ইমাম আবু হানীফা রহ. এর দূরদর্শিতা
একবার খলীফা আবু জাফর মানসুরের নির্দেশে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য সুফিয়ান সাওরী, মিসআর ইবনে কিদাম, ইমাম আবু হানীফা রহ. এবং কাজী সুরাইককে রাজদরবারে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। ইমাম আবু হানীফা রহ. তাঁর সাথীদের সম্পর্কে নিজের দূরদর্শিতা ও অন্তর্দৃষ্টির আলোকে বিভিন্ন মন্তব্য করেছিলেন, যা ছিলো বেশ মজার এবং পরবর্তীতে তাঁর মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয় ।
ইমাম আবু হানীফা রহ. নিজের ব্যাপারে বলেছিলেন,
১০.আমি যেকোনো কৌশলে বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবো ।
১১. সুফিয়ান সাওরী কৌশল অবলম্বন করে রাস্তা থেকেই পালিয়ে যাবে।
১২.আর মুসঈর ইবনে কুদাম খলীফার সামনে পাগলের ভান ধরে মুক্তি পেয়ে যাবে ।
১৩.কিন্তু আটকে যাবে শুরাইক। তার এ দায়িত্ব গ্রহণ করা ব্যতীত কোনো উপায় থাকবে না ।
তাদের চারজনকে আটক করে যখন খলীফার দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন ইমাম আবু হানীফা রহ. এ মন্তব্য করেছিলেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর সুফিয়ান সাওরী রহ. পুলিশদের বললেন, আমার পেশাব করতে হবে। তাঁর সাথে একজন পুলিশ দেয়া হলো। ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহ. একটি দেয়ালের আড়ালে নদীর ধারে গিয়ে এমনভাবে বসলেন, যেনো তিনি পেশাব করছেন ।
এমন সময় তিনি নদীর তীরে একটি নৌকা দেখতে পেলেন । পুলিশের অমনোযোগিতার সুযোগে তিনি লুকিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলেন। মাঝিকে বললেন, ভাই! এই দেয়ালের ওই পাশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, সে আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতে চায় আপনি আমাকে বাঁচান ।
ইমাম সুফিয়ান সাওরীর মিনতি শুনে মাঝি তাঁকে নৌকায় তুলে লুকিয়ে রাখলো ।
এদিকে পুলিশ দেয়ালের ওপাশে তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সময় যাচ্ছে কিন্তু সুফিয়ান সাওরীর কোনো খবর নেই। পুলিশ তাঁর নাম ধরে ডাকাডাকি করতে লাগলো। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। সাড়া-শব্দ না পেয়ে পুলিশ দেয়ালের এপাশে চলে এলো। হায় আফসোস! পুলিশ মহোদয়ের জন্য দেয়ালের এপাশে নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না।
সে সুফিয়ান সাওরীকে কোথাও খুঁজে পেলো না। অত্যন্ত পেরেশান ও লজ্জিত হয়ে সে তার সাথীদের নিকট ফিরে এসে বললো, সুফিয়ান সাওরী আমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
পুলিশরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাকি তিনজনকে নিয়ে খলীফার দরবারে উপস্থিত করলো।
রাজদরবারে প্রবেশের পরপরই মিসআর ইবনে কিদাম বাদশার আদব- কায়দার কোনো তোয়াক্কা না করে বাদশার সামনে এগিয়ে গেলো । নিঃসংকোচে খলীফার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে লাগলো, ১৪.বাদশাহ! আজকাল আপনার মেজাজ কেমন যাচ্ছে? ১৫.ভবিষ্যতে আপনার জীবনটা আবার কেমন যাবে? ১৬.প্রতিবেশীদের কোনো খোঁজ-খবর নিয়েছেন কি না? ১৭. আপনার চাকর-বাকর, ধন-সম্পদের কী অবস্থা? ১৮.এ ধরনের আবোল-তাবোল কথা বলার সাথে সাথে আবার এ কথাও বললেন, হ্যাঁ জনাব, আপনি নাকি আমাকে প্রধান বিচারপতি বানাতে চাচ্ছেন?
মিসআর ইবনে কিদামের এরূপ অসংলগ্ন কথাবার্তায় খলীফা এবং সমগ্র রাজদরবার বিস্মিত ও বিব্রত হয়ে পড়লো। দরবারে উপস্থিত খলীফার এক মন্ত্রী এগিয়ে এসে বললো, জাঁহাপনা! এ লোকটির মাথা ঠিক নেই। খলীফাও বললেন, হ্যাঁ, তাকে তো পাগলই মনে হচ্ছে। ওকে দরবার থেকে বের করে দাও।
এরপর ইমাম আবু হানীফা রহ. -কে ডাকা হলো এবং বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ করা হলো।
ইমাম আবু হানীফা রহ. বললেন, জাঁহাপনা! কূফাবাসীদের চিন্তা-চেতনা, মন-মেজাজ আপনার অজানা নয়। আমি বর্তমানে কূফার সাধারণ নাগরিক হিসেবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন-যাপন করছি।
কূফাবাসীর উপর আমার কোনো কর্তৃত্ব নেই। তা ছাড়া তারা আমার বংশগত অবস্থাও ভালো জানে। আমার বাবা রুটি বানাতেন। আমি নিজেও একজন কাপড় ব্যবসায়ী। এমতাবস্থায় যদি আমাকে প্রধান বিচারপতির গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে কূফাবাসী তা মেনে নেবে না। তারা বলবে, যে লোকের বাবা রুটি বানাতো, তার ছেলের কি অধিকার আছে, আমাদের উপর কর্তৃত্ব করার?
ইমাম আবু হানীফা রহ. এর এই বক্তব্য খলীফার মনে ধরলো। খলীফা বললো, আপনি সত্যই বলেছেন। এভাবেই ইমাম আবু হানীফা রহ. নিজেকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে নিলেন।
এবার কাজী শুরাইকের পালা। তিনি নানা উযর-আপত্তি পেশ করলেন। কিন্তু খলীফা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আপনার পর তো আর কেউ নেই, যে আপনাকে বাদ দিয়ে দেবো। কাজী সুরাইক বারবার নিজের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার অনুযোগ করলেন। কিন্তু খলীফা তাঁর কোনো ওজরই গ্রহণ করলেন না। বরং বললেন, আমি আপনার স্মৃতিশক্তির জন্য প্রতিদিন বাদাম, রওগন বেটে ফালুদা পান করানোর নির্দেশ দেবো। কাজী শুরাইক নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এভাবে ইমাম আবু হানীফার রহ. ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়ন হলো।
তথ্যসূত্র:
বই : ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. এর ঈমানদীপ্ত গল্প
লেখক : মুফতি মাহফুজ মোসলেহ