ইবাদত

সদকায়ে ফিতর

সদকায়ে ফিতর কাদের উপর ওয়াজিব?

যে পুরুষ বা মহিলার মালিকানায় সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা রয়েছে, কিংবা এই সমপরিমাণ মূল্যের নগদ অর্থ, কিংবা ব্যবসায়িক পণ্য কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত মাল রয়েছে, কিংবা সব ধরণের মাল মিলিয়ে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের বা সাড়ে রায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্যের প্রয়োজনাতিরিক্ত মাল রয়েছে, সেই পুরুষ বা মহিলার উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব । (জাওহারাতুন্ নাইয়্যেরা : ১/১৬০)

সদকায়ে ফিতর কখন ওয়াজিব হয়?

১. সদকায়ে ফিতর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার সময় ওয়াজিব হয় । অবশ্য রমযানেও সদকায়ে ফিতর আদায় করা বৈধ। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈদের দিন ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগে ইন্তেকাল করবে অথবা সম্পদহীন হয়ে যাবে, তার উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব নয়। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

২.যে অমুসলিম ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পর মুসলমান হবে অথবা যে গরীব লোক সুবহে সাদিকের পর নেসাবের মালিকানা প্রাপ্ত হবে, তার উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : খণ্ড-১)

৩. সুবহে সাদিকের সময় বা তার পূর্বে যে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে, তার পক্ষ থেকে নেসাবের মালিক পিতার উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

৪. যে বাচ্চা সুবহে সাদিকের পর ভূমিষ্ঠ হবে, তার পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

সদকায়ে ফিতর আদায়ের সময়

১. ঈদুল ফিতরের দিন নামাযের পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা অনেক বেশী ফজিলতপূর্ণ কাজ। ঈদের নামাযের পরেও আদায় করা যায়। কিন্তু ঈদের দিনের পর বেশী বিলম্ব করা সুন্নাত পরিপন্থী ও মাকরূহ। তারপরও আদায় করা জরুরী। তবে রমযানের চাঁদ দেখার পর রমযানুল মোবারকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা জায়েয আছে। (রদ্দুল মুহতার : খণ্ড-২)

২. রমযানের পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা অনুচিত। (রদ্দুল মুহতার : খণ্ড-২)

সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ

আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত পরিমাণ হল, পৌনে দুই সের গম বা এর মূল্য । সব শ্রেণির সম্পদশালী এই এক প্রকারেই সদকাতুল ফিতর আদায় করে থাকেন ।

অথচ হাদীসে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা-

১. যব

২. খেজুর

৩. পনির

৪. কিসমিস

৫.গম

এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতে চাইলে মাথাপিছু এক ‘সা’ পরিমাণ দিতে হবে। কেজির হিসাবে যা ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আধা ‘সা’ দিতে হবে। কেজির হিসাবে ১ কেজি ৬৩৫গ্রাম। এটা ওজনের দিক দিয়ে তফাত। আর মূল্যের পার্থক্য তো আছেই। যেমন : (ক) আজওয়া (উন্নত মানের) খেজুরের মূল্য প্রতি কেজি ১৭০০, টাকা হলে এক ‘সা’ (৩কেজি ২৭০ গ্রাম) এর মূল্য হয় ৫৫৫৯টাকা। (খ) মধ্যম ধরণের খেজুর প্রতি কেজি ২০০, টাকা হলে এক ‘সা’ এর মূল্য ৭২৭টাকা ।

গ) কিসমিস প্রতি কেজি ৩৫০, টাকা হলে এক ‘সা’ (৩কেজি ২৭০ গ্রাম)এর মূল্য ১১৪৪.৫টাকা। (ঘ) পনির প্রতি কেজি ৬০০, টাকা হলে এক ‘সা’ (৩কেজি ২৭০ গ্রাম) এর মূল্য ১৯৬২ টাকা । (ঙ) গম প্রতি কেজি ৩৫ টাকা হলে আধা ‘সা’ (১কেজি ৬৩৫গ্রাম) এর মূল্য ৫৭ টাকা । বিশেষ দ্রষ্টব্য, উপরোক্ত দ্রব্যগুলোর মূল্য যেহেতু ওঠানামা করতে থাকে, তাই ফিতরা আদায়ের আগে বাজার-মূল্য যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। উল্লেখ্য, হাদীসে এ পাঁচটি দ্রব্যের যে কোনোটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোনোটি দ্বারা তা আদায় করতে পারেন। তাই এক্ষেত্রে উচিত হল, যার উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য আছে তার জন্য ওই হিসাবেই দেওয়া। যার সাধ্য পনির হিসাবে দেওয়ার তিনি তাই দেবেন । এরচেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারেন। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন তিনি আদায় করবেন গম দ্বারা। আমাদের ক্ষুদ্রজ্ঞানে, কুরআনের নির্দেশনা । فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌلَّهُ ط (অবশ্য কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পূণ্যের কাজ করে (এবং নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেয়) তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়।) (সূরা বাকারা ১৮৪)

এ লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বড় বড় বিত্তশালী ব্যক্তিগণ যদি সাধারণ সম্পদশালী দের মতো একই মানের সদকাতুল ফিতর আদায় না করে হাদীসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্য থেকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করেন, তবে তা-ই উত্তম হবে। তবে এটি ভিন্ন কথা যে, যে কোনো ব্যক্তি হাদীসে বর্ণিত যেকোন খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করলে তার সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে।

হাদীস শরীফে এসেছে,

আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. এর যুগে আমরা সদকাতুল ফিতর হিসেবে এক ‘সা’ খাদ্যদ্রব্য আদায় করতাম। তিনি বলেন, আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫১০)

অন্য হাদীসে আছে,

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন এক ‘সা’ খেজুর বা যব কিংবা আধা সাঃ গম, গোলাম, আযাদ নারী-পুরুষ ও ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬২২)

সদকায়ে ফিতর অন্য কেউ আদায় করে দিলে

১. কেউ যদি অন্যের পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে চায়, তাহলে তার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া জরুরী। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

২. স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করে দেয়, তাহলে স্পষ্ট অনুমতি নেওয়া জরুরী নয়। কেননা, সাধারণত এসব ক্ষেত্রে অনুমতি থাকে। (রদ্দুল মুহতার)

৩. স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করে দেয়, সেক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়া দেওয়া উভয়টিই জরুরী। উত্তম হলো, স্বামী একেবারেই সারা জীবনের জন্য অনুমতি নিয়ে নিবে অথবা স্ত্রী অনুমতি দিয়ে দিবে। যাতে কোন ধরণের সংশয় না থাকে। (রদ্দুল মুহতার)

সদকায়ে ফিতর এর হকদার কারা ?

১. যারা যাকাতের মাল পাওয়ার হকদার, তারাই সদকায়ে ফিতর পাওয়ার হকদার। অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে যাকাত প্রদান করা যায়, সেসব ক্ষেত্রে সদকায়ে ফিতর দেওয়া জায়েয। আর যেসব ক্ষেত্রে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়, সেখানে সদকায়ে ফিতর দেওয়াও জায়েয নয়। অবশ্য কোনো গরীব অমুসলিমকে সদকায়ে ফিতর দেওয়া জায়েয, তবে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। এটি হলো যাকাত ও ফিতরার পার্থক্য। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

২. সদকায়ে ফিতরের উপযুক্ত হলো ফকীর-মিসকীন। সুতরাং ঈদের নামাযের আগে তা প্রদান করতে হবে। কোনো কোনো লোকেরা সদকায়ে ফিতর সংগ্রহ করে ঈদের নামাযের আগে তা বন্টন করে না, তাদের এ পদ্ধতি সুন্নাত পরিপন্থী। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

৩. ফিতরার অর্থ মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, অফিস বা রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা জায়েয নয়। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া)

সদকায়ে ফিতর মহিলাদের উপরও ওয়াজিব হয়

সম্পদশালী হওয়ার কারণে যেমনিভাবে পুরুষের উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হয়, ঠিক তেমনিভাবে কোন মহিলা যদি নেসাবের মালিক হয় অথবা ঋণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব ব্যতীত এমন কোনো সম্পদ তার মালিকানায় থাকে, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরী রূপার সমান, তাহলে ওই মহিলার উপরও সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। যেমন, তার কাছে অলঙ্কার আছে, যা পিতা-মাতার কাছ থেকে পেয়েছে অথবা স্বামী তাকে নেসাব পরিমাণ অলঙ্কারের মালিক বানিয়ে দিয়েছে, অথবা মহর হিসেবে এত অলঙ্কার পেয়েছে যা নেসাবের সমপরিমাণ। তবে যদি স্বামী তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করে দেয়, তাহলে আদায় হয়ে যাবে। তাকে আর আদায় করতে হবে না ।

উত্তম ফিতরা

ফিতরার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হলো কিশমিশ,খেজুর, যব এবং গমের পরিবর্তে তার মূল্য দেওয়া। যাতে ফিতরার হকদার অভাবগ্রস্ত লোকেরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী জিনিস ক্রয় করতে পারে। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া

যাকাত ও সদকায়ে ফিতরের নেসাবের পার্থক্য

যার উপর যাকাত ফরজ তার উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। শুধু পার্থক্য এই যে, যাকাতের নেসাবের মধ্যে সোনা, রূপা অথবা ব্যবসার মালামাল হওয়া এবং বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরী। আর সদকায়ে ফিতরের নেসাবের ক্ষেত্রে শুধু এগুলোই হওয়া জরুরী নয়; বরং এ তিনটি জিনিস ছাড়াও অন্য কোনো জিনিস যদি থাকে এবং এই সকল জিনিসপত্রও সম্পদের মূল্য যদি কমপক্ষে সাড়ে বায়ান্ন ভরী রূপার সমপরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। তবে উভয় নেসাবের ক্ষেত্রেই শর্ত হলো, নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চেয়ে অতিরিক্ত এবং ঋণের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পদ হতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩৫৮-৩৬০)

তথ্যসূত্রঃ. 
যাকাত আদায় করি, দোযখ থেকে বাঁচি
লেখকঃ মাওলানা মুমিনুল হক জাদীদ

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *