ইবাদত

শোকরে গাফলতির কারণ

মূর্খতা ও গাফলতির কারণে মানুষ নেয়ামতের শোকর করে না। কারণ, সে মূর্খতার কারণে নেয়ামত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। এটা জানা কথা যে, শোকর আদায় করতে হলে নেয়ামত সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা দরকার। যারা নেয়ামত সম্পর্কে জানে, তাদেরও অনেকের ধারণা, মুখে “আলহামদু লিল্লাহ” অথবা “আল্লাহর শোকর” বলাই হচ্ছে নেয়ামতের শোকর। যে নেয়ামত যে রহস্যের জন্যে সৃজিত হয়েছে, তাকে সেই নেয়ামত পূর্ণ করার কাজে ব্যবহার করাই নেয়ামতের অর্থ সেকথাই তারা জানে না। আর নেয়ামতের প্রার্থিত রহস্য হচ্ছে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর আনুগত্য। এ দুটি বিষয় জানার পর শোকরের বাধা কামনা-বাসনার প্রাবল্য এবং শয়তানের আধিপত্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এখন নেয়ামত জানা থেকে গাফিল থাকার কারণ কয়েকটি।

একঃ মানুষ মূর্খতাবশত যে বস্তু সকলের কাছে সর্বাবস্থায় বিদ্যমান থাকে, তাকে নেয়ামত মনে করে না। ফলে, কেউ এর শোকর আদায় করে না।

উদাহরণতঃ আহার ও খাদ্য সম্পর্কিত যে সকল নেয়ামত উপরে বর্ণিত হয়েছে, কেউ এগুলোর শোকর করে না। কেননা, এগুলো ব্যাপক নেয়ামত। কারও সাথে এগুলোর বিশেষত্ব নেই। অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে কেউশোকর করে না। অথচ মুহূর্তের জন্যে গলা চেপে ধরলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়। অথবা যদি কাউকে এমন কক্ষে আটকে রাখা হয়, যার বায়ু উত্তপ্ত কিংবা এমন কূপে আটকে রাখা হয়, যার বায়ু হিমশীতল, তবে দমবন্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করবে। হ্যাঁ, যদি আটকে রাখার পর পুনরায় মৃতপ্ৰায় অবস্থায় বের করা হয়, তবে সে বুঝবে বায়ু একটি বড় নেয়ামত। তাই ‘কথায় বলে- قدر نعمت بعد زوال হাতছাড়া হওয়ার পরই নেয়ামতের কদর হয়।’ কিন্তু এটা মূর্খতা। কারণ, এতে নেয়ামত হাতছাড়া হওয়ার পর পুনরায় হস্তগত হওয়ার উপর শোকর নির্ভরশীল হবে। অথচ নেয়ামতের শোকর সার্বক্ষণিক হওয়া উচিত। আমরা চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে কখনও চোখের শোকর করতে দেখি না। অন্ধ হওয়ার পর সে চোখের মর্যাদা বুঝে। এরপর যদি দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে, তবে সে একে নেয়ামত মনে করে শোকর করে।

মানুষের বর্তমান অবস্থা এই যে, তারা কেবল ধন-সম্পদেরই শোকর করে— যদি তাতে তাদের কিছু বিশেষত্ব হয়ে যায়। এ ছাড়া অন্য সব নেয়ামত তারা বিস্মৃত হয়ে যায়। বর্ণিত আছে, জনৈক দরিদ্র ব্যক্তি কোন এক বুযুর্গের কাছে তার দারিদ্র্যের অভিযোগ পেশ করে অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করল। বুযুর্গ বললেন : তুমি কি দশ হাজার দিরহাম পাওয়ার বিনিময়ে অন্ধ হয়ে যাওয়া পছন্দ করবে? লোকটি বলল : না। বুযুর্গ বললেনঃ তুমি কি দশ হাজার দিরহামের বিনিময়ে বোবা হয়ে যাওয়া মঞ্জুর করবে? লোকটি আরয করল : না। তিনি বললেন : দশ হাজারের বিনিময়ে তুমি কি খোঁড়া হতে সম্মত হবে? সে বলল : না। তিনি বললেন : দশ হাজারের বিনিময়ে তুমি পাগল হওয়া পছন্দ করবে কি? সে বলল : না। বুযুর্গ বললেন : তাহলে প্রভুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে তোমার লজ্জা হয় না? তিনি পঞ্চাশ হাজার দিরহামেরও অধিক পরিমাণ সম্পদ তোমাকে দিয়ে রেখেছেন। এরপরও তুমি অভিযোগ করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছ?

একবার হযরত ইবনে সামমাক (রহঃ)সমকালীন খলীফার কাছে গেলেন। খলীফা গ্লাস হতে পানি পান করতে করতে বললেন : আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন: মনে করুন আপনি তৃষ্ণার্ত। সঙ্গের যাবতীয় নগদ অর্থকড়ি দিয়েই আপনি এক গ্লাস পানি পেতে পারেন। এমতাবস্থায় আপনি কি করবেন? সকল অর্থ দিয়ে পানি সংগ্রহ করবেন কি না? খলীফা আরয করলেন : অবশ্যই পানির জন্যে সকল অর্থ দিয়ে দেব। ইবনে সামমাক বললেন : যদি এরই বিনিময়ে গোটা রাজত্ব দিতে হয়, তবে তা-ও দিয়ে দেবেন। খলীফা বললেন : নিঃসন্দেহে। ইবনে সামমাক বললেন : তাহলে এরূপ রাজত্বের জন্য আনন্দিত হওয়া ঠিক নয়, যার মূল্য এক গ্লাস পানির সমান। এ থেকে জানা গেল যে, পিপাসার সময় এক গ্লাস পানির মূল্য সারা বিশ্বের রাজত্বের চেয়েও বেশী ।

সাধারণ মানুষ বিশেষ নেয়ামতকেই কেবল নেয়ামত মনে করে, ব্যাপক নেয়ামতকে নয়। এ পর্যন্ত আমরা কেবল ব্যাপক নেয়ামত বর্ণনা করেছি। তাই সংক্ষেপে কিছু বিশেষ নিয়ামত উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রত্যক মানুষ যদি নিজের অবস্থা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, তবে একটি অথবা কয়েকটি নেয়ামত এমন পাবে, যা বিশেষভাবে তারই জন্যে নির্ধারিত। সকল মানুষ অথবা কোন মানুষ এতে তার সাথে শরীক নয়।

তিনটি বিষয়ে যে কেউ একথা স্বীকার করে। প্রথম বুদ্ধিমত্তা, দ্বিতীয় চরিত্র এবং তৃতীয় জ্ঞান। বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তো এটা প্ৰসিদ্ধ যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের বুদ্ধিমত্তাকে পরিপূর্ণ মনে করে। এমন কোন মানুষ নেই, যে নিজের বুদ্ধিমত্তায় সন্তুষ্ট নয় এবং নিজেকে অন্যের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান মনে না করে। একারণেই কেউ আল্লাহ তাআলার কাছে বুদ্ধিমত্তার জন্য দোয়া করে না। এটাও বুদ্ধিমত্তার অন্যতম গৌরব যে, যে ব্যক্তি এ গুণ থেকে মুক্ত, সে-ও এর প্রতি সন্তুষ্ট এবং যে এ গুণে গুণান্বিত, সেও উল্লসিত। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তি যখন আপন বিশ্বাসে অপরের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান, তখন বাস্তবে তাই হলে এ নেয়ামতের শোকর করা তার উপর ওয়াজিব। পক্ষান্তরে বাস্তবে এরূপ না হলেও শোকর ওয়াজিব। কারণ, তার পক্ষে তো নেয়ামত বিদ্যমান আছে। চরিত্রের অবস্থাও তদ্রূপ।প্রত্যেক ব্যক্তি অপরের মধ্যে কিছু দোষ থাকা পছন্দ করে এবং অপরের কিছু অভ্যাসকে খারাপ মনে করে। কিন্তু নিজেকে এগুলো থেকে মুক্ত মনে করে।

সুতরাং তার শোকর করা উচিত যে, আল্লাহ তা’আলা তার অভ্যাস সমূহকে সুন্দর করেছেন এবং অপরকে মন্দ অভ্যাস দিয়েছেন। জ্ঞান-গরিমার অবস্থা এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মধ্যে এমন কিছু গোপন বিষয় জানে, যা অন্য কেউ জানে না। যদি জেনে ফেলে, তবে সে অপমানিত ও হেয় হয়ে যায়।তাই বিষয়গুলো জানার ব্যাপারে অন্য কেউ তার সাথে শরীক থাকে না। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা যে তার বিষয়গুলো গোপন রেখেছেন, সেজন্যে আল্লাহর শোকর করা উচিত।

কারণ, আল্লাহ তার গোপন দোষগুলো মানুষের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন, ভাল বিষয়গুলো প্রকাশ করেছেন এবং দোষসমূহের জ্ঞান তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেননি। উপরোক্ত তিনটি বিশেষ নেয়ামত প্রত্যেকেই স্বীকার করে।

সারকথা, মানবকুলের সামনে শোকরের পথ রুদ্ধ হওয়ার কারণ এটাই যে, তারা যাহেরী, বাতেনী, বিশেষ ও ব্যাপক নেয়ামত সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিফহাল নয়।

এক্ষণে গাফেল অন্তরসমূহের চিকিৎসা বর্ণনা করা হচ্ছে এই আশায় যে, হয়তো তারা গাফলতির নিদ্রা থেকে জাগ্রত এবং শোকর আদায়ে তৎপর হবে।

হুশিয়ার ও বিজ্ঞ অন্তর সমূহের চিকিৎসা এই যে, আমরা ব্যাপক নেয়ামতসমূহের যে সকল প্রকার ইঙ্গিতে বর্ণনা করেছি, সেগুলো সম্পর্কে তারা গভীর চিন্তা-ভাবনা করবে।

আর যারা বিশেষ নেয়ামত ছাড়া অন্য কিছুকে নেয়ামতই মনে করে না অথবা বিপদে পড়ে নেয়ামতকে চিনে, তাদের চিকিৎসা এই যে, তারা নিজের চেয়ে কম অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে এবং জনৈক সূফী যা করতেন, তা করবে। তিনি প্রত্যহ একবার হাসপাতালে ও একবার গোরস্তানে গমন করতেন। হাসপাতালে গিয়ে অনেক মানুষকে নানা প্রকার রোগে আক্রান্ত দেখে নিজের সুস্থতা ও নিরাপত্তার কথা ধ্যান করতেন, যাতে সুস্বাস্থ্য যে একটি বড় নেয়ামত, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শোকর আদায় করা যায়। বুযুর্গ ব্যক্তি গোরস্তানে গিয়ে কল্পনা করতেন যে, মৃতরা একদিনের জন্যে হলেও পৃথিবীতে ফিরে আসাকে সর্বাধিক পছন্দ করে। গোনাহগার অতীত দিনের ক্ষতিপূরণ করার জন্যে আর নেককার আরও বেশী নেকী করার জন্যে এটা পছন্দ করে। এরপর তিনি ভাবতেন যে, যার জন্যে তারা পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়, তা তো আমার অর্জিত আছে।

অর্থাৎ, আমি অতীত দিনের ক্ষতিপূরণ এবং অধিক নেকী অর্জন এই মুহূর্তে করতে পারি। সুতরাং জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো আমি এ কাজেই ব্যয় করি না কেন? এ দিনগুলোকেই আমি আল্লাহর নেয়ামত মনে করে নেই না কেন?

এ চিকিৎসায় আশা করা যায়, গাফেল ব্যক্তি আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে অবগত হয়ে শোকরে তৎপর হবে। হযরত রবী ইবনে খায়ছাম (রহঃ) পরিপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন । তিনি নিজের ঘরে একটি কবর খনন করেছিলেন। প্রত্যহ গলায় বেড়ী পরে তিনি এই কবরে শয়ন করতেন এবং বলতেন- رب ارجعني لعلى اعمل صالحا অর্থাৎ, ইলাহী! আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর, যাতে আমি সৎকর্ম সম্পাদন করি ।

এরপর তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন এবং বলতেন : হে রবী, তোর প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে। তুই সেই সময়ের পূর্বে কিছু করে নে, যখন পুনরায় প্রেরণের আবেদন করবে কিন্তু তোকে প্রেরণ করা হবে না।

যে সকল অন্তর শোকর থেকে দূরে থাকে, একথা জেনে নেয়াও তাদের এক চিকিৎসা যে, যে নেয়ামতের শোকর আদায় করা হয় না, সে নেয়ামত বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তা পুনর্বার পাওয়া যায় না। এ কারণেই হযরত ফুযায়ল ইবনে আয়ায (রহঃ) বলেন : লোকসকল, তোমরা নেয়ামতসমূহের শোকর অবশ্যই কর। এটা বিরল যে, নেয়ামত একবার চলে যাওয়ার পর পুনরায় ফিরে এসেছে। জনৈক বুযুর্গ বলেন: নেয়ামতসমূহ বন্য পশুসদৃশ। এগুলোকে শোকর দ্বারা বন্দী করে রাখ। হাদীসে আছে—যখন কারও প্রতি আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত বেশী হয়, তখন তার প্রতি মানুষের প্রয়োজনও বেড়ে যায়। সে যদি এসব প্রয়োজন পূরণে অলসতা করে, তবে প্রকারান্তরে নেয়ামত হারিয়ে ফেলার প্রয়াস চালায় । আল্লাহ বলেন : إنَّ اللهَ لَا يُغَيرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِرُوا مَا بِأَنفُسِهِم অর্থাৎ, আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যে পর্যন্ত তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে ৷

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *