শিরক কাকে বলে ও শিরক কত প্রকার
শিরক কি ও শিরক কত প্রকার
শিরক কাকে বলে? কুরআন ও হাদিসের আলোকে শিরক কি ও কত প্রকার তা নিয়ে আজকে আমরা আলোচনা করবো।আল্লাহর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতায় অন্য কাউকে অংশীদার বলে বিশ্বাস করাকে শিরক বলে।
শিরক অর্থ কি :
আরবী অভিধানে শিরক (شرك) শব্দটি বহুবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, شرك (شرك وشركة)
অর্থ: অংশ নেওয়া, অংশগ্রহণ করা, অংশীদার হওয়া, শরীক হওয়া।
দ্বিতীয়ত – الشَّرْكَةُ وَالشَّرِكَةُ । অর্থ হলো: দুই শরীকের সংমিশ্রণ।
তৃতীয়ত- الشرك । অর্থ হলো: অংশ, অংশীদার, অংশীদারত্ব। এর বহুবচন হলো أشراك এবং شركاء
শিরক কাকে বলে :
দুটি সংজ্ঞা নিম্নে পেশ করা হল:
١ – هو مساواة غير الله بالله فيما هو حق لله.
অর্থাৎ, ‘গায়রুল্লাহ্কে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ সাব্যস্ত করা।’
٢ – أن يجعل الإنسان نصيبا لأحد مع الله تعالى في أمر لا يكون إلا لله وحده .
অর্থাৎ, ‘আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট ও সীমাবদ্ধ বিষয়াদীর কোন অংশ মানুষ কর্তৃক আল্লাহ ছাড়া অন্য করো জন্য সাব্যস্ত করা তাকে শিরক বলে’
শিরক কত প্রকার :
চার প্রকার। যথা:-
(১) ফিয যাত
(২) ফির রুবুবিয়্যাহ্
(৩) ফিল উলুহিয়্যাহ্
(৪) ফিল আসমা ওয়াস সিফাত
নিম্নে এগুলোর পরিচয় সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:
১. ফিয যাত শিরক কাকে বলে :
এর অর্থ হলো আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে শিরক। আল্লাহ্ এক, তাঁর কোনো শরীক নেই, তাঁর কোনো সন্তান নেই। আল্লাহ্ ব্যতীত আরো ইলাহ, রব আছে বলে বিশ্বাস করা, আল্লাহর সন্তান, বিবি আছে বলে ‘আকীদা পোষণ করা, আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত।
২.ফির রুবুবিয়্যাহ্ শিরক কাকে বলে :
আল্লাহর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতায় অন্য কাউকে অংশীদার বলে বিশ্বাস করা। আল্লাহর কাজে অন্যকে শরীক করা। যেমন: সৃষ্টি করা, জীবন-মৃত্যু দেয়া, বিপদ থেকে উদ্ধার করা, আইন দেয়া, আসমান জমিন পরিচালনা করা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। এ সমস্ত বিষয়ে অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরিক করা হলো আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে শিরক।
যদি কেউ বিশ্বাস পোষণ করে যে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ বাঁচাতে পারে, সন্তান দিতে পারে, তাহলে সে আল্লাহর সাথে রুবুবিয়্যাহ এর ক্ষেত্রে শরীক করল। এমনিভাবে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে আইনদাতা বা বিধাতা বলে বিশ্বাস করা। প্রত্যেক শহর চালানোর জন্য একজন শহর কুতুব আছেন, যিনি শহর পরিচালনা করেন এ কথা বিশ্বাস করা। এ সমস্ত বিশ্বাসই আল্লাহর রুবুবিয়্যাহ এর ক্ষেত্রে শরীক করার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ বলেন, أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗঅর্থাৎ, “জেনে রাখুন সৃষ্টি ও হুকুম একমাত্র তাঁরই।” (আল ‘আরাফ:৫৪)
৩. ফিল উলুহিয়্যাহ্ শিরক কাকে বলে :
‘ইবাদাতে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করার নাম হচ্ছে শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ্। এটাকে শিরক ফিল উবূদিয়্যাহ বা শিরক ফিল ‘ইবাদাহও বলা হয়। এটাই হলো মূল শিরক। জাহেলি যুগে এ শিরকই প্রচলিত ছিল। আল্লাহ তা’আলা নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন মূলত: তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্ এর প্রতি দাওয়াত দেওয়া এবং শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ্কে নিষেধ করার জন্য।
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ۖ
অর্থাৎ, “আল্লাহর ইবাদাত করা ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।” (আন নাহল: ৩৬)
ফিল উলুহিয়্যাহ্ দুই প্রকার :
শিরকে আকবার বা বড় শিরক কাকে বলে :
আল্লাহর সাথে কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা। এর মাধ্যমে মুমিন ঈমান থেকে বের হয়ে চিরজাহান্নামী হয়ে যায়। তাওবা ব্যতীত তার মুক্তির কোনো উপায় থাকে না। যেমন: মাজার-কবর ও মূর্তি কেন্দ্রিক শিরক, গায়রুল্লাহর নামে জবাই করা ও মানত করা, গায়রুল্লাহ্কে ডাকা, গায়রুল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা, গায়রুল্লাহর নামে শপথ করা।
ভয়, আশা, তাওয়াক্কুল ও মুহাব্বতের ক্ষেত্রে শিরক, আইন প্রণয়ন, আনুগত্য ও দুনিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে শিরক, জাদু বিদ্যা ও জাদুকর, আররাফ, জ্যোতিষ, কু-লক্ষণে বিশ্বাস, নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস, বিপদ-আপদ থেকে বাঁচার জন্য তাগা, তাবিজ, সুতা, আংটি, ব্রেসলেট ইত্যাদি ব্যবহার করা। রাসূলুল্লাহ- সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সৃষ্টির ‘আকীদায় শিরক, নবী-রাসূল বা ওলীগণ সর্বত্র হাজির হতে পারেন বলে বিশ্বাস।
শিরকে আসগার বা ছোট শিরক কাকে বলে :
এটিকে الشرك الخفي বা গোপন শিরকও বলা হয়। এ ধরণের শিরকের দ্বারা তাওহীদে ত্রুটি সৃষ্টি হয় এবং কখনো কখনো তা বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ- সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম- সতর্ক করে বলেছেন, الشرك أخفى من دبيب النملঅর্থাৎ, “শিরক হলো পীপিলিকার ধীরগতির চলার চেয়েও আরো গোপন।” (মুসনাদে আহমাদ, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৪০৩)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “শিরক হলো রাতের আঁধারে কালো মসৃণ পাথরের উপর পীপিলিকার মন্থর গতির চেয়েও আরো সূক্ষ্ম।” (মুসনাদে আহমাদ, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ৪০৩)
কতিপয় ছোট শিরকের উদাহরণ হলো: রিয়া বা লোক দেখানো ‘আমল, সুম’আ বা সুখ্যাতি অর্জনের জন্য ‘আমল, দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে ‘আমল, “لو” বা যদি শব্দের ব্যবহার করে কথা বলা। কোনো কথায় আল্লাহর ইচ্ছার সাথে অন্যের ইচ্ছাকে শরীক করা। যেমন: ما شاء الله وشئت.
৪. শিরক ফিল আসমা ওয়াস সিফাত: আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে কাউকে অংশিদার মনে করা শিরক।এই গুনবাচক নাম দুই প্রকার। যথা:ক. আল্লাহর সত্তাগত নাম: কতিপয় আল্লাহর সত্তাগত নাম রয়েছে। এই নামগুলো অন্য কারো নামকরণ করা হলে, তা হবে আল্লাহর সত্তাগত নামের সাথে শিরক।খ. আল্লাহর গুণবাচক নাম: কিছু গুণবাচক নাম আল্লাহর রয়েছে। এই গুণবাচক নামের শিরক হলো দুই প্রকার। যথা:
প্রথম প্রকার: এমন সমস্ত গুণ যা আল্লাহর মাঝেও রয়েছে এবং মাখলুকের মাঝেও রয়েছে। যেমন: দেখা, শোনা, শক্তি, ক্ষমতা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মাখলুকের গুণাবলিকে আল্লাহর গুণাবলির সাথে তুলনা করা হলে, আল্লাহর গুণাবলিতে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত হবে।দ্বিতীয় প্রকার: যে সমস্ত গুণ আল্লাহর জন্য নির্ধারিত, সে সমস্ত গুণে অন্য কাউকে গুণান্বিত করা। যেমন: গায়েব জানা একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট্য। অন্য কেউ গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা আল্লাহর গুণাবলিতে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত হবে।
তথ্যসূত্র: