সাহাবাদের মুক্ত তাকলীদ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রিয় সাহাবাদের সোনালী যুগেও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সুপ্রমাণিত তাকলীদের উপর ব্যাপক আমল বিদ্যমান ছিল। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)-এর মধ্যে যাদের ইলম অর্জনের পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ ছিল না, কিংবা যাদের ইজতিহাদ প্রয়োগের ক্ষমতা ছিল না তারা নির্দ্বিধায় ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবাদের শরণাপন্ন হয়ে তাদের ইজতিহাদ মোতাবিক আমল করে যেতেন।
মোটকথা, সাহাবাদের স্বর্ণযুগে মুক্ত তাকলীদ ও ব্যক্তি তাকলীদ উভয়েরই প্রচলন ছিল।
বিশেষ করে মুক্ত তাকলীদের এত অসংখ্য নযীর বা উদাহরণ রয়েছে যে, তার সংক্ষিপ্ত সংগ্রহও এক বৃহৎ গ্রন্থের আকার ধারণ করবে। পরিসরের কথা বিবেচনা করে কয়েকটি মাত্র নযীর এখানে তুলে ধরা হল।
প্রথম নযীর :
তরজুমানুল কুরআন হিবরুল উম্মাহ রাঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন- عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ خَطَبَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهِ تَعَالَى عَنْهُ النَّاسَ بِالْحَابِيَةِ فَقَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ مَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ فَلْيَاتِ أَبَيَّ بْنَ كَعْبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنْ الْفَرَائِضِ فَلْيَأْتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ رَضِيَ اللَّهِ تَعَالَى عَنْهُ وَمَنْ أَرَادَ أن يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَاتِ مَعَاذَ بْنَ جَبَلٍ رَضِيَ الله تَعَالَى عَنْهُ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلْيَأْتِنِي فَإِنَّ اللَّهَ جَعَلَنِي لَهُ وَالِياً وَقَاسِماً .
“জাবিয়া নামক স্থানে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাযি.) একবার খুৎবা তে গিয়ে বললেন, হে লোক সকল! কুরআন তথা ইলমুল কিরা’আত সম্পর্কে আমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে উবাই ইবনে কা’বের কাছে, ফারায়িয সম্পর্কে কিছু জানতে হলে যায়েদ ইবনে সাবিতের কাছে, আর ফিকাহ সম্পর্কে কিছু জানতে হলে মু’আয ইবনে জাবালের কাছে যাবে। তবে অর্থ-সম্পদ সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলে আমার কাছেই আসবে। কেননা, আল্লাহ তা’আলা আমাকে এর বণ্টন ও তত্ত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত করেছেন। তাবরানী, আওসাত ৪/৩৬৯, মাকতাবাতুল মা’আরিফ, রিয়াদ, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/১৩৫ ।
এ খুৎবায় হযরত ওমর (রাযি.) তাফসীর, ফিকাহ ও ফারায়িয বিষয়ে সকলকে বিশিষ্ট তিনজন সাহাবায়ে কিরামের মতামত অনুসরণের উপদেশ দিয়েছেন। আর এটা বলাই বাহুল্য যে, মাসায়িলের উৎস ও দলীল বোঝার যোগ্যতা সবার থাকে না। সুতরাং খলীফার নির্দেশের অর্থ হল, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পন্ন লোকেরা তিনজন সাহাবীর খেদমতে গিয়ে মাসায়িল ও দালায়িল (সিদ্ধান্ত ও উৎস) উভয় ইলম হাসিল করবে। আর যাদের সে যোগ্যতা নেই তারা শুধু মাসায়িলের ইলম হাসিল করে সে মোতাবিক আমল করবে। তাকলীদও এর অতিরিক্ত কিছু নয়। তাই সাহাবায়ে কেরামের যুগে আমরা দেখতে পাই, যাদের ইজতিহাদী যোগ্যতা ছিল না তারা নিঃসংকোচে ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবাদের শরণাপন্ন হতেন এবং বিনা দলীলেই তাদের সিদ্ধান্ত মেনে সে মোতাবেক আমল করে যেতেন।
দ্বিতীয় নযীর :
হযরত সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন- عن سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللهِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ الله تَعَالَى عَنْهُمَا أَنَّهُ سُئِلَ عَنِ الرَّجُلِ يَكُونُ لَهُ الدِّينُ عَلَى الرَّجُلِ إِلَى أَجَلٍ فَيَضَعُ عَنْهُ صَاحِبُ الْحَقِّ وَيُعَجِّلُهُ الْآخَرُ كَرِهَ ذَلِكَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا وَنَهَى عَنْهُ.
“আব্দুল্লাহ ইবনে উমরকে একবার মাসআলা জিজ্ঞেস করা হল, প্রথম জন দ্বিতীয় জনের কাছে মেয়াদী ঋণের পাওনাদার। আর সে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে পরিশোধের শর্তে আংশিক ঋণ মওকূফ করে দিতে সম্মত হয়েছে। (এ ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ কি?) হযরত ইবনে উমর (রাযি.) অপসন্দ করে তা নিষেধ করে দিলেন।মুয়াত্তা মালিক ২৭৯।
এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ নির্দেশ সম্বলিত কোন মারফু হাদীস না থাকায় নিশ্চয় ধরে নেয়া যায় যে, এটা হযরত ইবনে উমর (রাযি.)-এর নিজস্ব ইজতিহাদ। অথচ তিনি যেমন তার সিদ্ধান্তের পক্ষে কোন দলীল-প্রমাণ পেশ করেননি, তেমনি প্রশ্নকারীও তা তলব করেননি। আর শরীয়তের পরিভাষায় বিনা দলীলে মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমল করার নামই হল তাকলীদ।
তৃতীয় নযীর :
হযরত আব্দুর রহমান (রহ.) বলেন- عَنْ عَبْدُ الرَّحْمَنِ قَالَ سَأَلْتُ مُحَمَّدَ بْنَ سِيْرِينَ عَنْ دُخُولِ الْحَمَّامِ فَقَالَ كَانَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ يَكْرَهُهُ .
হযরত আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রাযি.) থেকে আমি হাম্মাম খানায় গোসলের বৈধতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে শুধু তিনি বললেন, হযরত উমর (রাযি.) এটা অপছন্দ করতেন।
দেখুন, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহ.) প্রশ্নকারীর উত্তরে হাদীস উল্লেখ না করে হযরত উমর (রাযি.)-এর অপছন্দের কথা জানিয়ে দেয়াই যথেষ্ট মনে করেছেন। অথচ এ সম্পর্কে এমনকি হযরত উমর (রাযি.)-এর বর্ণিত মারফূ’হাদীসও রয়েছে।
চতুর্থ নযীর:
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنَ يَسَارٍ أَنَّ أَبَا أَيُّوبَ الْأَنْصَارِي رَضِيَ اللهُ عَنْهُ خَرَجَ حَاجَاً حَتَّى إِذَا كَانَ بِالنازية مِنْ طَرِيقِ مَكَّةَ أَضَلَّ رَوَاحِلَهُ وَإِنَّهُ قَدِمَ عَلَى عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ الله تَعَالَى عَنْه يَوْمَ النَّحْرِ فَذَكَرَ ذلك لَهُ فَقَالَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ اِصْنَعْ مَا يَصْنَعُ الْمُعْتَمِرُ ثُمَّ قَدْ حَلَلْتَ فَإِذَا أَدْرَكَكَ الْحَج قَابِلا أَحْحُجْ وَاهْدِ مَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْي.
“আবূ আইয়ূব আনসারী (রাযি.) একবার হজ্ব সফরে রওয়ানা হলেন। কিন্তু মক্কার পথে নাযিয়া নামক স্থানে তার সওয়ারী খোয়া গেল। ফলে যিলহজ্বের দশ তারিখে (হজ্ব হয়ে যাওয়ার পর) তিনি হযরত উমর (রাযি.)-এর খেদমতে এসে পৌঁছলেন। ঘটনা শুনে হযরত উমর বললেন, এখন তুমি ওমরা করে নাও। এভাবে আপাতত হজ্বের ইহরাম থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে। তবে আগামী বছর সামর্থ অনুযায়ী কুরবানীসহ হজ্ব আদায় করে নিও। এখানে দেখা যাচ্ছে, হযরত উমর (রাযি.) প্রয়োজনীয় দলীল উল্লেখ না করে ফতওয়া বা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রাযি.)ও খলীফার ইলম ও প্রজ্ঞার উপর পূর্ণ আস্থার কারণে বিনা দলীলে সন্তুষ্টচিত্তে তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।