ইসলাম

যেসব আমল পরকালে দাঁড়িপাল্লাকে হালকা করে

১. রিয়া বা লৌকিকতা :

মানুষ আমল করবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কিন্তু কেউ অন্যকে দেখানোর বা শুনানোর জন্য কোন আমল করলে, সে আমল আল্লাহ কবুল করবেন না। এর কারণে পরকালে শাস্তি পেতে হবে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِىَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاءُوْنَ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً.

‘মাহমূদ বিন লাবীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয় তাহ’ল ছোট শিরক। ছাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ছোট শিরক কী জিনিস? উত্তরে তিনি বললেন, রিয়া (লোকপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আমল)। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা যখন (ক্বিয়ামতে) লোকেদের আমলসমূহের বদলা দান করবেন তখন সকলের উদ্দেশ্যে বলবেন, তোমরা তাদের নিকট যাও, যাদেরকে প্রদর্শন করে দুনিয়াতে তোমরা আমল করেছিলে। অতঃপর দেখ, তাদের নিকট কোন প্রতিদান পাও কি-না’।(আহমাদ হা/২৩৬৮০; ছহীহ তারগীব হা/২৯; ছহীহাহ হা/৯৫১।)

২. আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করা :

মহান আল্লাহ মানুষের জন্য দুনিয়াতে চলার জন্য কিছু বিধান দিয়েছেন। এ বিধান পালন করা মানুষের জন্য যরূরী। আল্লাহর বিধান লংঘন করা বড় গোনাহ।

নবী করীম (ছাঃ) বলেন,لأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِىْ يَأْتُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا فَيَجْعَلُهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَبَاءً مَنْثُورًا. قَالَ ثَوْبَانُ يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لاَ نَكُونَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لاَ نَعْلَمُ. قَالَ : أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ وَيَأْخُذُونَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُونَ وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوهَا.

‘আমি আমার উম্মাতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে’। (ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৫; আত-তালীকুর রাগীব ৩/১৭৮; ছহীহাহ হা/৫০৫।)

৩. মানুষের প্রতি যুলুম করা, গালি দেওয়া, গীবত করা ও মারধর করা :

মানুষের প্রতি যুলুম করা, গালি-গালাজ করা ও গীবত করা এবং অন্যায়ভাবে মারধর করা বড় গোনাহ। পরকালে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে নেকী দিয়ে। ফলে  তখন নেকীর পাল্লা হালাকা হয়ে যাবে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَجُلاً قَعَدَ بَيْنَ يَدَىِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ لِى مَمْلُوكَيْنِ يُكْذِبُونَنِى وَيَخُونُونَنِى وَيَعْصُونَنِى وَأَشْتُمُهُمْ وَأَضْرِبُهُمْ فَكَيْفَ أَنَا مِنْهُمْ قَالَ  يُحْسَبُ مَا خَانُوكَ وَعَصَوْكَ وَكَذَبُوكَ وَعِقَابُكَ إِيَّاهُمْ فَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ بِقَدْرِ ذُنُوبِهِمْ كَانَ كَفَافًا لاَ لَكَ وَلاَ عَلَيْكَ وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ دُونَ ذُنُوبِهِمْ كَانَ فَضْلاً لَكَ وَإِنْ كَانَ عِقَابُكَ إِيَّاهُمْ فَوْقَ ذُنُوبِهِمُ اقْتُصَّ لَهُمْ مِنْكَ الْفَضْلُ. قَالَ فَتَنَحَّى الرَّجُلُ فَجَعَلَ يَبْكِى وَيَهْتِفُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَمَا تَقْرَأُ كِتَابَ اللهِ (وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلاَ تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ) الآيَةَ. فَقَالَ الرَّجُلُ وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ مَا أَجِدُ لِى وَلِهَؤُلاَءِ شَيْئًا خَيْرًا مِنْ مُفَارَقَتِهِمْ أُشْهِدُكُمْ أَنَّهُمْ أَحْرَارٌ كُلَّهُمْ.

আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছাঃ)-এর সম্মুখে বসে এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার কয়েকটি গোলাম আছে। আমার নিকট এরা মিথ্যা কথা বলে, আমার সম্পদে ক্ষতিসাধন (খিয়ানত) করে এবং আমার অবাধ্যতা করে। এ কারণে তাদেরকে আমি বকাবকি ও মারধর করি। তাদের সাথে এমন ব্যবহারে আমার অবস্থা কি হবে? তিনি বললেন, তারা যে তোমার সাথে খিয়ানত করে, তোমার অবাধ্যতা করে এবং তোমার নিকট মিথ্যা বলে, আর এ কারণে তাদের সাথে তুমি যেমন আচরণ কর- এ সবেরই হিসাব-নিকাশ হবে। যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের সমান হয়, তবে ঠিক আছে। তোমারও কোন অসুবিধা হবে না, তাদেরও কোন অসুবিধা হবে না। যদি তোমার দেয়া শাস্তি তাদের অপরাধের তুলনায় কম হয়, তাহ’লে তোমার জন্য অতিরিক্ত (ছওয়াব) রয়ে গেল। আর তোমার প্রদত্ত শাস্তি যদি তাদের অপরাধের তুলনায় বেশী হয়, তাহ’লে অতিরিক্ত অংশের জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।

বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে লোকটি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আলাদা হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে তুমি কি এ কথা পড় নাই যে, ‘আমরা ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করব। সুতরাং কোন লোকের উপর কোন যুলুম করা হবে না। কারো বিন্দু পরিমাণও কিছু কৃতকর্ম থাকলে আমরা তাও হাযির করব। আর হিসাব সম্পন্ন করার জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (আম্বিয়া ২১/৪৭)। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! তাদের মাঝে এবং আমার মাঝে বিচ্ছিন্নতা ছাড়া আমার ও তাদের কল্যাণের আর কোন পথ দেখছি না। আপনাকে আমি সাক্ষী রেখে বলছি, তাদের সবাই এখন হ’তে মুক্ত’। (তিরমিযী হা/৩১৬৫; মিশকাত হা/৫৫৬১; ছহীহ আত-তারগীব হা/২২৯০।)

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ. قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ. فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ

‘তোমরা কি জান, নিঃস্ব কে? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের মধ্যে নিঃস্ব হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার দিরহামও (নগদ অর্থ) নেই, কোন সম্পদও নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে নিঃস্ব যে ক্বিয়ামত দিবসে ছালাত, ছিয়াম, যাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সাথে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা) করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হ’তে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা (বিনিময়) নেয়ার আগেই তার সৎ আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের  গুনাহ সমূহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।(মুসলিম হা/২৫৮১; তিরমিযী হা/২৪১৮; ছহীহাহ হা/৮৪৫।)

পরিশেষে বলব, যেসব আমলের মাধ্যমে পরকালীন জীবনে নেকীর পাল্লা ভারী হবে সেগুলো বেশী বেশী সম্পাদন করে জান্নাতের পথ সুগম করা প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য করণীয়। পক্ষান্তরে যেসব আমল নেকীর পাল্লা হালকা করবে এবং গোনাহের পাল্লা ভারী করবে সেগুলো থেকে বিরত থেকে নাজাতের পথ সুগম করা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

সংকলক

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *