ইতিকাফ
ইতিকাফের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য, স্থান
ইতিকাফ কাকে বলে?
ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, কোন বস্তুর ওপর স্থায়িভাবে থাকা। ইতিকাফের মধ্যে নিজের সত্তাকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয় এবং নিজেকে মসজিদ হতে বের হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফের নিয়তে পুরুষের ঐ মসজিদে অবস্থান করা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা হয় অথবা কোন মহিলার নিজ ঘরে নামাযের স্থানে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয় ।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
ইতিকাফের উদ্দেশ্য জানা যায় হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রা. বর্ণিত বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস থেকে। তিনি বর্ণনা করেন : “রাসূলুল্লাহ সা. রমযানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন। তারপর তিনি তুর্কী তাঁবুর ভিতরে অবস্থান করেছিলেন তা থেকে মাথা বের করে বললেন; “আমি এ রাতটি অর্থাৎ শবে কদরের সন্ধানে প্রথম দশক ইতিকাফ করলাম, তারপর মাঝের দশকও ইতিকাফ করলাম, তারপর জনৈক আগন্তুক (ফেরেশতা) মারেফতে আমাকে বলা হলো, রাতটি শেষ দশকে নিহিত রয়েছে; সুতরাং আমার সাথে যারা ইতিকাফ করেছে তাদের শেষ দশকে ইতিকাফ করা উচিত। (ফাজায়েলে রমযান, উর্দু- ৫২) এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শবে কদরের মাহাত্ম্য রাতটি পাওয়াই ইতিকাফের উদ্দেশ্য। কেননা ইতিকাফকারী সাধারণত ইবাদত- বন্দেগীর মাধ্যমেই রাত কাটিয়ে থাকেন। সুতরাং শেষ দশকের যে রাতেই শবে কদর হোক ইতিকাফকারী তার মহাপুণ্য থেকে বঞ্চিত থাকার কোনই কারণ নেই ।
ইতিকাফের স্থান
যে মসজিদে নিয়মিতভাবে আযান, ইকামত সহকারে জামাতের সাথে নামায আদায় হয় সেই মসজিদেই ইতিকাফ করা সহীহ হবে।
ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদুল হারাম, এরপর মসজিদে নববী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপর মসজিদে আকসা।
এরপর ঐ জুমু’আর মসজিদ যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করা হয়। এরপর সে মসজিদে যেখানে মুসল্লীর সংখ্যা অধিক হয়ে থাকে (শামী)।
ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইতিকাফ সহীহ্ হবে এমন মসজিদে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয় (হিদায়া)। ইমাম জালালুদ্দীন যায়লাঈ রহ. ‘কেফায়া’ গ্রন্থে হিদায়া কিতাবে উল্লিখিত কথাটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. এর বক্তব্যে জুমু’আর মসজিদ ব্যতীত অন্য মসজিদের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। কারণ যেখানে জুমা’আর নামায আদায় করা হয় সেখানে অবশ্যই ইতিকাফ সহীহ্ হয় (ফাতহুল কাদীর)। মহিলাগণ নিজ ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় ইতিকাফ করবেন। নামাযের জন্য জায়গা নির্ধারিত না থাকলে ইতিকাফে বসার সময় তা নির্ধারিত করে নিলেও সহীহ্ হবে। মসজিদে ইতিকাফ করা তাদের জন্য মাকরূহ।(শামী)
মান্নতের ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত। সুতরাং মান্নতের ইতিকাফ কমপক্ষে একদিন করতে হবে। কেননা একদিনের কম সময়ের রোযা সহীহ হয় না। এ ছাড়া রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। নফল ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত কোন সময় নেই এবং এর জন্য রোযা রাখাও শর্ত নয়। এ ইতিকাফ অল্প কিছুক্ষণের জন্যও হতে পারে; এমনকি মসজিদে না বসে মসজিদ অতিক্রম করার সময়েও নফল ইতিকাফের নিয়ত করলে তা সহীহ্ হবে। (তাহতাবী)
তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।
হাদীসের আলোকে ইতিকাফের ফজিলত ও উপকারিতা
ইতিকাফের ফজিলত
ইতিকাফের উপকারীতা
তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।
ইতিকাফের মাসায়েল
ইতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হওয়া
তথ্যসূত্রঃ রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি। ও রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল।
ইতিকাফ অবস্থায় অযু, গোসল,জুমআ, জানাযায় অংশগ্রহণ ইত্যাদির বিধান
ইতেকাফ অবস্থায় অযু
এতেকাফকারী ফরয ও নফল অযুর জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে যদি মসজিদের ভিতরে কোন ব্যবস্থা না থাকে। (আহকামে এতেকাফ-১৪) মাসআলা ঃ এতেকাফকারী শরীয়তসম্মত প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে বিলম্ব না করে মেসওয়াক, মাজন বা টুথপেস্ট ব্যবহার করতে পারবে। তবে অযুর পরে বাইরে অপেক্ষা করা বা রাস্তায় সামান্য সময়ের জন্য যাওয়া জায়েয হবে না।
উল্লেখ্য যে, রোযা অবস্থায় মাজন বা টুথপেষ্ট ব্যবহার করা মাকরূহ। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫১০, আহকামে এতেকাফ-১৪)
ইতেকাফ অবস্থায় গোসল
ইতেকাফকারীদের জন্য ফরয ও সুন্নত তথা জুমজার গোসলের জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয। এছাড়া ঠান্ডা বা প্রশান্তি অর্জনের প্রয়োজন হলে কোন ভিজা তোয়ালে বা গামছা ইত্যাদি দিয়ে মসজিদের ভিতরে নিজের শরীর মুছে নিবে। তবে প্রশান্তির অর্জনের উদ্দেশ্যে গোসল করার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। (শামী ৫/৩৫১, আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৮)
ইতেকাফ অবস্থায় আযান
কোন মুয়াজ্জিন যদি এতেকাফে বসে এবং আযান দেয়ার জন্য তাকে মসজিদের বাইরে যেতে হয় তাহলে যেতে পারবে। তবে আযান শেষ করার পর বাইরে অবস্থান করতে পারবে না। (শামী ৩/৫০২)
ইতেকাফ অবস্থায় জুমআ
জামে মসজিদে এতেকাফ করা উত্তম। পাঞ্জেগানা মসজিদে এতেকাফ করা জায়েয।
পাঞ্জেগানা মসিজদে ইতিকাফকারী ব্যক্তি জুমার নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজ মসজিদ থেকে বের হয়ে নিকটবর্তী জুমার মসজিদে গিয়ে জুমার নামায আদায় করতে পারবে। ইতিকাফকারী ব্যক্তি জুমার মসজিদে গিয়ে ফরজের পূর্ববর্তী সুন্নাত, খুতবা, জুমার ফরজ আদায় এবং জুমার ফরজের পরবর্তী ছয় রাকাত সুন্নাত আদায় করা পরিমাণ সময় পর্যন্ত জুমার মসজিদে অবস্থান করতে পারবে। উপরোক্ত উদ্দেশ্যে জুমার মসজিদ নিকটবর্তী হলে যাওয়ালের পরে এবং দূরবর্তী হলে এতটুকু সময় পূর্বে নিজ মসজিদ থেকে বের হবে যেন ফরজের পূর্ববর্তী সুন্নাত আদায় করা যায় এবং খুতবা শোনা যায়।
পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফকারী ব্যক্তি যদি জুমার মসজিদে নামায আদায় করতে গিয়ে নামায আদায়ের পরেও সেখানে অবস্থান করে তবে তাতে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। এমনকি যদি ঐ জুমার মসজিদে একদিন একরাত অবস্থান করে অথবা ঐ জুমার মসজিদে অবস্থান করেই ইতিকাফ পূর্ণ করে তাতেও ইতিকাফ ফাসিদ হবে না। তবে প্রয়োজন ব্যতীত এরূপ করা মাকরূহে তানযীহি। (আলমগীরী ও শামী)
ইতিকাফকারীর জানাযায় অংশ গ্রহণ
ইতিকাফকারী ব্যক্তি রোগী দেখতে অথবা জানাযার সালাত আদায় করার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। তবে নফল ইতিকাফকারী রোগী দেখার উদ্দেশ্যে অথবা জানাযার সালাতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বেরহতে পারবে।
যদি কোন ইতিকাফকারী ব্যক্তি কোন বৈধ কাজ যেমন- মানবীয় প্রয়োজন অথবা জুমার সালাতের জন্য বের হওয়ার পর পথে কোন রোগী দেখে নেয় অথবা উপস্থিত জানাযার সালাত আদায় করে নেয় তবে তা জায়েয। (শামী) কেউ যদি ইতিকাফের মান্নত করার সময় এ নিয়ত করে যে, সে ইতিকাফ অবস্থায় রোগী দেখতে যাবে, জানাযার সালাত আদায় করতে যাবে এবং ইলমী মজলিসে উপস্থিত হবে তবে তার জন্য ইতিকাফ অবস্থায় এ কাজ সমূহের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয। (শামী ও আলমগীরী)
তথ্যসূত্রঃ ১ঃ রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল ২ঃ রোজা রাখি বেহেশত অর্জন করি।
ইতিকাফের শর্ত, রোকন, ইতিকাফ ভঙ্গ হওয়ার কারণ ইত্যাদি
ইতিকাফের রোকন বা মূল ভিত্তি
ইতিকাফের প্রধান রোকন হল, ইতিকাফকারী সর্বদাই মসজিদের সীমানার ভেতরে থাকবে । অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া একটু সময়ের জন্যও মসজিদের বাইরে যাবেনা। ইতিকাফকারী যদি শরয়ী কারণ ছাড়া কিছু সময়ের জন্যও বাইরে যায়, তাহলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. ইতিকাফে বসলে মানবীয় ‘প্রয়োজন’ (প্রাকৃতিক প্রয়োজন) ছাড়া ঘরে আসতেন না । (সহীহ বুখারী, হাদীস-২০২৯)
উল্লেখ্য : শরীয়তের দৃষ্টিতে মসজিদ শুধু এতটুকু অংশকে বলা হয়, যতটুকু কে মসজিদ নির্মাতাগণ মসজিদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাই অযুখানা, গোসলখানা, ইস্তেঞ্জাখানা, জানাযার নামাযের জায়গা, ইমাম সাহেবের কক্ষ ইত্যাদি কোনোটিই মসজিদের অংশ নয়। ইতিকাফকারীর জন্য শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া এসব স্থানে (অর্থাৎ যা মসজিদ নয়) যাওয়া জায়েয নয়। শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া এসব জায়গায় সামান্য সময় অতিবাহিত করলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। মসজিদের সিঁড়ি যা অতিক্রম করে মুসল্লিগণ মসজিদে প্রবেশ করেন, তাও সাধারণত মসজিদের বাহিরের অংশ হিসেবে গণ্য হয়। এ জন্য ইতিকাফকারী শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া সিঁড়িতে যেতে পারবেনা। তবে যদি সিঁড়ি এমন জায়গায় বানানো হয়, যা মসজিদের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিবেচিত হয়, যেমন দোতলায় যাওয়ার জন্য মসজিদের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি বানানো হল, তাহলে সেখানে যেতে অসুবিধা নেই । কোনো কোনো মসজিদে চট, চাটাই ইত্যাদি আসবাবপত্র রাখার জন্য আলাদা রুম বানানো হয়ে থাকে। যদি প্রতিষ্ঠাতাগণ বলেন যে, এটা মসজিদ এবং সেখানে মুসল্লিরা নামাযও পড়ে, তাহলে মসজিদের হুকুমে হবে এবং ইতিকাফকারী সেখানে প্রবেশও করতে পারবে। অন্যথায় মসজিদের হুকুমে আসবেনা। ইতিকাফকারী মসজিদের মেহরাবে যেতে পারবে। কেননা সকল মসজিদের মেহরাব মসজিদের অন্তর্ভুক্ত এবং মসজিদের অংশ হয়ে থাকে।
উপরের আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, মসজিদের সিমানা নির্ধারণ করা কতটুকু প্রয়োজন । ইতিকাফকারীর জন্য ইতিকাফে বসার আগে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেওয়া উচিত। শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া সামান্য সময়ের জন্য মসজিদের সীমানার বাইরে থাকলে ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যাবে। তাই খুব সাবধান থাকা জরুরী।
ইতিকাফের শর্তাবলী
তথ্যসূত্রঃ
রোযা রাখি বেহেশত অর্জন করি।
মহিলাদের ইতিকাফ
ফজিলত
ইতেকাফের ফজিলত শুধু পুরুষদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় বরং মহিলারাও এর দ্বারা উপকৃত হতে পারবে কেননা হাদীস শরীফে মহিলাদের ই’তেকাফের বিষয়ে অনেক গুরুত্ব এসেছে এবং মহিলা সাহাবীগণ (রা.) যে এতেকাফে বসেছেন এরও অনেক প্রমাণ রয়েছে।
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।(বুখারি: ২০২৬; মুসলিম: ১১৭২)
কিন্তু বর্তমান সমাজের অনেক মহিলা উক্ত সওয়াবের কাজ থেকে বঞ্চিত। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকেও ইতেকাফের সওয়াব অর্জন করার তৌফিক দান করুক। আমিনঃ
মাসায়েল
তথ্যসূত্রঃ রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল। ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।