শবে বরাতের তাৎপর্য ও প্রামাণ্যতা
পবিত্র রমজানের আগের মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিনগত রাত ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ।
শব্দ দুটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। বরাত আরবি ‘বারাআতে’র সমশব্দ। যার অর্থও মুক্তি। পবিত্র কোরআনেও ‘বারাআত’ শব্দটি মুক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই শবে বরাত অর্থ হবে মুক্তির রাত। কিন্তু হাদিস শরিফে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়নি; বরং একে বলা হয়েছে–‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য রজনী’।
সূচীপত্র
১। শবে বরাতের তাৎপর্য
২। প্রশ্ন-উত্তর
৩। শবে বরাত নিয়ে হক্কানী ওলামাদের মন্তব্য
১. শবে বরাতের তাৎপর্য
الحمد لله رب العالمين والعاقبة المتقين والصلاة و السلام على رسوله الكريم وعلى اله وأصحابه أجمعين، أما بعدا فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم
শা’বান মাস শুরু হয়ে গেছে। এ মাসে একটি বরকতময় রাত রয়েছে । যা আমরা ‘শবে বরাত’ নামে জানি। কারো কারো ধারণা- এই রাতের কোনো ফযীলত কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নেই। এই রাতের ইবাদত বন্দেগীকে বিশেষ ফযীলতের মনে করা ভিত্তিহীন। বরং কেউ কেউ তো তা বিদ’আত বলেও আখ্যায়িত করেন। এসব কারণে সাধারণ মানুষের মনে এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে । তাই এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি ।
আনুগত্যের নাম দ্বীন
এ বিষয়ে আপনাদের নিকট আমার সংক্ষিপ্ত আবেদন হল, আমি বার বার বলে আসছি; যে বিষয়টি কুরআন হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের আমলে নেই, সেই বিষয়কে দ্বীনের অংশ মনে করা বিদ’আত । এ কথাও বলে আসছি যে, নিজের পক্ষ থেকে একটা পথ অবলম্বন করার নাম দ্বীন নয়। দ্বীন হল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের নাম। সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণের নাম এবং তাবেঈন ও বুযুর্গানে দ্বীনের অনুকরণের নাম। এখন বাস্তবেই যদি একথা ঠিক হয় যে, কুরআন হাদীসে বা সাহাবায়ে কেরামের আমলে এই রাতের কোনো ফযীলত প্রমাণিত নেই, তাহলে তো অবশ্যই তা বিদ’আত হবে। যেমন শবে মে’রাজের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তাতে বিশেষ কোনো ইবাদত বা ফযীলতের কথা শরীয়তে প্রমাণিত নেই। এই রাতের ফযীলত ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হল, শবে বরাত সম্পর্কে এমন কথা বলা একেবারেই ঠিক নয় যে, এর কোনো ফযীলত কুরআন হাদীসে প্রমাণিত নেই । অন্তত দশজন সাহাবী থেকে এমন হাদীস বর্ণিত আছে, যেগুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে বরাতের ফযীলত বর্ণনা করেছেন । কিছু হাদীস সনদের দিক থেকে দুর্বল; কোনো সন্দেহ নেই এবং এ কারণেই কেউ কেউ বলে দিয়েছেন এই রাতের ফযীলত সম্পর্কে কিছু প্রমাণিত নেই। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ফুকাহায়ে কেরামের ফয়সালা হল, কোনো বর্ণনা যদি দুর্বলও হয়, কিন্তু তার সমর্থনে যদি অনেকগুলো বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহলে তার দুর্বলতা থাকে না। আর আমি আগেই বলেছি, এই রাতের ফযীলতের বিষয়টি দশজন সাহাবী থেকে বর্ণিত । সুতরাং দশজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হওয়ার পরও এর ফযীলতকে ভিত্তিহীন বলা সম্পূর্ণ ভুল কথা ।
খাইরুল কুরুনে শবে বরাত
মুসলিম উম্মাহর খাইরুল কুরুন তথা সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে- তাবেঈদের যুগেও গুরুত্বসহকারে এই রাতের ফযীলতের উপর আমল করার চেষ্টা করা হত । সুতরাং তা ভিত্তিহীন বলা ঠিক নয় । সহীহ কথা হল, এটি ফযীলতপূর্ণ রাত এবং এতে রাত জেগে বেশি ইবাদত বন্দেগীর বিশেষ গুরুত্ব শরীয়তে প্রমাণিত ।
বিশেষ কোনো ইবাদত নির্ধারিত নেই
অবশ্য এ কথা ঠি যে, এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদত বা ইবাদতের বিশেষ কোনো পদ্ধতি নির্ধারিত নেই । যেমন কিছু লোক নিজ থেকে মনগড়া আবিষ্কার করে বলে, এই রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে অমুক অমুক সূরা এতবার পড়ে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করলে, বিশেষ সওয়াব ও ফযীলত পাওয়া যাবে । এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; শরীয়তের কোনো দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় । এ রাতে যে কোনো নফল ইবাদত যত বেশি করা যায় । নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির আযকার, তাসবীহ তাহলীল, দু‘আ দরূদ ইত্যাদি যত বেশি করা যায় ভালো । তবে বিশেষ কোনো পদ্ধতির বা বিশেষ কোনো ইবাদতের কথা প্রমাণিত নেই । এই রাতে কবর যিয়ারত হাঁ, এ রাতের আরেকটি আমলও প্রমাণিত আছে। রাসূলে কারীম গিয়েছিলেন । তাঁর এই আমলের অনুসরণকে গুরুত্ব দিয়ে মুসলমানরাও সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে জান্নাতুল বাকীতে তাশরীফ নিয়ে। রাতে কবর যিয়ারতে যায় । কিন্তু আমার মুহতারাম আব্বাজান হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. এ বিষয়ে মনে রাখার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলতেন। তিনি বলতেন, যেই আমল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেই স্তরে প্রমাণিত, তাকে সেই স্তরেই রাখা জরুরি । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো জীবনে একবারই শবে বরাতে জান্নাতুল বাকীতে যাওয়ার কথা প্রমাণিত আছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৪৮২৫)
সুতরাং আমরাও যদি জীবনের কোনো এক শবে বরাতে কবর যিয়ারত করে নেই, তবে তো ঠিক আছে; কিন্তু প্রত্যেক শবে বরাতেই গোরস্তানে যাওয়া এবং এটাকে শবে বরাতের অবিচ্ছেদ্য ও জরুরি অংশ মনে করা মানেই তাকে তার মর্যাদা থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া । এটা আসলে দ্বীনের সহীহ ফিক্হ ও বুঝের কথা নয়। যেই বিষয়টাকে শরীয়ত যেই স্তরে রেখেছে, সেটাকে সেই স্তরে রেখে অন্যান্য নফল আমল বেশি বেশি করুন ।
নফল নামায ঘরে আদায় করুন
শুনেছি অনেকে এই রাতে এবং কদরের রাতে নফল নামাযের জামা‘আত করে । এক সময় শুধু সবিনা পড়া হত । এখন শুনছি সালাতুত তাসবীহেরও জামা’আত শুরু হয়েছে । সালাতুত তাসবীহের জামা’আত তো কোনো সময়ের জন্যই প্রমাণিত নেই; নাজায়েয। এ সম্পর্কে একটি নীতি শুনে রাখুন । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফরয নামায (এবং যেসব নামায রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা’আতের সঙ্গে আদায় করেছেন বলে প্রমাণিত; যেমন তারাবী, কুসূফ ইত্যাদি— তা) ছাড়া সকল নফল নামাযের ক্ষেত্রে উত্তম হল, ঘরে আদায় করা। শুধু ফরয নামাযের বৈশিষ্ট্যই হল, তা জামা’আতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করা সুন্নত; বরং প্রায় ওয়াজিব পর্যায়ের সুন্নত । কিন্তু সুন্নত ও নফল নামায মূলত ঘরে পড়াই উত্তম । কিন্তু ফুকাহায়ে কেরাম যখন দেখলেন, ঘরে চলে গেলে অনেকেই সুন্নত ছেড়ে দিচ্ছে, তখন তাঁরা বললেন সুন্নত ছেড়ে দেয়ার আশঙ্কা থাকলে মসজিদেই পড়ে নিবে । অন্যথায় নফল নামায যে ঘরে আদায় করা উত্তম, তার উপর সকল ফুকাহায়ে কেরামের ইজমা রয়েছে। আর নফল নামাযের জামা‘আত হানাফী মাযহাবে মাকরূহে তাহরীমী ও নাজায়েয । তাতে সওয়াব তো ‘দূর কি বাত’ উল্টা গোনাহ হবে।
ফরয নামায জামা’আতের সঙ্গে আদায় করুন
আসলে ফরয নামায হল দ্বীনের শেয়ার তথা নিদর্শন পর্যায়ের বিধান। এজন্য তা জামা’আতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করা জরুরি । কেউ যদি চিন্তা করে, জামা’আতের সঙ্গে মসজিদে নামায আদায় করলে আমার মধ্যে রিয়া ও লৌকিকতা আসবে, সুতরাং আমি লৌকিকতা থেকে বাঁচার জন্য নির্জনে ঘরেই নামায আদায় করি, তবে তা জায়েয হবে না । তাকে বলা হবে, তুমি মসজিদে গিয়ে নামায আদায় কর । কারণ এর উদ্দেশ্য হল, ইসলামের শেয়ার ও নিদর্শন এবং বিজয় ও প্রভাব প্রদর্শন করা । অতএব তা মসজিদে গিয়েই আদায় কর
নফল নামাযে নির্জনতা কাম্য
পক্ষান্তরে নফল এমন একটি ইবাদত, যার সম্পর্ক একমাত্র নফল আদায়কারী-বান্দা ও তার পরওয়াদেগারের সঙ্গে । তা একমাত্র আবেদ ও মাবুদের মুয়ামালা । যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা যখন তাঁকে তাহজ্জুদের তিলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কেন এত আস্তে তিলাওয়াত কর? তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
قد أسمعت من تاجيت
আমি তো আমার তিলাওয়াত তাঁকে শোনাচ্ছি, যাঁর সঙ্গে আমার মুনাজাত ও অভিসার চলছে । তিনি তো আরো আস্তে তিলাওয়াত করলেও শোনেন ।
বোঝা গেল, নফল ইবাদতের প্রকৃতিই হল বান্দা ইবাদত করবে, আর আল্লাহ জানবেন । মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অনুপ্রবেশ হবে না। আল্লাহ চান, বান্দা নির্জনে সরাসরি আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করুক। এজন্য নফল নামাযে জামা’আত মাকরূহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। নফলের মাধ্যমে নির্জনে নিবৃত্তে বান্দা সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম করবে । একটু চিন্তা করে দেখুন! এটা আল্লাহর কত বড় নেয়ামত বান্দার প্রতি! তিনি বান্দাকে সম্পূর্ণ নির্জনে তাঁর সান্নিধ্য লাভে সৌভাগ্যবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং আহ্বান করছেন, এসো বান্দা! নফল ইবাদতের মাধ্যমে নির্জনে একাকী আমার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হও।
নির্জনে আমার কাছে আস
দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের একটি সাধারণ সভা থাকে । ফরয নামাযের জামা’আতটি আল্লাহর সেরকমই একটি সাধারণ সভা । আরেকটি থাকে। বিশেষ নির্জন ও খাস সভা। এটা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত যে, বান্দার মতো নগণ্যকে ডাকছেন, তুমি যখন আমার সাধারণ সভায় হাজির হচ্ছ, তো এখন আমি তোমাকে আমার বিশেষ সভায় বিশেষ সান্নিধ্যের সুযোগ দিচ্ছি । আমি নির্জনে খাস মজলিসে একান্ত তোমার মতো করেই তোমার কথা শুনব। এখন যদি কেউ আল্লাহর সঙ্গে তার এই খাস মুহূর্তকে আম করে দেয় এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নফল নামাযের জামা’আত করে, তবে তো সে এই নেয়ামতের অবমূল্যায়ন করল । আল্লাহ বলছেন, আস বান্দা! একা শুধু তোমার সঙ্গেই আমি খাসভাবে কথা বলব; তোমার কথা শুনব; তোমাকে দান করব । কিন্তু আমি বোকার মতো এক বিশাল দলবল নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হচ্ছি!
তুমি এই নেয়ামতের অবমূল্যায়ন করলে!
যেমন তুমি কোনো বাদশাহর সাক্ষাতপ্রার্থী হলে । বাদশাহ বললেন, আজ রাত ন’টায় তুমি একা আমার কাছে চলে আসবে। তোমার সঙ্গে আমার একান্ত কিছু কথা আছে । রাত ন’টা বাজে তুমি তোমার বন্ধু বান্ধবদের এক বড় কাফেলা নিয়ে বাদশাহর কাছে উপস্থিত হলে । এবার বল তো তুমি বাদশাহর সুযোগদানের মূল্যায়ন করলে, না অবমূল্যায়ন করলে? তিনি তো তোমাকে একা যেতে বলেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে তোমাকে খাস কথা বলার ও শোনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন । তোমার উচিত ছিল, খাস সুযোগটা গ্রহণ করে তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু তুমি তা না করে দলবল নিয়ে উপস্থিত হলে এবং জীবনের সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়া করলে । এজন্য হযরত ইমাম আবু হানীফ রহ. বলেন, এভাবে নফল নামাযের অবমূল্যায়ন করো না। নফল নামাযের মূল্যায়ন হল, তুমি আর তোমার নফল ইবাদত আছে, সব একা নির্জনে আঞ্জাম দাও । তাতে জামা’আত করো না; জামা’আত মাকরূহ । কারণ আল্লাহ ডেকে বলছেন-
ألا هل من مستغفر فأغفر له
‘আছো কোনো ক্ষমাপ্রার্থী! আস আমি তোমাকে ক্ষমা করব (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৬৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৮৬১৬)
এখানে আরবী مستغفر শব্দটি (মুফরাদ) তথা একবচন ব্যবহৃত হয়েছে । যার অর্থ দাঁড়ায়, আছো কেউ নির্জনে একা আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আমি তাকে ক্ষমা করব? আল্লাহ আমাকে ডাকছেন একা যাওয়ার জন্য; আর আমি আলোকসজ্জা করে; মাইকিং করে গণজমায়েতের ব্যবস্থা করছি । বস্তুত এটা আল্লাহর নেয়ামতের সাক্ষাৎ অবমূল্যায়ন । সুতরাং সাবনা, সালাতুত তাসবীহ কিংবা অন্য যে কোনো নফল ইবাদতের জমায়েতই না জায়েয ।
একাকিত্বের মুহূর্ত
এই ফযীলতপূর্ণ রাতগুলো হৈ-হুল্লোড়, সভা সমাবেশ কিংবা মেল জমানোর সময় নয় । এই সময়গুলো তো একাকী বসে আল্লাহর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক গড়ার সময় । এখানে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে তৃতীয় কোনো সত্বার উপস্থিতি ও অবগতির অবকাশ নেই ।
আশেক মাশুকের মাঝে কি হবে, তা তো কেরামান কাতেবীনও জানবে না । অনেকে বলে, একা একা ইবাদত করতে বসলে ঘুম এসে যায়। মসজিদে সবিনা হয়; আলোকসজ্জা থাকে; লোকজনের সমাগম থাকে, ফলে ঘুমের গাফলত থেকে বাঁচা যায়।
আরে ভাই বিশ্বাস কর! নির্জনে আল্লাহর সান্নিধ্যে যদি তুমি একটি মুহূর্তও অতিবাহিত কর, তবে তা তোমার সেই বিনিদ্র রাত থেকে হাজার গুণ ভালো, যা তুমি মেলা সমাবেশে কাটিয়েছ । কারণ এই মুহূর্তটি তুমি সুন্নত মোতাবেক অতিবাহিত করেছ, আর মেলায় যে সময় কাটিয়েছ; তা মুহূর্তের সমান হতে পারে না, যা তুমি ইখলাসের সঙ্গে লৌকিকতা পরিহার সুন্নতপরিপন্থী কাটিয়েছ । সুতরাং এই পূর্ণ রাতটি কখনো তোমার সেই করে আল্লাহর নির্জন সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেছ ।
সেখানে ঘণ্টার হিসাব হয় না
আমি সবসময় বলি, নিজের বুদ্ধিতে কাজ করা কিংবা মনের শখ ও চাহিদা পূরণ করার নাম দ্বীন নয়; বরং আল্লাহর নির্দেশ পালন ও তাঁর আনুগত্যের নাম দ্বীন। বলুন তো আল্লাহ কি আপনার ঘণ্টা হিসাব করে দেখবেন, কত ঘণ্টা আপনি মসজিদে অবস্থান করেছেন? তিনি ঘণ্টা হিসাব সঙ্গে আল্লাহর সান্নিধ্যে কাটানোর তাওফীক হয়ে যায়, তবে তা-ই পরকালের নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। পক্ষান্তরে আপনি যদি সুন্নতপরিপন্থী ইবাদতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন, তবে নাজাত তো দূরের কথা; তাতে আপনার এক পয়সার সওয়াবও হবে না।
ইখলাসই কাম্য
আমার শায়েখ ডাক্তার আব্দুল হাই আরেফী রহ. আমলের পরিমাণের পরিবর্তে মানের মূল্য আলোচনা করতে গিয়ে বলতেন, তোমরা যখন সেজদায় যাও তখন কতবার বল “সুব্বহানা রব্বিয়াল আ’লা” কিন্তু তখন যবান মেশিনের মতো উচ্চারণ করে যায়; খেয়াল করা হয় না। পক্ষান্তরে এই বাক্যটিই যদি কখনো খেয়াল করে ইখলাসের সঙ্গে একবারও বলতে পার, তবে বিশ্বাস কর; এই একবারই তোমার পরকালের নাজাতের উসিলা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ । তাঁর সুতরাং এমন চিন্তা করো না যে, ঘরে ইবাদত করলে তো ঘুমিয়ে পড়ব । ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড় । কারণ যতটুকু ইবাদত করেছ, তা সুন্নত মোতাবেক করেছ । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত তো হল, কুরআন পড়তে পড়তে ঘুম এসে পড়লে, ঘুমিয়ে পড় । ঘুম পূর্ণ করে আবার উঠে স্বাভাবিক হয়ে তিলাওয়াত কর । কারণ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করলে, হতে পারে কোনো ভুল শব্দ তোমার যবান থেকে বের হয়ে যাবে । একজন হয়তো সুন্নতপরিপন্থী সারা রাত জেগে ইবাদত করল, কিন্তু আরেকজন সুন্নত মোতাবেক এক ঘণ্টা ইবাদত করে সারা রাত ঘুমাল, তাহলে প্রথম ব্যক্তি অপেক্ষা দ্বিতীয় ব্যক্তির আমল আল্লাহর নিকট হাজার গুণ উত্তম ও পছন্দনীয় ।
প্রত্যেক ইবাদত সীমার ভিতর রাখ
এজন্যই আল্লাহর নিকট আমল গণনা করা হয় না; ওজন করা হয়। সেখানে দেখা হয়, কার আমলের ওজন কত? সুতরাং তুমি যদি সংখ্যায় অনেক আমলও কর, কিন্তু তাতে ওজন তৈরি না কর, তাহলে তাতে বিশেষ ফায়দা নেই । এজন্য বলা হয়েছে, ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পড়, আল্লাহ তাওফীক দিলে আবার জেগে ইবাদত কর, কিন্তু সুন্নত পরিপন্থী কাজ কখনো করো। না। যেই ইবাদতগুলো জামা’আতের সঙ্গে করা শরীয়তে প্রমাণিত, সেগুলোই জামা’আতের সঙ্গে কর; সীমা লঙ্গন করো না। ফরয নামায জামা’আতের সঙ্গে প্রমাণিত; রমযানের তারাবী ও বিতিরের জামা’আত প্রমাণিত; জানাযার জামা’আত প্রমাণিত; দুই ঈদের জামা’আত প্রমাণিত; ইস্তিস্কা ও সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের নামায জামা’আতের সঙ্গে প্রমাণিত। শেষোক্ত কয়েকটি নামায যদিও সুন্নত, কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা’আতের সঙ্গে আদায় করেছেন। সুতরাং এগুলো ইসলামের শেয়ারের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো জামা’আতে আদায় করা যাবে। এছাড়া অন্য কোনো নামায জামা’আতে আদায় করার বিষয়টি শরীয়তে প্রমাণিত নেই । সেগুলোতে আল্লাহ চান, তাঁর বান্দা নিবৃত্তে নির্জনে তাঁর সান্নিধ্যে আসুক। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্জন সান্নিধ্যের এই মহাদান, বান্দার জন্য কোনো মামুলি বিষয় নয়। এই নেয়ামতের মূল্যায়ন করা চাই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
মহিলাদের জামা’আত প্ৰসঙ্গ
এখানে মহিলাদের জামা’আতে নামায আদায়ের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করা দরকার। মহিলাদের জন্য জামা’আতে নামায আদায় করা পছন্দনীয় নয় । ফরয, সুন্নত, নফল কোনোটাই না। কারণ মহিলাদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ হল, তোমরা যত ইবাদত করবে, সব একা করবে। মহিলাদের ইবাদতে জামা’আত পছন্দনীয় নয় । আমি বার বার বলে আসছি; আসলে দ্বীন হল শরীয়তের আনুগত্যের নাম । এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, আমাদের তো বিভিন্নভাবে ইবাদত করতে মন চায়।
মনের চাহিদা ছাড়তে হবে। কারণ মন চাওয়ার কারণে কোনো বিষয় দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। যে বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেননি এবং পছন্দ করেননি, তা মন চাইলেও করা যাবে না।
শবে বরাতের হালুয়া
খোলাসা কথা হল, শবে বরাত তথা ১৫ই শা’বানের রাতটি অনেক ফযীলতপূর্ণ । এই রাতে যতদূর সম্ভব বেশি করে ইবাদত বন্দেগী করা চাই। তাছাড়া তাতে হালুয়া রুটি জাতীয় যেই সমস্ত অনর্থক কাজকর্ম যুক্ত করা হয়েছে, তা সম্পর্কে আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না । শবে বরাতের সঙ্গে যে হালুয়া- রুটির কোনো সম্পর্ক নেই, তা কার না জানা । আসলে শয়তান সর্বক্ষেত্রে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। সে চিন্তা করে, শবে বরাতে তো মুসলমানদের গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় । এক হাদীসে এসেছে, এই রাতে আল্লাহ বনু কাল্বের বকরির পশম সমপরিমাণ বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৪৮২৫)
শয়তান চিন্তা করল, এক রাতেই যদি এত মানুষ ক্ষমা পেয়ে যায়, আমি তো সর্বস্ব হারাব। এজন্য সে মানুষের শবে বরাতের আমলে অনুপ্রবেশ করল। তাদের শিখিয়ে দিল, ভাই শবে বরাতের দিন একটু হালুয়া রুটি বানাও না, তাতে সমস্যার কি আছে? ব্যাস মানুষ হালুয়া রটির পিছনে লেগে গেল । হালুয়া রুটি তো বছরের যে কোনো দিন; যখন ইচ্ছা, কেউ বানিয়ে খেতে পারে। তাতে কারো আপত্তি নেই, কিন্তু শবে বরাতে বিশেষভাবে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করা এবং এটাকে এই দিনের বিশেষ আমল মনে করার কোনো সুযোগ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ এমনকি কোনো বুযুর্গের আমলেও এর অস্তিত্ব নেই । কিন্তু শয়তান মানুষকে তাতে লাগিয়ে দিয়েছে এবং মানুষও তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । এখন তো হালুয়া রুটির প্রতি এত গুরুত্বারোপ করা হয়, যার কিয়দাংশ গুরুত্ব ইবাদতের প্রতিও দেয়া হয় না।
বিদ’আতের বৈশিষ্ট্য
কথাটি সবসময় মনে রাখবেন! আমার মুহতারাম আব্বাজান হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. বলতেন, বিদ’আতের বৈশিষ্ট্য হল, যখন মানুষ বিদ’আতে লিপ্ত হয়, তখন তার আসল সুন্নতের তাওফীকে ঘাটতি দেখা দেয় । এজন্য আপনাদেরও জানা থাকার কথা; যারা লম্বা লম্বা সালাতুত তাসবীহের জামা‘আতে দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দেয়, তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের জামা’আতে খুব কম দেখবেন। যারা বিদ’আতে অভ্যস্ত, তাদেরকে দেখবেন, ফরযের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে গাফেল । নামায কাযা হচ্ছে; জামা’আত ছুটে যাচ্ছে, তাদের মোটেও কোনো পরোয়া নেই । অথচ হালুয়া রুটি কিংবা আলোকসজ্জার প্রতি তারা খুব সচেতন ।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পর বিলম্ব না করে মীরাস বণ্টনের প্রতি খুব গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু তারা তা করবে না; অথচ তিনদিনা, চল্লিশা, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি খুব কঠোরতার সঙ্গে পালন করবে । এটি বিদ’আতের বৈশিষ্ট্য। মানুষ যখন তাতে লিপ্ত হয়, তার সুন্নত ফরযের তাওফীক আল্লাহ উঠিয়ে নেন । আল্লাহ আমাদেরকে সকল বিদ’আতি কর্মকাণ্ড থেকে হেফাজত করুন । আমীন।
শেষ কথা হল, শবে বরাত একটি ফযীলতের রাত। তবে শরীয়তে যেই আমল যতটুকু প্রমাণিত, শুধু ততটুকুই করা যবে; মানুষ তাতে যেসব মনগড়া বিষয়গুলো যুক্ত করেছে, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। অবশ্য কেউ কেউ বলতে চান, এই রাতের কোনো ফযীলতই প্রমাণিত নেই । তাদের এই ধারণা ঠিক নয় ।
পনেরই শা’বানের রোযা
এখানে আরেকটি বোঝার বিষয় হল, পনেরই শা’বানের রোযার প্রসঙ্গ। পুরো হাদীস ভাঙারে একটিমাত্র বর্ণনায় এসেছে, এই দিন রোযা রাখ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৭৮)
কিন্তু এই বর্ণনাটিও যয়ীফ (দুর্বল)। এজন্য উলামায়ে কেরামের অনেকের মতে এই দিনের রোযা সুন্নত বা মুস্তাহাব সাব্যস্ত করা ঠিক নয় ।
অবশ্য পুরো শা’বান মাস জুড়ে অধিক পরিমাণে নফল রোযা রাখার বিষয়টি প্রমাণিত । ১লা শা’বান থেকে ২৭শে শা’বান পর্যন্ত বেশি বেশি রোযা রাখার কথা হাদীস আছে । তবে ২৮ ও ২৯শে শা’বান রোযা রাখতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। যাতে রমযানের জন্য পূর্ণ আগ্রহ উদ্দীপনার সঙ্গে প্রস্তুত থাকা যায় । তাছাড়া ১৫ই শা’বান ‘আইয়্যামে বীয’ তথা মাসের ১৩, ১৪, ১৫-এর অন্তর্ভুক্ত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ মাসের এই দিনে রোযা রাখতেন । সুতরাং কেউ যদি শা’বান মাসের একটি দিন এবং আইয়্যামে বীযের একদিন হিসাবে ১৫ই শা’বান রোযা রাখে, অবশ্যই তা বিশেষ সওয়াবের আমল হিসাবে গণ্য হবে ইনশাআল্লাহ । তবে শবে বরাতের দিন হিসাবে এই রোযার গুরুত্বারোপ করা উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে সহীহ নয়। এজন্যই তাঁরা মুস্তাহাব রোযার আলোচনা করতে গিয়ে আশুরার রোযার ভিন্ন আলোচনা করলেও ১৫ই শা’বানের রোযার কথা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেননি; বরং বলেছেন শা’বান মাসের যে কোনো দিনই রোযা রাখা উত্তম ।
আমি আগেও বলেছি, প্রত্যেক বিষয়কে তার সীমার ভিতর রাখা চাই। শরীয়ত যেই বিষয়ে যেই সীমা-রেখা ঠিক করে দিয়েছে, তাকে সেখানে সীমিত রাখার নামই দ্বীন । নিজের বুদ্ধিতে কোনো বিষয় আবিষ্কার করা এবং পালন করার নাম দ্বীন নয় । সুতরাং আলোচিত সীমারেখা ঠিক রেখে যদি কেউ ১৫ই শা’বান রোযা রাখে, তাহলে খুব ভালো কথা । ইনশাআল্লাহ তাতে সওয়াবও পাওয়া যাবে । তবে এই দিনের রোযাকে সুন্নত বলার অবকাশ নেই ।
তর্ক বিতর্ক এড়িয়ে চলুন
এই হল শবে বরাতের ফযীলত ও রোযা সম্পর্কে শরীয়তের বিধান । এই বিষয়গুলো সামনে রেখে আমল করতে হবে। শবে বরাত নিয়ে এর বেশি তর্ক বিতর্কে জড়ানো উচিত নয় । আজকাল যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে; কেউ কিছু
বললেই তা নিয়ে তর্ক বিতর্কের ঝড় শুরু হয়ে যায়। এটি ঠিক নয় । আপনি যদি নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তির কাছে কিছু শোনেন, তাহলে আমল শুরু করেন। কেউ ব্যতিক্রম বললে তার সঙ্গে আপনার বিতর্কে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযথা তর্ক করতে নিষেধ করেছেন । হযরত ইমাম মালেক রহ. বলেন-
المراء والجدال في العلم يذهب بنور العلم
অর্থাৎ এ জাতীয় বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্কে জড়ানো ইলমের নূর বিনষ্ট করে দেয় । (তাতীবুল মাদারিক ও তাকরীবুল মাসালিক)
এবিষয়ে আমাদের বিশিষ্ট কবি আকবর ইলাহাবাদীর বড় চমৎকার একটি কবিতা আছে । তিনি বলেন-
فالتو عقل مجھ میں تھی ہی نہیں مذہبی بحث میں نے کی ہی نہیں
ধর্মীয় বিতর্কে কখনো জড়াইনি আমি, তাতে জড়ানোর মতো ফালতু মেধাও নেই আমার ।
মাযহাব ও মাসলাকের এই বিতর্কে অনর্থক সময় নষ্ট হয় । এতে কোনো ফায়দা নেই । যাদের অনর্থক সময় ও মেধা নষ্ট করার মতো বিকৃত মানসিকতা আছে, তারাই তাতে অংশগ্রহণ করে। এজন্য আমি বলব, যেই আলেমের উপর আপনার আস্থা আছে, আপনি তার কথার উপর আমল করুন, নাজাত পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। অন্য আলেম ভিন্ন কিছু বললেও তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই । এটাই সাধারণ মানুষের দ্বীনের উপর চলার সহজ ও সুন্দর উপায় ।
রমযানের জন্য পাক পবিত্র হয়ে যাও
সার কথা হল, ১৫ই শা’বান রাতের ফযীলত ভিত্তিহীন বলা ভুল । আমার তো মনে হয়- এই রাতটি আল্লাহ রমযানের দুই সপ্তাহ আগে রেখেছেন। রমযানের প্রস্তুতি ও অভ্যর্থনার জন্য । এ যেন রমযানের ইবাদতের ‘রিহারস্যাল ও প্রশিক্ষণ । আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পাক সাফ করে রমযানের পবিত্রতার জন্য প্রস্তুত করছেন । বান্দাকে আগাম সতর্ক করা হচ্ছে তোমাদের সামনে এমন পবিত্র মাসের আগমন হচ্ছে, যাতে আমার রহমতের বারি মুষলধারে বর্ষিত হবে; রহমত ও মাগফিরাতের দরজাগুলো সব খুলে দেয়া হবে।
দেখুন, মানুষ যখন কোনো বড় দরবারে উপস্থিত হয়, তখন আগে। থেকেই সে নিজেকে পাক পবিত্র করে নেয়। গোসল করে, ভালো কাপড় পরিধান করে, সুগন্ধি ব্যবহার করে। এখানে যখন রমযানরূপে আল্লাহর রহমতের দরবার উম্মোচিত হতে যাচ্ছে, তখন আল্লাহ তার আগে একটি পবিত্র রাত দিয়ে বলছেন, এসো বান্দা! আমি তোমাকে আমার রহমত ও বরকতের পবিত্রতা দিয়ে গোসল করিয়ে সকল গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ পাক সাফ করে দিচ্ছি । যাতে আমার সঙ্গে তোমার গভীর ও পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠে । তাহলেই তুমি রমযানের রহমত ও বরকত থেকে পরিপূর্ণ উপকৃত হতে পারবে। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ আমাদেরকে রমযানের পূর্বে ১৫ই শা’বানের পবিত্র ও বরকতময় রাতটি দান করেছেন । এর যথাযথ মূল্যায়ন করা চাই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন । আমীন ।
واخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين
সূত্র : ইসলাহী খুতুবাত, (৪/২৫৫-২৭০) বাদ আসর,
বাইতুল মোকাররম জামে মসজিদ, করাচী
তথ্যসূত্রঃ
বই নামঃ ইসলামী মাসসমূহঃ ফাযায়েল ও মাসায়েল, করণীয় ও বর্জনীয়
পৃষ্ঠাঃ ৯৫
মূল - শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী
ভাইস প্রেসিডেন্টঃ ইসলামী ফিকহ একাডেমী, জেদ্দা, সোদিআরব
শাইখুল ইসলাম ও নায়েবে মুহতামিমঃ জামিয়া দারুল উলূম, করাচী
শবে বরাতের ফজিলত ও তার প্রামাণ্যতা
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কিত একাধিক সহি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি উল্লেখ করা হলো–
হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা অর্ধশাবানের রাতে (শবে বরাত) সৃষ্টির প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪/১৭৬)
শবে বরাতের ক্ষেত্রে ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত অনেকে এই হাদিসটিসহ শাবানের রাতের সব হাদিসকে অস্বীকার করেন এবং শবে বরাতকে বিদআত বলেন। কিন্তু ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নুরুদ্দীন হাইসামী, কাসতাল্লানী, যুরকানীসহ আরও অনেক হাদিস বিশারদ এটিকে সহি বলেছেন। শুধু তাই নয়; শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানীও (রহ.) সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা গ্রন্থে এই হাদিসের সমর্থনে আরও আটটি হাদিস উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এসব বর্ণনার মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহি প্রমাণিত হয়। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ: ৩/১৩৫-১৩৯)। সুতরাং শবে বরাত আছে এবং এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত–হাদিসের আলোকে এটি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো। তথ্যসূত্র
শবে বরাত সম্পর্কেও আছে চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতা। সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কথা হচ্ছে, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাতটি উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা নির্ধারণ করা বা সম্মিলিত উৎসবের রূপ দান করা সমীচীন নয়; বরং এ রাতের প্রমাণিত ফযীলতকে সামনে রেখে যথাসাধ্য ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা কাম্য এবং তা নির্ভযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব রাতের মতোই মনে করা এবং এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত সকল হাদীসকে ‘মওজু’ বা ‘জয়ীফ’ বলে আখ্যায়িত করা যেমন ভুল তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা।
শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক একটি হাদীস এই- হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শা‘বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং শিরককারী ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া অন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান ১৩/৪৮১ হাদীস ৫৬৬৫
ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইছামী, কাসতাল্লানী, যুরকানী প্রমুখ হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার শা‘বান ’২৬ সেপ্টেম্বর ’০৫ সংখ্যা। তথ্যসূত্র
২. প্রশ্ন-উত্তর
প্রশ্ন ১ঃ আমি এক কিতাবে পড়েছি যে, শবে বরাত বিষয়ক সকল হাদীস ‘মওযু’। ইবনে দিহয়ার উদ্ধৃতিতে কথাটা ওই কিতাবে লেখা হয়েছে।
উত্তর : এটা একটা ভুল কথা। ইবনে দিহয়া কখনো এমন কথা বলতে পারেন না। যিনি তার উদ্ধৃতিতে এ কথা লিখেছেন তিনি ভুল লিখেছেন। ইবনে দিহয়া শুধু এটুকু বলেছেন যে, শবে বরাতে বিশেষ নিয়মের নামায এবং সে নামাযের বিশেষ ফযীলতের যে কথাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তা মওযু। তাঁর মূল আরবী বক্তব্য তুলে দিচ্ছি :
أحاديث صلاة البراءة موضوعة
‘শবে বরাতের বিশেষ নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো মওজু।’
(তাযকিরাতুল মওজুআত, মুহাম্মাদ তাহের পাটনী পৃ. ৪৫)
আল্লামা লাখনৌবী রাহ. ‘আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ’ (পৃ. ৮০-৮৫)তে পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতে রাত্রি জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয় তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাআত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযু।’ তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব-এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।’
আল্লামা শাওকানীও ‘আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ’ পৃ. ৫১)তে এই ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন।
প্রশ্ন ২ : একজন আলিমের কাছে শুনেছি যে, শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া ‘মাসনূন’ নয়। আর আজকাল যেভাবে এ রাতে কবরস্থানে মেলা বসানো হয় এবং মহিলারাও বেপর্দা হয়ে সেখানে গিয়ে ভিড় করে, তা তো একেবারেই নাজায়েয।
প্রশ্ন এই যে, যতটুকু নাজায়েয তা তো অবশ্যই নাজায়েয, কিন্তু যদি মহিলারা বেপর্দা না হয় এবং কোনো গুনাহর কাজও সেখানে না হয় তবুও কি এ রাতে কবর যিয়ারত মাসনূন বলা যাবে না? হাকীমুল উম্মত ‘ইসলাহুর রুছূম’ কিতাবে একে ‘মাসনূন’ লিখেছেন।
উত্তর : মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া এমনিতেও নিষেধ। এরপর যদি পর্দাহীনতা ও অন্যান্য আপত্তিকর বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তা আরো কঠিন হয়ে যায়। আর কবরস্থান যদি নিকটবর্তী হয় এবং মাযার না হয় আর সেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কাজকর্ম না হয় তাহলে পুরুষের জন্য এ রাতে সেখানে গিয়ে যিয়ারত করার বিধান কী? হাকীমুল উম্মত রাহ. প্রথমে একে মাসনূন লিখেছিলেন। পরে আরো চিন্তা-ভাবনা ও উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মত বিনিময় করার পর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন এবং লেখেন যে, আমি কবরস্থানে যাওয়া থেকে বারণ করাকেই অধিক সতর্কতার বিষয় মনে করি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৮) শরীয়তের নীতিমালার আলোকে হযরত থানভী রাহ-এর দ্বিতীয় মতই অগ্রগণ্য।
প্রশ্ন ৩ : সুনানে ইবনে মাজাহ-তে (হাদীস নং : ১৩৮৮) পনেরো শা‘বান রাত সম্পর্কে এই হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে :
قوموا ليلها وصوموا نهارها
এই রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে (অর্থাৎ পনেরো শা’বান) রোযা রাখ।
এই হাদীসটি থানভী রাহ. ‘খুতবাতুল আহকাম’-এ উল্লেখ করেছেন এবং ‘ইসলাহুর রুসূম’-এ পনেরো শাবান-এর রোযাকে মাসনূন বলেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, শায়খ আলবানী এই হাদীসটিকে মওযু বলেছেন। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ তকী উছমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘ইসলাহী খুতবাত’-এ দেখলাম যে, সেখানে এই হাদীসটিকে ‘জয়ীফ’ লেখা হয়েছে এবং এই রোযাকে ‘সুন্নত’ মনে করা ভুল বলা হয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি বুঝে আসছে না। আশা করি সাহায্য করবেন।
উত্তর : ইবনে মাজাহর উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওজু’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘জয়ীফ’। যেহেতু ফাযাইলের ক্ষেত্রে ‘জয়ীফ’ গ্রহণযোগ্য তাই আলিমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন।
শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ মওজূ। যেহেতু অন্যান্য ‘সহীহ’ বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে সম্ভবত এজন্যই শায়খ আলবানী সরাসরি ‘মওজূ’ না বলে ‘মওজূউস সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়খ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওজূ’ নয়, শুধু ‘জয়ীফ’। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজু’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এ জন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, জয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০
সারকথা এই যে, উপরোক্ত বর্ণনা মওজু নয়, শুধু জয়ীফ।
পনেরো শাবানের রোযা সম্পর্কে থানভী রাহ. যে ‘মাসনূন’ বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। আর ইসলাহী খুতবাতের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়া হলে দেখা যায় যে, তা এ কথার বিপরীত নয়। ওই আলোচনায় ‘জয়ীফ’ হাদীসের ওপর আমল করার পন্থা বিষয়ে একটি ইলমী আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। হযরত মাওলানা পনেরো তারিখের রোযা রাখতে নিষেধ করেননি। তিনি শুধু এটুকু বলেছেন যে, একে শবে বরাতের রোযা বলবে না। গোটা শাবান মাসেই শুধু শেষের দুই দিন ছাড়া, রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতিমাসের ‘আয়্যামে বীজ’ (চাঁদের ১৩,১৪,১৫ তারিখ) রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখা হলে ইনশাআল্লাহ ছওয়াব পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন ৪ : আমি একটি পুস্তিকায় পড়েছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে যেসব রেওয়ায়েত পাওয়া যায় তন্মধ্যে সনদের বিবেচনায় সবচেয়ে উত্তম রেওয়ায়েতটিই হল ‘জয়ীফ।’ তাহলে অন্যগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কথা কি সঠিক?
উত্তর : এ কথাটা একেবারেই ভুল। শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে। তার মধ্যে একটি হাদীস ‘সহীহ’, কিছু হাদীস ‘হাসান’ আর কিছু ‘জয়ীফ’। এ জন্য শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস জয়ীফ-একথা ঠিক নয়। সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা সেটা যা ইবনে হিববান ‘কিতাবুস সহীহ’ তে (হাদীস ৫৬৬৫) বর্ণনা করেছেন।
عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن.
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’
আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী।’ যথা মুসনাদে আহমদ এর ৬৬৪২ নং হাদীস, এবং মুসনাদুল বাযযার (২০৪৫)-এ আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীস।
এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।
হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-
هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.
‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩
ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-
هذا مرسل جيد
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।
এধরনের বেশ কয়েকটি সহীহ ও হাসান হাদীস বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কি এ কথা বলা উচিত যে, এ বিষয়ে সর্বোত্তম হাদীসটি সনদের বিচারে জয়ীফ? ভালোভাবে না জেনে কথা বলা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন।
প্রশ্ন ৫ : লোকেরা বলে, এ রাতের ফযীলত শবে কদরের সমান। কুরআন মজীদে ‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। এ কথাটা কি সঠিক?
উত্তর : দুটো কথাই ভুল। শবে বরাতকে শবে কদরের সমান মনে করা ভুল। কুরআন-হাদীসে শবে কদরের যত ফযীলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা শবে কদরেই সংঘটিত হয়েছে। এই ফযীলত অন্য কোনো রজনীতে নেই।
‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে কদরকেই বোঝানো হয়েছে, যা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সূরা কদরে। এজন্য এখানে শবে বরাত উদ্দেশ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক অবস্থানে দৃঢ়পদ থাকার তাওফীক দান করুন। ইমাম ইবনে রজব রাহ. এর ভাষায় : ‘মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে যিকির, দুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যানের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ছওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোযাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবগুলোই কবীরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হল সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ -লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬# তথ্যসূত্র
৩. শবে বরাত নিয়ে হক্কানী ওলামাদের বয়ান
Mufti Habibullah Mahmud Qasemi || শবেবরাতের করনীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
Allama Hasan Jamil || শবে বরাত সম্পর্কে ভয়ানক তথ্য দিলেন
মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন || শবে বরাত সম্পর্কে এত সুন্দর আলোচনা
মুফতি আরিফ বিন হাবিব || শবে বরাত নিয়ে কি অসাধারণ আলোচনা একবার
আল্লামা মুফতী মুস্তাকুন্নবী কাসেমী || শবে বরাতে কি কি আমল করবেন কিভাবে করবেন
মুফতী রেজাউল কারিম আবরার || শবে বরাতের রোজা রাখার সঠিক নিয়ম
Mufti Abu Muhammad Rahmani || শবে বরাত !!
এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0
মাশা-আল্লাহ