বেহেশতী জেওর পরিচিতি
প্রায় শত বছর ধরে ব্যাপক সমাদৃত এই বেহেশতি জেওর কিতাবটি উর্দু ভাষায় রচিত হানাফি মাজহাবের একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব। দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ঈমান-আকিদা বা মানুষের ব্যক্তিগত আমল যেমন ওজু, নামাজ, রোজা ইত্যাদি থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সব সমস্যার সমাধান রয়েছে গ্রন্থটিতে।
এমনকি সাংসারিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ও কিতাবটিতে স্থান পেয়েছে। কিতাবটি দশ খন্ডে প্রকাশিত হলেও আমাদের দেশে তিন খন্ডেই সবগুলো একত্রে পাওয়া যায়। কিতাবটির শেষ খন্ডে কিছু নেককার নারীর জীবনীও স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে কিছু রোগ-বালাইয়ের প্রতিকার ও টুটকার কথা বলা হয়েছে গ্রন্থটি। এটি কওমি মাদরাসার পাঠ্যসিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে কিতাবটি নারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিতাবটির লেখক হিসেবে হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ.-এর নাম প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত আছে। যদিও তিনি কিতাবটির মূল লেখক নন। তবে তাঁর তত্ত্বাবধানে এটি সংকলিত হয়েছে এবং তাঁর নামের কারণেই এতো ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। কেননা উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ ও ভালোবাসা ছিল অতুলনীয়। এজন্য তাঁকে হাকিমুল উম্মত বা উম্মতের চিকিৎসক বলা হয়।
বইয়ের বিষয়বস্তুঃ
আলোচ্য বইটি মূলত মাসআলা-মাসাইলের বই। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা সমূহ খুবই সুন্দরভাবে বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রয়োজনসাপেক্ষে কুরআনুল কারীম ও হাদীসের উল্ল্যেখ করা হয়েছে। বইটিতে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছেঃ ‘ইলম ও ইলমের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ’, ‘আকীদা-বিশ্বাস’, ‘পবিত্রতা’, ‘নামায’, ‘রোযা’, ‘যাকাত’, ‘কুরবানী’, ‘হজ্জ’, ‘মানত ও কসম’, ‘মুরতাদ হওয়া’, ‘পশু-পাখি যবেহ করার মাসায়েল’, ‘হালাল-হারাম’, ‘ওয়াক্ফ’, ‘বিবাহ’, ‘তালাক’, ‘শিষ্টাচার-নীতি-নৈতিকতা, দায়িত্ব কর্তব্য’, ‘কুরআন তিলাওয়াত’, ‘লেনদেন’, ‘নানাবিধ অপপ্রথা’, ‘আদব আখলাক ছওয়াব ও আজাবের বর্ণনা’, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’, ‘পুন্যবতী নারীদের কাহিনী’, ‘কতিপয় অসচ্চরিত্র নারীর কাহিনী’, ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ এবং ‘বিবিধ বিষয়’।
বেহেশতী জেওরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বেহেশতী জেওর হানাফী ফিক্বহের একটি গ্রহণযোগ্য কিতাব একথা সত্য। একটি ব্যাপক সমাদৃত গ্রন্থ তা’ও সত্য।
কিন্তু এর সংকলক হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. কে নিশ্চিতভাবে বলা ঠিক নয়। কারণ, হযরত থানবী রহ. এর নিজের লেখা ও তার ভাগিনা হযরতুল আল্লাম মুফতী যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর লিখনী ভিন্ন কথাই প্রমাণ করে।
মাকতাবাতুল বুশরা প্রকাশনী করাচি পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত বেহেশতী গাওহারের রোযা অধ্যায় এর ১৬৭ পৃষ্ঠার নিচে লিখিত একটি টিকায় হযরত যফর আহমাদ উসমানী রহঃ পরিস্কার লিখেছেনঃ
مولوى احمد على صاحب مؤلف بہشتی زیور অর্থাৎ মৌলভী আহমাদ আলী সাহেব বেহেশতী জেওরের সংকলক। [বেহেশতী গাওহার, রোযা অধ্যায়, ১৬৭ পৃষ্ঠা, প্রকাশনী, মাকতাবাতুল বুশরা, করাচি, পাকিস্তান]
ঠিক একই টিকা সংযোজিত হয়েছে আশরাফ আলী থানবী রহ. এর ফাতওয়া গ্রন্থ “ইমদাদুল ফাতাওয়া” যাকারিয়া বুক ডিপো দেওবন্দ ছাপায় ২য় খন্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় এবং দারুল উলুম করাচি প্রকাশনায় ২য় খন্ডের ১৬৬ পৃষ্ঠায়। কিতাবটি পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম মুফতী শফী রহ. এর তারতীবক্রমে ছেপেছে।
যা পরিস্কার প্রমাণ করে বেহেশতী জেওরের মূল সংকলক হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. নন। বরং “আহমদ আলী” নামের একজন মাওলানা সাহেব। এবার আরো স্পষ্ট বক্তব্য দেখুন খোদ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. থেকে। ইমদাদুল ফাতাওয়ার দ্বিতীয় খন্ডের রোযা অধ্যায়ে বেহেশতী জেওরে উদ্ধৃত রোযার কাফফারা সংক্রান্ত একটি মাসআলা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়।
সে প্রশ্নের জবাবে থানবী রহ. লিখেন-
بہشتی زیور کی سند میں تو اس وقت کوئ روایت نہیں ملی مولوی احمد علی صاحب مرحوم نے معلوم نہیں وہ مسئلہ کہا سے لکها
বেহেশতী জেওরে উল্লেখিত মাসআলার পক্ষে এখন পর্যন্ত কোন বর্ণনা পাইনি। জানা নেই এ মাসআলা মাওলানা আহমাদ আলী কোত্থেকে লিখেছেন! [ইমদাদুল ফাতওয়া, যাকারিয়া বুক ডিপো দেওবন্দ, দ্বিতীয় খন্ড, ১৩৬ পৃষ্ঠা, মাকতাবা দারুল উলুম করাচি, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬৬]
হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. এর নিজের বক্তব্য এবং হযরত যফর আহমাদ উসমানী রহঃ.এর বক্তব্য অনুপাতে একথা পরিস্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে, বেহেশতী জেওরের সংকলক আশরাফ আলী থানবী রহ. নয়।
বরং যাওলানা ‘আহমদ আলী’ সাহেব নামের একজন বিজ্ঞ আলেম এ কিতাবের আসল সংকলক। তিনি ছিলেন হযরত থানবী রহ.এর প্রথম খলীফা। হযরত থানবী রহ.এর নির্দেশ ক্রমে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই তিনি কিতাবটি সংকলন করেন। এ কারণে সংকলক হিসেবে হযরত থানবী রহ.এর নাম মশহুর হয়ে গেছে। পরবর্তীতে হযরতের স্বহস্তে রচিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় এবং আলোচনা তাতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
হযরত থানবী রহ.এর জীবনীগ্রন্থ ‘আশরাফুস সাওয়ানেহ’-এমাওলানা আহমদ আলী সাহেব রহ.এর পরিচিতি ও তাঁর ফিকহী পাণ্ডিত্য এবং তিনিই যে কিতাবটির আসল রচয়িতা তার আলোচনা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘তিনি বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একজন বুজুর্গ ছিলেন। জাহেরী ও বাতেনী ইলমের অধিকারী ছিলেন। হযরত থানবী রহ.এর ইজাযতপ্রাপ্ত সর্বপ্রথম খলীফা ছিলেন তিনি।
ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর অনেক বেশি মুনাসাবাত বা পাণ্ডিত্য ছিল। এমনকি হযরত গাঙ্গুহী রহ.কে কতিপয় ফিকহী প্রশ্ন করার ফলে খোদ গাঙ্গুহী রহ. তাঁর প্রশংসা করে বলেন, ফিকহ শাস্ত্রে তার ভালো মুনাসাবাত আছে।
ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বেহেশতী জেওর কিতাবের প্রথম পাঁচ খণ্ড হযরত থানবী রহ.এর নির্দেশক্রমে তিনিই রচনা করেছিলেন। যা থেকে হাজারো মুসলিম নারী-পুরুষ উপকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। আশা করা যায়, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তা থেকে একইভাবে উপকৃত হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কিতাবটির রচনা পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খুব অল্প হায়াত পেয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তাঁর দ্বারা উম্মত অনেক বেশি উপকৃত হতে পারতো। আল্লাহ তাআলা জান্নাতে তাঁর মর্তবা বুলন্দ করুন।’ [আশরাফুস সাওয়ানেহ ১/৯৫] সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ. লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)