إِنَّ إِلَيْنَا إِيَابَهُمْ ۖ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ

‘নিশ্চয়ই আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমরই দায়িত্বে’ (সূরা গাশিয়া ৮৮/২৫-২৬)।

তিনি অন্যত্র বলেন, فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِيْنَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِيْنَ – فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ

‘সুতরাং আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব যাদের নিকট রাসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং অবশ্যই আমি প্রেরিতদেরকে (রাসূলগণকে) জিজ্ঞেস করব। অতঃপর অবশ্যই আমি স্বজ্ঞানে তাদের নিকট অবস্থা বর্ণনা করব। বস্তুতঃ আমি অনুপস্থিত ছিলাম না’ (সূরা আ’রাফ ৭/৬-৭)।

তিনি অন্যত্র বলেন, كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ وَتَذَرُوْنَ الْآخِرَةَ – وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ – وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ بَاسِرَةٌ تَظُنُّ أَنْ يُفْعَلَ بِهَا فَاقِرَةٌ –

কখনও না, বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে ভালবাস এবং পরকালকে উপেক্ষা কর। সেদিন কতক মুখমণ্ডল হবে হাস্য উজ্জ্বল। তারা তাদের প্রতিপালকের পানে তাকিয়ে থাকবে । আর সেদিন অনেক মুখমন্ডল হবে বিবর্ণ-বিষণ্ন। তারা ধারণা করবে যে, এক ধ্বংসকারী বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে’ (সূরা কিয়ামাহ ৭৫/২০-২৫)।

হাদীছে এসেছে, عَنْ جَرِيرِ بْن عَبْدِ اللهِ قَالَ كُنَّا جُلُوساً عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ فَقَالَ لَنَا أَمَا إِنَّكُمْ سَتُعْرَضُوْنَ عَلَى رَبِّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ فَتَرَوْنَهُ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ –

জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বসে ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রতে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে বললেন, সাবধান! তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের সামনে (হিসাব দেওয়ার জন্য) পেশ করা হবে। অতঃপর তোমরা তাঁকে (আল্লাহ) প্রত্যক্ষ করবে যেমন এই চন্দ্রকে প্রত্যক্ষ করছ। মুসলিম হা/৬৩৩; তিরমিযী হা/২৫৫১।

সেদিন সর্বপ্রথম উম্মতে মুহাম্মাদীর হিসাব নেওয়া হবে

আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ও তাঁর অনুসারীদেরকে ক্বিয়ামতের দিন সম্মানিত করবেন। যদিও তারা সর্বশেষ উম্মত তবুও আল্লাহ তাদেরকে সর্বপ্রথম একত্রিত করবেন, সর্বপ্রথম হিসাব গ্রহণ করবেন এবং সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ هريرة رضى الله عنه أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ الله صلى الله عليه وسلم يَقُولُ نَحْنُ الآخِرُوْنَ السَّابِقُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، بَيْدَ أَنَّهُمْ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِنَا، ثُمَّ هَذَا يَوْمُهُمُ الَّذِى فُرِضَ عَلَيْهِمْ فَاخْتَلَفُوا فِيهِ، فَهَدَانَا اللَّهُ ، فَالنَّاسُ لَنَا فِيْهِ تَبَع، الْيَهُودُ غَدًا وَالنَّصَارَى بَعْدَ غَد-

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, আমরা দুনিয়ায় (আগমনের দিক থকে) সর্বশেষ। কিন্তু কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে আমরা সবার পূর্বে। ব্যতিক্রম এই যে, আমাদের পূর্বে তাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর যেদিন তাদের উপর ইবাদত ফরয করা হয়েছিল, সেদিন তারা এ বিষয়ে মতানৈক্য করেছে। কিন্তু সে বিষয়ে আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারে লোকেরা আমাদের পশ্চাদবর্তী। ইহুদীদের (সম্মানীয় দিন হচ্ছে) আগামী কাল (শনিবার) এবং খ্রিষ্টানদের (সম্মানীয় দিন হচ্ছে) আগামী পরশু (রবিবার)। বুখারী হা/৮৭৬, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/৪০৬ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৫৫; মিশকাত হা/১৩৫৪৷

অন্য হাদীছে এসেছে, أَبِي هُرَيْرَةَ وَعَنْ حُذَيْفَةَ قَالَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم… نَحْنُ الآخِرُونَ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا وَالأَوَّلُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمَقْضِيُّ لَهُمْ قَبْلَ الْخَلَائِقِ –

আবু হুরায়রাহ ও হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমরা দুনিয়ায় (আগমনের দিক থকে) সর্বশেষ। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে আমরা সবার পূর্বে। সবার পূর্বে আমাদের হিসাব নেওয়া হবে’৷ মুসলিম হা/৮৫৬; মিশকাত হা/১৩৫৫।

অন্য হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسِ أَنَّ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ نَحْنُ آخِرُ الأُمَمِ وَأَوَّلُ مَنْ يُحَاسَبُ يُقَالُ أَيْنَ الأُمَّةُ الأُمِّيَّةُ وَنَبيُّهَا فَنَحْنُ الْآخِرُوْنَ الْأَوَّلُوْنَ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমরা দুনিয়ার সর্বশেষ জাতি। কিয়ামতের দিন আমাদের সর্বাগ্রে হিসাব নেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে, উম্মী উম্মত ও তার নবী আজ কোথায়? বস্তুত আমরা সর্বশেষ জাতি এবং হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম। (ইবনু মাজাহ হা/৪২৯০; সিলসিলা ছহীহা হা/২৩৭৪ )

সেদিন পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে

কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর বান্দাদেরকে সমবেত করবেন তখন তাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কেউ তাদের পদদ্বয় নড়াতে পারবে না।

হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فيْمَا أَبْلَاهُ وَمَاله مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ –

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন পাঁচটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পূর্বে আদম সন্তানের পদদ্বয় তার রবের নিকট থেকে সরাতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হবে তার বয়স সম্পর্কে, সে কিভাবে তা অতিবাহিত করেছে? জিজ্ঞেস করা হবে তার যৌবনকাল সম্পর্কে, সে কিভাবে তা খরচ করেছে? জিজ্ঞেস করা হবে তার সম্পদ সম্পর্কে, কিভাবে তা উপার্জন করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে? এবং জিজ্ঞেস করা হবে, তার অর্জিত ইলম অনুযায়ী আমল করেছে কি না? তিরমিযী হা/২৪১৬; মিশকাত হা/৫১৯৭; সিলসিলা ছহীহা হা/৯৪৬।

দুনিয়াতে যারা আল্লাহুকে ভুলে থাকবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে ভুলে যাবেন

বান্দা যত বেশী আল্লাহকে স্মরণ করবে, আল্লাহ তার চেয়েও বেশী তাঁর বান্দাকে স্মরণ করবেন। কিন্তু বান্দা যদি আল্লাহকে ভুলে যায় তাহলে আল্লাহ তা‘আলাও বান্দাকে ভুলে যাবেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنْ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى – قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا – قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيْتَهَا সوَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى –

‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা হবে সংকীর্ণ এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। অনুরূপভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে’ (সূরা ত্বহা ২০/১২৪-১২৬)।

হাদীছে এসেছে,

أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالُوا يَا رَسُوْلَ اللهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ هَلْ تُضَارُّونَ رُؤْيَةِ الشَّمْسِ فِي الظَّهِيْرَةِ لَيْسَتْ فِي سَحَابَة قَالُوْا لَا، قَالَ فَهَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ لَيْسَ فِي سَحَابَةٍ قَالُوا لاَ، قَالَ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ رَبِّكُمْ إِلا كَمَا تُضَارُّوْنَ فِي رُؤْيَةِ أَحَدِهِمَا قَالَ فَيَلْقَى الْعَبْدَ فَيَقُولُ أَنْ قُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ وَأُسَوِّدُكَ وَأَزَوِّحْكَ وَأُسَخَّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالإِبِلَ وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ فَيَقُولُ بَلَى، قَالَ فَيَقُولُ أَفَظَنَنْتَ أَنَّكَ مُلَاقِي فَيَقُولُ لَا، فَيَقُولُ فَإِنِّي أَنْسَاكَ كَمَا نَسِيتَنِي ثُمَّ يَلْقَى الثَّانِيَ فَيَقُولُ أَنْ قُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ وَأُسَوِّدْكَ وَأَزَوِّجُكَ وَأَسَخَّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالإِبِلَ وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ فَيَقُولُ بَلَى أَيْ رَبِّ، فَيَقُولُ أَفَظَنَنْتَ أَنَّكَ مُلَاقِي فَيَقُولُ لاَ، فَيَقُولُ فَإِنِّي أَنْسَاكَ كَمَا نَسِيتَنِي، ثُمَّ يَلْقَى الثَّالِثَ فَيَقُولُ لَهُ مِثْلَ ذَلِكَ فَيَقُولُ يَا رَبِّ آمَنْتُ بِكَ وَبِكِتَابِكَ وَبِرُسُلِكَ وَصَلَّيْتُ وَصُمْتُ وَتَصَدَّقْتُ وَيُثْنِي بِخَيْرٍ مَا اسْتَطَاعَ فَيَقُولُ هَا هُنَا إِذًا قَالَ ثُمَّ يُقَالُ لَهُ الآنَ نَبْعَثُ شَاهِدَنَا عَلَيْكَ وَيَتَفَكَّرُ فِي نَفْسِهِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْهَدُ عَلَى فَيُحْتَمُ عَلَى فيه وَيُقَالُ لِفَخِذه وَلَحْمهِ وَعِظَامه الطقى فَتَنْطِقُ فَخِذُهُ وَلَحْمُهُ وَعِظَامُهُ بِعَمَلِه وَذَلِكَ لِيُعْذِرَ مِنْ نَفْسِهِ وَذَلِكَ الْمُنَافِقُ وَذَلكَ الَّذِي يَسْخَطُ اللَّهُ عَلَيْهِ –

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ছাহাবায়ে কেরাম একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, মেঘ বিহীন স্বচ্ছ আকাশে দুপুর বেলায় সূর্য দেখতে তোমাদের কোন বিহীন স্বচ্ছ আকাশে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয় কি? তাঁরা বললেন, না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না ঐ অসুবিধা ছাড়া যে অসুবিধা চন্দ্র-সূর্যের কিরণের জন্য হয়ে থাকে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, অতঃপর আল্লাহ বান্দার সাথে সাক্ষাত করবেন এবং বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি? নেতা বা দায়িত্বশীল বানাইনি? জীবন সঙ্গীনী দেইনি? ঘোড়া-উঠের মত সম্পদের মালিক বানাইনি? যা দ্বারা তুমি নেতৃত্ব দিয়েছ এবং বিলাসিতা করেছ? সে সামনে তোমাকে উপস্থিত হতে হবে এটা কি তুমি বিশ্বাস করতে? সে বলবে, না। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি যেমন আমাকে ভুলে গিয়েছিলে, আজকে আমিও তেমন তোমাকে ভুলে যাব। অতঃপর আল্লাহ অন্য এক বান্দার সাথে সাক্ষাত করবেন এবং বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি? নেতা বা দায়িত্বশীল বানাইনি? জীবন সঙ্গীনী দেইনি? ঘোড়া-উঠের মত সম্পদের মালিক বানাইনি? যা দ্বারা তুমি নেতৃত্ব দিয়েছ এবং বিলাসিতা করবেন, আমার সামনে তোমাকে উপস্থিত হতে হবে এটা কি তুমি বিশ্বাস করতে? সে বলবে, না। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি যেমন আমাকে ভুলে গিয়েছিলে, আজকে আমিও তেমন তোমাকে ভুলে যাব। অতঃপর আল্লাহ তৃতীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করবেন এবং উক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের ন্যায় (ভোগ সামগ্রীর) কথা স্মরণ করাবেন। উত্তরে বান্দা বলবে, হে আমার রব! আমিআপনার রাসূলগণ, কিতাব ও আপনার প্রতি ঈমান আনায়ন করেছি। ছালাত আদায় করেছি, ছিয়াম পালন করেছি, দান করেছি। এভাবে সাধ্যমত ভাল কাজের কথা উল্লেখ করবে। তখন তাকে বলা হবে, তোমার এ কথা কতদূর সত্য তা এখানে প্রমাণিত হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর সেই বান্দাকে বলা হবে যে, এখনি তোমার সাক্ষীদাতাকে আনা হবে। সে তখন মনে মনে ভাববে, আমার সাক্ষী আবার কে দিবে? তারপর তার মুখে মহর মেরে দেওয়া হবে এবং তার রান, গোশত এবং হাড়কে কথা বলতে আদেশ করা হবে।

তখন তার রান, গোশত এবং হাড় তার সকল কর্মকাণ্ড ব্যক্ত করবে। এরূপ করা হবে তাকে পরাস্ত ও মিথ্যুক প্রমাণ করার জন্য । এই সেই মুনাফিক, যার উপর আল্লাহ অসুন্তষ্ট। (মুসলিম হা/২৯৬৮; মিশকাত হা/৫৫৫৫)

যাদের পাপের পাল্লা ভারী হবে তারা জাহান্নামের অধিবাসি

আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি-বিধান অহি মারফত পাঠিয়ে দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন ভাল ও মন্দ দু’টি পথ। জানিয়ে দিয়েছেন ভাল ও মন্দ কর্মের প্রতিদান। অতঃপর যখন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের কৃতকর্মকে ওজন করবেন। ভাল কর্মকে এক পাল্লায় এবং মন্দ কর্মকে অপর পাল্লায় রাখবেন। যাদের নেকীর পাল্লা ভারী হবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যাদের পাপের পাল্লা ভারী হবে তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, الْقَارِعَةُ مَا الْقَارِعَةُ وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ يَوْمَ يَكُوْنُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوث – وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ – فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ وَأَمَّا مَنْ حَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ. وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ نَارٌ حَامِيَةٌ.

‘মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কি? মহাপ্রলয় সম্বন্ধে তুমি কি জান? সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতংগের মত এবং পর্বত সমূহ হবে ধূনিত রঙ্গিন পশমের মত ৷ তখন যার (নেকীর) পাল্লা ভারী হবে, সে তো লাভ করবে সন্তোষজনক জীবন । কিন্তু যার (নেকীর) পাল্লা হালকা হবে তার স্থান হবে ‘হাবিয়া’। তুমি কি জান উহা কি? উহা তো উত্তপ্ত অগ্নি’ (সূরা কারি’আহ ১০১/১-১১)।

তিনি অন্যত্র বলেন,

فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَلَا أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُوْنَ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ – وَمَنْ حَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ – تَلْفَحُ وُجُوْهَهُمُ النَّارُ وَهُمْ فِيهَا كَالِحُوْنَ –

যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে সেদিন পরষ্পরের মধ্যে আত্নীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরের খোঁজ-খবর নিবে না। যাদের (নেকীর ) পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের (নেকীর) পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতি করেছে; তারা জাহান্নামে স্থায়ী বসবাস করবে। অগ্নি তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা সেখানে থাকবে বীভৎস চেহারায়’ (সূরা মুমিনূন ২৩/১০১-১০৪)। তিনি অন্যত্র বলেন,

وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ وَمَنْ حَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَظْلِمُوْنَ –

‘সেদিনের ওজন করা সত্য। যাদের (নেকীর) পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের (নেকীর) পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, যেহেতু তারা আমার নিদর্শন সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছে’ (সূরা আরাফ,৭/৮,৯

যাদের নেকী ও পাপের পাল্লা সমান হবে তাদের অবস্থান

আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন যখন তাঁর বান্দাদের নেকী ও পাপ ওজন করবেন তখন কিছু সংখ্যক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, যাদের নেকী ও পাপের পাল্লা সমান হবে। অবস্থা এমন হবে যে, তাদের নেকী তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশে বাধা দিবে এবং তাদের পাপ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশে বাধা দিবে। তখন তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে ‘আ‘রাফ’ নামক স্থানে অবস্থান করবে। যেখানে তারা জান্নাতের সুখ ভোগ করবে না এবং জাহান্নামের শাস্তিও ভোগ করবে না ।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَنَادَى أَصْحَابُ الْجَنَّةِ أَصْحَابَ النَّارِ أَنْ قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدْتُمْ مَا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا قَالُوْا نَعَمْ فَأَذْنَ مُوَذِّنٌ بَيْنَهُمْ أَنْ لَعْنَةُ الله عَلَى الظَّالِمِيْنَ الَّذِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآخِرَةِ كَافِرُوْنَ – وَبَيْنَهُمَا حِجَابٌ وَعَلَى الْأَعْرَافِ رِجَالٌ يَعْرِفُوْنَ كُلًّا بِسِيْمَاهُمْ وَنَادَوْا أَصْحَابَ الْجَنَّةِ أَنْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَمْ يَدْخُلُوْهَا وَهُمْ يَطْمَعُوْنَ – وَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَارُهُمْ تِلْقَاءَ أَصْحَابِ النَّارِ قَالُوْا رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ وَنَادَى أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ رِجَالاً يَعْرِفُونَهُمْ بِسِيمَاهُمْ قَالُوا مَا أَغْنَى عَنْكُمْ جَمْعُكُمْ وَمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُوْنَ – أَهَؤُلاَءِ الَّذِيْنَ أَقْسَمْتُمْ لاَ يَنَالُهُمُ اللَّهُ بِرَحْمَةِ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ –

‘জান্নাতবাসীগণ জাহান্নামবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তোমরা তা সত্য পেয়েছ কি? তারা বলবে, হাঁ। অতঃপর জনৈক ঘোষণাকারী তাদের মধ্যে ঘোষণা করবে, আল্লাহ্ লা’নত যালেমদের উপর যারা আল্লাহ্রা স্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত এবং উহাতে বক্রতা অনুসন্ধান করত; তারাই পরকাল সম্বন্ধে অবিশ্বাসী। উভয়ের (জান্নাত ও জাহান্নাম) মধ্যে পর্দা আছে এবং আ‘রাফে কিছু লোক থাকবে যারা প্রত্যেককে তার লক্ষণ দ্বারা চিনবে এবং জান্নাতবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, তোমাদের শান্তি হোক। তারা কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করেনি, কিন্তু আকাঙ্খা করে। যখন তাদের দৃষ্টি জাহান্নামবাসীদের প্রতি ফিরিয়ে দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে যালেমদের সংগী কর না। আ‘রাফবাসীগণ যে লোকদেরকে লক্ষণ দ্বারা চিনবে তাদেরকে সম্বোধন করে বলবে, তোমাদের দল ও তোমাদের অহংকার কোন কাজে আসল না। ইহারাই কি তারা যাদের সম্বন্ধে তোমরা শপথ করে বলতে যে, আল্লাহ এদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন না। এদেরকেই বলা হবে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর, তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না’ (সূরা আ’রাফ ৭/৪৪-৪৯)।

তিনি অন্যত্র বলেন, يَوْمَ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انْظُرُونَا نَقْتَبِس مِنْ نُوْرِكُمْ قِيْلَ ارْجِعُوْا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُوْرًا فَضْرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُوْرٍ لَهُ بَاب بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُ

‘সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা মুমিনদেরকে বলবে, তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের আলোর কিছু গ্রহণ করতে পারি। তখন বলা হবে, তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাও এবং আলোর অনুসন্ধান কর। অতঃপর উভয়ের মাঝে স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, উহার ভেতরে থাকবে রহমত এবং বাহিরে থাকবে শাস্তি’ (সূরা হাদীদ ৫৭/১৩)।

হাদীছে এসেছে, عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ أَنَّهُ قَالَ أَصْحَابُ الْأَعْرَافِ قَوْمٌ تَجَاوَزَتْ بِهِمْ حَسَنَاتُهُمُ النَّارَ ، وَقَصُرَتْ بهِمْ سَيِّئَاتُهُمْ عَنِ الْجَنَّةِ، فَإِذَا صُرِفَتْ أَبْصَارُهُمْ تِلْقَاءَ أَصْحَابِ النَّارِ قَالُوا رَبَّنَا لاَ تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ طَلَعَ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ فَقَالَ لَهُمْ قَوْمُوْا فَادْخُلُوا الْجَنَّةَ فَإِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ –

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আ’রাফবাসীরা এমন কিছু লোক, যাদের নেকী তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছে । আর তাদের পাপ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করা হতে আটকিয়ে দিয়েছে (সে জন্য তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে ‘আ‘রাফ’ নামক স্থানে আটকা পড়েছে)। তাদের দৃষ্টি যখন জাহান্নামীদের উপর পড়বে তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এরূপ যালেমদের সঙ্গী কর না। তাদের আ’রাফে অবস্থান করা অবস্থায় তোমার প্রতিপালক বলবেন, হে আ’রাফবাসী! তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি । মুস্তাদরাক হাকেম হা/৩২৪৭; আরনাউত, সনদ ছহীহ।

তথ্যসূত্র:

জাহান্নামের ভয়াভহ আযাব

শরীফুল ইসলাম বিন জয়নাল আবেদীন

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *