ইসলাম

ইজমার আলোকে তাকলীদ

শরীয়তের চার প্রকার দলীল হতে তৃতীয় প্রকার দলীল হল ইজমা। الاحْمَاعُ فِي اللغَةِ العَزْمُ عَلى النبي والاتفاق عَلَيْهِ . وَ فِي الشَّرْعِ إنْفَاقُ الْمُحْتَهِدِينَ مِنْ أُمَّةٍ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِى عَصْرٍ عَلى أَمْرٍ دِيْنِي. وَ أَيْضاً الْعَزْمُ التَّامَ عَلَى أَمْرٍ مِنْ جَمَاعَةِ أَهْلِ الْعَقْدِ وَالْحَلُّ.

“ইজমার শাব্দিক অর্থ হল, কোন বিষয়ে চুড়ান্ত ইচ্ছা করা এবং কোন বিষয়ের উপর একমত হওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় ইজমা বলা হয়, কোন দীনী বিষয়ের ইপর উম্মতে মুহাম্মাদীর মুজতাহিদীনে কেরামের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অথবা যারা যুগ সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম কোন বিষয়ে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।”কিতাবুল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ১/৩৯৭, আল ফিকরুস সামী ১/১২৩, মু’জামুল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ৩৯ ।

দলীলের চারটি উৎসের মধ্যে ইজমা’ও একটি দলীল। যার স্থান কুরআন ও হাদীসের পরই।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَائَتْ مَصِيراً .

“যে কেউ রাসূলের (সা.)-এর বিরোধিতা করে তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সকল মুসলমানের অনুসৃত পথের বিপরীত দিকে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফিরাবো, যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান।”নিসা ১১৫।

বর্ণিত আয়াতটি ইজমার বিপরীত চলা যে হারাম এর স্বপক্ষে একটি দলীল। কেননা, রাসূলের (সা.) বিরোধিতা করা এবং মুসলমানের অনুসৃত পথের বিপরীত পথে চলাকে আল্লাহ তা’আলা শাস্তিযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। এখানে শুধু রাসূলের (সা.) বিরোধিতাই শাস্তির কারণ একথা বলার সুযোগ নেই। তাহলে ‘মুসলমানদের বিপরীত পথে চলা’ কথাটির উল্লেখ অনর্থক হয়ে যায়। উল্লিখিত উভয় কারণ একত্রে পাওয়া গেলেই যে কেবল শাস্তিযোগ্য হবে এমনটি বলা যায় না। বরং দুটি কারণের মাঝে যে কোন একটি পাওয়া গেলেই সে শাস্তিযোগ্য বলে ধরা হবে। অর্থাৎ উভয়টি স্বতন্ত্রভাবে হারাম।

তাহলে প্রতীয়মান হয়, মুসলমানদের পথ ছেড়ে অন্য পথে চলা হারাম এবং তাঁদের অনুসৃত পথ অবলম্বন করা ওয়াজিব। কেননা, মানুষ স্বভাবত: যে কোন একটি পথ গ্রহণ করবে। বায়হাকী ও তিরমিযী (রহ.) একটি রেওয়ায়াতে ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেন, রাসূল (সা.) বলেন, إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي عَلَى ضَلَالَةٍ وَبَدُ اللَّهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَ مَنْ شَلَّ شَدَّ فِي النَّارِ.

“আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কখনো কোন ভ্রান্তির উপর অবিচল করবেন না। দলবদ্ধতার ওপর আল্লাহর রহমত প্রসারিত হয়। যে একাকী ভিন্ন পথে চলে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”তিরমিযী ৪/৪০৫, হাদীস নং ২১৬৭, হাকিম ১/১১৬, বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে ১৭ জন সাহাবী থেকে হাদীসটা বর্ণিত আছে।

আল্লামা আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আনসারী আল কুরতুবী (রহ.) লিখেছেন, قَالَ الْعُلَمَاءُ فِي قَوْلِهِ وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ دَلِيْلَ عَلَى صِحَّةِ الْقَوْلِ بالإجماع. “আলিমদের অভিমত হলো, আয়াতটি ইজমার বিশুদ্ধতার প্রমাণ বহন করে।”আল জামি লি আহকামিল কুরআন ৩/৩৩৫, মুদ্রণ: দারুল হাদীস, আল কাহিরা, মিশর ।

বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে হযরত জাবির (রাযি.) সহ তের জন প্রসিদ্ধ সাহাবী থেকে সমর্থবোধক শব্দে বর্ণিত হয়েছে। নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন-

لا تزال طائفة من امتي يقاتلون علي الحق ظاهرين الي يوم القيامة.

“আমার উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত হকের উপর বিজয়ী অবস্থায় লড়বে।বুখারী শরীফ ৮/৫০১, হাদীস নং ৭৩১১, মুসলিম ১/১৩৭, হাদীস নং ১৫৬ এবং ৩/১৫২৩ হাদীস নং ১৯২০।

এ হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের একটি দল সব সময় সত্যের উপর থাকবে। অর্থাৎ, কখনো মিথ্যা বা ভুলের উপর মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةً شِبراً فمَاتَ فمِيتَةً جاهلية. “যে মুসলমানদের জামা’আতে ফাটল সৃষ্টি করে সে ধর্মহীন জাহেলী অবস্থায় মারা যাবে।”মুসলিম ৩/১৪৭৭, হাদীস নং ১৮৪৯, বুখারী ৮/৪২২, হাদীস নং ৭০৫৩, ৭০৫৪

আলোচ্য হাদীসে মুসলমানদের জামা’আতে ফাটল সৃষ্টি করা তথা এর বিপরীত পথে চলা অর্থাৎ তাদের ইজমা ও ঐক্যের বিরুদ্ধাচরণ করাকে ভয়াবহ ও ধর্মহীনতা বলা হয়েছে।

ইজমা হল উম্মতে মুহাম্মাদির অনন্য বৈশিষ্ট্য। আল্লামা কাসতাল্লানী (রহ.) মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন : إِجْمَاعُهُمْ حُجَّةٌ قَاطِعَةٌ . “উম্মাতে মুহাম্মাদীর ইজমা অকাট্য দলীল।”

ইজমার দৃষ্টিতে তাকলীদ

তাকলীদের ব্যাপারে সমস্ত উম্মাহের ঐক্যমত (ইজমা) প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, ‘মুজতাহিদগণের মাযহাব অনুসরণ করা আল্লাহর একটি সুপ্ত রহস্যের প্রতিফলন। তিনি আলিমদের অন্তরে তা ঢেলে দেন এবং তাদেরকে সে বিষয়ে একমত করেন। সে রহস্যের অনুভূতি তাদের থাকুক চাই না থাকুক।’ ‘দুররে মুখতারে’র ব্যাখ্যাগ্রন্থের ‘যবেহ’ অধ্যায়ে আল্লামা তাহতাবী (রহ.) লিখেছেন, অনেক মুফাস্সিরের মতে, নাজিয়া সম্প্রদায় তথা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ঐক্যমত পোষণ. করেন (ইজমা করেছেন) যে, এ যুগে মাযহাব চারটির মধ্যে হক সীমাবদ্ধ।

আর ‘রাওজুল বাসিম’ গ্রন্থের রচয়িতা এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, “তোমাদের কথা শুনে মনে হয় সাধারণ মানুষদের জন্য আলিমদের শরণাপন্ন হওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ সাহাবায়ে কেরামের ইজমা থেকে জানা যায়, আলিমদের কাছে যাওয়া সাধারণ মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। আর যা কিছু সাহাবাদের ইজমার পরিপন্থী তাই বাতিল বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে শুধু শাব্দিক ইজমা পর্যন্তই নয় সাহাবাদের কর্মের দ্বারাও প্রমাণ হয় যে, সাধারণ মানুষকে তাকলীদের উপর অবিচল থাকতে হবে।”

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *