রমযান মাসের ফযিলত
রমযানের প্রাক্কালে
নবী কারীম সা. এর ভাষণ
রাসূল কারীম সা. ইরশাদ করেন: “লোক সকল! এক মহান মাস তোমাদের উপর ছায়াপাত করেছে।” (সহিহ ইবনু খুযায়মা, হাদীস নংঃ ১৮৮৭)
কী রকম মহান মাস, এর বিবরণ অন্য হাদীছে আছে। এটা এমন মাস যার জন্যে বেহেশতকে সারা বছর ধরে সুসজ্জিত করা হয়। এ মাসের প্রথম রাত যখন আগমন করে, তখন জান্নাতের তলদেশ থেকে একটি সুমধুর বাতাস বের হতে থাকে। যার প্রবাহে বেহেশতের পাতাপল্লব, ডালপালা ও দরজার কড়াসমূহ হেলতে থাকে। এতে এমন এক মনমুগ্ধকর ও হৃদয়স্পর্শী সুর উত্থিত হয় যে শ্রোতারা ইতোপূর্বে কখনো এরূপ আর শুনতে পায়নি। তখন অনিন্দ্য সুন্দর ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হুরগণ আত্মপ্রকাশ করে বেহেশতের বালাখানাসমূহের মধ্যে দণ্ডায়মান হয়ে ঘোষণা করতে থাকে, আল্লাহর কোন প্রিয়বান্দা আছে কি? যারা আমাদেরকে বিয়ে করার জন্যে আল্লাহ’র দরবারে দরখাস্ত করবে? এরপর তারা বেহেশতের দারোগা রেদওয়ানের নিকট জিজ্ঞেস করে, এটা কোন রাত্রি? উত্তরে তিনি বলেন, এটা রমাযানের প্রথম রাত্রি। এ কারণেই রাসূল কারীম সা. ইরশাদ করেন: “লোক সকল! এক মহান মাস তোমাদের উপর ছায়াপাত করেছে।” (সহিহ ইবনু খুযায়মা, হাদীস নংঃ ১৮৮৭)
রমযান মাসে শয়তানকে
শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়
রমযান মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ মাসে অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।
আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান উপস্থিত হয়, জান্নাতের
দরজাখুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুষ্ট শয়তানদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০৭৯)
এ মহান মাসে যাতে বান্দা অনায়াসে বাঁধাহীনভাবে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রশান্ত হৃদয়ে আল্লাহ’র ইবাদত করতে পারে, তার নেক ইচ্ছার মাঝে শয়তান যেন কোনরূপে বাঁধা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য এ মাসের শুরু হতেই আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল আমীনকে হুকুম দেন, জমিনে অবতরণ করে অহংকারী শয়তানকে শৃংখলবদ্ধ করে তার গলায় বেড়ি পরিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ কর, যাতে আমার বান্দাগণ নিষ্কণ্টকভাবে ইবাদতে মশগুল হতে পারে।
প্রশ্ন আসে যে, রমযান মাসে শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকলে মানুষ রমজানে কিভাবে পাপ করে?
এর বেশ কিছু জবাব হাদিস বিশারদরা দিয়েছেন।
এক.কাজি ইয়াজ (রহ.) বলেন, শয়তান শিকলে আবদ্ধ থাকার অর্থ আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থেই হতে পারে। রূপক অর্থে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রমজানে শয়তানের ধোঁকা-প্রবঞ্চনার হার কমে যায়, অন্যায় কাজ কম হয় এবং মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধান পালনের প্রতি আগ্রহ প্রবল থাকে। এ অর্থে উল্লিখিত হাদিসে বাস্তব জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যার বাস্তবতা আমরা সবাই স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে থাকি। (ইকমালুল মুলিম : ৪/৬)
আর আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করা হলে হাদিসের অর্থ হলো, মানুষ পাপ করে দুই কারণে—১. তার কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাসের কারণে; ২. শয়তানের প্ররোচনায়। রমজানে শয়তান বন্দি থাকলেও কুপ্রবৃত্তির কারণে মানুষ পাপ করে থাকে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)
দুই.আল্লামা আইনি (রহ.) বলেন, শয়তানকে ওই সব রোজাদার থেকে দূরে আবদ্ধ রাখা হয়, যারারোজার আদব ও শর্ত সঠিকভাবে পালন করে। কিন্তু যারা সেসবের ধার ধারে না, তাদের থেকে শয়তানকে আবদ্ধ না-ও রাখা হতে পারে। (উমদাতুল কারি : ১০/২৭০)
তিন.রমজানের আগে কৃত পাপের প্রভাবে মানুষ পাপ করে থাকে। যেমন একটি লোহা দীর্ঘক্ষণ আগুনে রাখার পর তা থেকে বের করা হলেও বেশ কিছুক্ষণ তার প্রভাব বাকি থাকে, একইভাবে গাড়ির চাকা দীর্ঘ সময় চলার পর থামানো হলেও কিছুদূর পর্যন্ত চলতে থাকে; ঠিক তেমনি ১১ মাসের পাপের প্রভাবে রমজানেও কারো কারো কাছ থেকে পাপ হয়ে থাকে।
চার.কোনো কোনো হাদিস ব্যাখ্যাকারী বলেছেন, রমজানে সব শয়তানকে বন্দি করা হয় না, অতিরিক্ত দুষ্ট শয়তানকে বন্দি করা হয়। তাই অন্য শয়তানদের প্ররোচনায় মানুষ পাপ করে। (ফাতহুল বারি : ৪/১১৪)
রমযান মাসের বৈশিষ্ট
ও সাওম পালনের ফযীলত
১.রোযার প্রতিদান আল্লাহ রাববুল আলামীন নিজেই দিবেন এবং বিনা হিসাবে দিবেন।
সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: “আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, কিন্তু সাওম ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সে আমার সন্তুষ্টির জন্য কামাচার ও পরিত্যাগ করে। সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাঁকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। সাওম পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম”।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১)
অন্যান্য আমলের সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ করার কথা বলা হলেও সাওমের ব্যাপারটি আলাদা। কেননা এর সাওয়াব সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ সাওমের সাওয়াব বহু গুণে দান করবেন। কেননা সাওম সবর তথা ধৈর্য থেকে এসেছে।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাদসড়াই”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০]
২.রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল সরূপ।
সরসহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “সাওম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সাওম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সাওম পালনকারী” (সহিহ বুখারী, হাদীস নং:১৯০৪।সহিহ মুসলিম,হাদীস নং:১১৫১)
শরাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী الجنة অর্থ ঢাল, যা দ্বারা ব্যক্তি আত্মরক্ষা করে, নিজেকে আড়াল করে এবং গুনাহে পতিত হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করে।
রোযা হল জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল, যুদ্ধ ক্ষেত্রে তোমাদের (শত্রুর আঘাত হতে রক্ষকারী) ঢালের মত।- মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬২৭৮; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২১২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৬৩৯
৩.রোযা দারের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
এটা এমন এক মহান মাস, যদি কেউ ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়াতে এ মাসে রোযা রাখে তাহলে তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়াতে, রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে (তারাবীহ) নামায পড়বে তারও জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
রাসূল সা. ইরশাদ করেন: “আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রমযান শরীফের রোযা ফরয করেছেন।আর রাতের নামায অর্থাৎ, তারাবীহকে আমি তোমাদের জন্য সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানী প্রেরণা ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে এ মাসে রোযা রাখবে এবং তারাবীহ নামায পড়বে, সে ব্যক্তি গুনাহ থেকে এরূপ মুক্ত হয়ে যাবে যেন আজই তার মা তাকে প্রসব করেছেন।” (সুনানে নাসায়ী,হাদীস নং:২২১০)
কত মহান, কত মুবারক এ মাস, যে মাসকে আল্লাহ বান্দাদের আমলের জন্য পুরোপুরি অনুকূলে করে দিয়েছেন এবং বাঁধসমূহ দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফরা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন, আর আমি কিয়ামুললাইল অর্থাৎ তারাবীহ’র নামাযকে সুন্নতকরেছি।সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের
আশায় রমযানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে, সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিনসে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্যভূমিষ্ঠ হয়েছিল। মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৬৬০, মুসান্নাফে ইবনেআবি শাইবা, হাদীস-৭৭৮৭, মুসনাদে বাযযার হাদীস-১০৪৮, সহীহ ইবনে খুযাইমা,হাদীস-২২০১,সুনানেনাসায়ী,হাদীস-২৫১৮
৪. রোযা হল জান্নাত লাভের পথ।
হযরত হুযায়ফা রা.বলেন, আমি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
আমার বুকের সাথে মিলিয়ে নিলাম, তারপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় একদিন রোযা রাখবে, পরে তার মৃত্যু হয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো দান-সদকা করে তারপর তার মৃত্যু হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। মুসনাদে আহমদ,হাদীস: ২৩৩২৪; মুসনা দেবা যযার,হা.২৮৫৪
হযরত আবু উমামা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের দরবারে আগমন করে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন,
যার দ্বারা আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব।তিনি বলেন, তুমি রোযা রাখ, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই।আমি পুনরায় তার নিকট এসে একই কথা বললাম।তিনিবললেন,তুমিরোযারাখ।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস:২২১৪৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস:১৮৯৩; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস:৩৪২৬; সুনানে নাসায়ী,হাদীস:২৫৩০
৫.রোযা দারের দুআ কবুল হয়
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ইফতারের সময় রোযাদার যখন দুআ করে, তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না (অর্থাৎ তার দুআ কবুল হয়) সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস :- ১৭৫৩
হযরত আবু হুরায়রাহতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন
তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয়না (অর্থাৎ তাদের দুআ কবুল করা হয়) ন্যায়পরায়ন শাসকের দুআ; রোযাদার ব্যক্তির দুআ ইফতারের
সময় পর্যন্ত ও মজলুমের দুআ। তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেওয়া
হয় এবং এর জন্য সব আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, আমার ইয্যতের কসম! বিলম্বে হলেও অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করব। মুসনাদে আহমদ,হাদীস:৮০৪৩;সুনানে তিরমিযী,হাদীস:৩৫৯৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস:১৭৫২; সহীহ ইবনে হিববান,হাদীস:৩৪২৮
হযরত আবু হুরায়রা রা. র্বণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না**।** মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা, হাদীস:৮৯৯৫.
৬.রোযা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।- ( মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৬২৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ২০৮০; বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদীস : ১৯৯৪)
লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)
মাশা-আল্লাহ
اللهم زد فزد
শুকরান