স্বর্ণ রোপা এবং টাকা থাকলে কোনটির উপর ভিত্তি করে যাকাত আবশ্যক হয়
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতু
যে ব্যক্তির নিকট ৭.৫০ তোলা স্বর্ন বা ৫২.৫০ তোলা রূপা অথবা এর সমপরিমান অর্থ এক বছর কাল পর্যন্ত থাকে তার উপর যাকাত ফরজ।
এখন প্রশ্ন হলো:
১) ৭.৫০ তোলা স্বর্ন আর ৫২.৫০ তোলা রূপার মূল্যতো এক নয়। তাহলে কোনটির ভিত্তিতে নেসাব পরিমাণ ধরা হবে, যেহেতু দু’টির মূল্য এক নয়? আর সমপরিমান অর্থ দ্বারা কোনটির সমপরিমাণ বুঝানো হয়েছে, স্বর্ণের মূল্য নাকি রূপার মূল্য? যেমন কারো নিকট নগদ ২ লক্ষ টাকা আছে, কোন সোনা-রূপা নেই। এই টাকাতো স্বর্ণের হিসাবে নেসাব পরিমাণ না, কারণ ৭.৫ তোলা/ভরি স্বর্ণের বাজার মূল্য অনেক বেশী কিন্তু ২ লক্ষ টাকা ৫২.৫০ তোলা রূপার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী। তাহলে এটার হিসাব কিভাবে হবে??
২) কোন ব্যক্তির নিকট ৭.২৫ তোলা স্বর্ণ আছে, কোন নগদ টাকা বা রূপা নেই। তবে কি ইহা নেসাব পরিমাণ হবে??
৩) কারো নিকট ৪.৫০ ভরি/তোলা সোনা, ২০ তোলা রূপা ও ১ লক্ষ নগদ টাকা আছে। এখানে সোনার হিসাব করলে নেসাব পরিমাণ হয় না। কারণ ১ লক্ষ টাকায় ৩ তোলা সোনা পাওয়া যায়না। কিন্তু রূপার হিসাব করলে নেসাব পরিমাণ হয়, কারণ ১ লক্ষ টাকায় ৫২.৫০ তোলার চেয়ে বেশী রূপা পাওয়া যায়। তাহলে কিভাবে হিসাব করা হবে?
উত্তরঃ ১ ও ৩ নং প্রশ্নের জবাব
আপনার ১ নং এবং ২ নং প্রশ্নের মূল পয়েন্ট হল, যদি কারো কাছে স্বর্ণ-রূপা সেই সাথে নগদ অর্থ থাকে, বা ব্যক্তির কাছে স্বর্ণ আছে আর টাকা আছে রূপা নেই। তাহলে এসব ক্ষেত্রে যাকাত কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে হবে? স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে হবে? না রূপার উপরে? অর্থাৎ স্বর্ণের মূল্য হিসেবে যাকাত আবশ্যক হবে? না রূপার মূল্য হিসেবে যাকাত আবশ্যক হবে?
এটি হল আপনার এ দুই প্রশ্নের মূল প্রশ্ন।
এর জবাব হল, মূলত ইসলামী ফিক্বহের মূলনীতি হল, যাকাত ও ওয়াকফের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গরীবদের জন্য অধিক উপকারী সেটিকেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
সুতরাং কোন ব্যক্তির কাছে যদি স্বর্ণ ও রূপা এবং নগদ অর্থ থাকে, কিন্তু কোনটিই আলাদাভাবে নিসাব পরিমাণ না হয়, তাহলে যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের মূল্য পরিমাণ টাকা রূপার বিক্রি মূল্য ও নগদ অর্থ এবং স্বর্ণের বিক্রি মূল্য মিলিয়ে হয়ে যায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর স্বর্ণ মূল্য হিসেবে যাকাত আবশ্যক হয়ে যাবে।
কিন্তু যদি স্বর্ণ মূল্য হিসেবে যাকাতের নিসাব পূর্ণ হচ্ছে না, কিন্তু রূপার নিসাব পরিমাণ টাকা, নগদ অর্থ এবং স্বর্ণের বিক্রয়মূল্য এবং রূপার বিক্রিমূল্য দিয়ে হয়ে যায়, তাহলে তার উপর রূপার মূল্য হিসেবে যাকাত আবশ্যক হয়ে যাবে।
সহজ কথায়, স্বর্ণ ও রূপার মাঝে যেটির মূল্য দিয়ে যাকাত আবশ্যক হয়, সেটির দ্বারাই যাকাত আবশ্যক ধরা হবে। গরীবদের উপকারার্থে। যদিও আলাদাভাবে কোনটির দ্বারাই যাকাত আবশ্যক হয় না।
উদাহরণতঃ
একজনের কাছে ৩.৭৫ তোলা স্বর্ণ আছে। সেই সাথে ৪০ তোলা রূপা আছে। আর আছে পাচ হাজার নগদ অর্থ।
তাহলে উক্ত ব্যক্তির স্বর্ণের নিসাব পূর্ণ নয়। পূর্ণ নয় রূপার নিসাবও। তাহলে তার উপর কি যাকাত আবশ্যক হবে না?
আসলে এক্ষেত্রে দেখা হবে, সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের দাম কত? যদি দেখা যায়, সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের দাম ৫০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে লোকটির কাছে যেহেতু ৩.৭৫ তোলা স্বর্ণ আছে, তাই তার মূল্যমান হিসেবে তার কাছে রয়েছে ২৫ হাজার টাকা।
এবার দেখা হবে, ৪০ তোলা রূপার দাম কত? যদি দেখা যায়, ৪০ তোলা রূপার দাম ২০ হাজার টাকা। তাহলে স্বর্ণ আর রূপার মূল্য মিলিয়ে হল মোট ৪৫ হাজার টাকা। আর তার কাছে নগদ অর্থ আছে ৫ হাজার টাকা। এ সব মিলিয়ে তার সর্বমোট অর্থ দাঁড়াচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। যা স্বর্ণের নিসাবটিকে পূর্ণ করে ফেলছে। কারণ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্য হল ৫০ হাজার টাকা। এখানে তার স্বর্ণের বিক্রি মূল্য এবং রূপার বিক্রি মূল্য ও নগদ অর্থসহ হয়ে যাচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। তাই তার উপর স্বর্ণ হিসেবেই যাকাত আবশ্যক হয়ে যাচ্ছে। তাই এর থেকে ৪০ভাগের একভাগ যাকাত আদায় আবশ্যক।
কিংবা
স্বর্ণের মূল্য যদি অধিক চড়া হয়। যেমন উপরোক্ত উদাহরণেই যদি সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের মূল্য দাঁড়ায় ৩ লাখ টাকা।
আর লোকটির কাছে আছে ৩.৭৫ তোলা স্বর্ণ। সে হিসেবে তার কাছে রয়েছে দেড় লাখ টাকা। আরো বাকি দেড় লাখ টাকা।
এখন আমরা দেখবো লোকটির কাছে থাকা ৪০ তোলা রূপার মূল্য কত? রূপার মূল্য পাওয়া গেল মাত্র ২০ হাজার টাকা। আর নগদ অর্থ আছে ৫ হাজার টাকা।
তাহলে সর্বমোট কত টাকা আছে লোকটির কাছে? এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যা স্বর্ণের নিসাব ৩ লাখ পর্যন্ত যেতে পারছে না। তাই তার উপর এ হিসেবে যাকাত আবশ্যক হচ্ছে না।
কিন্তু যদি দেখা হয় রূপা হিসেবে, তাহলে কিন্তু যাকাত আবশ্যক হয়ে যাচ্ছে। কারণ লোকটির কাছে আছে, ৩.৭৫ তোলা স্বর্ণ, ৪০ তোলা রূপা আর নগদ ৫ হাজার টাকা।
আর ৪০ তোলা রূপার মূল্য যদি হয় ২০ হাজার টাকা। তাহলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য কত? নিশ্চয় ২৬ হাজার ২৫০টাকা। অর্থাৎ ২৬ হাজার ২৫০টাকা হলেই রূপার নিসাব পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ লোকটির কাছে রয়েছে নগদ পাঁচ হাজার, সেই সাথে ৪০ তোলার রূপার সমমূল্য হিসেবে ২০ হাজার, আর ৩.৭৫ তোলা স্বর্ণের বিক্রিমূল্য হিসেবে দেড় লাখ টাকা। মোট এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা। অনেক আগেই রূপার নিসাব ২৬ হাজার ২৫০ টাকা ক্রস করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, বরং শুধু স্বর্ণের মূল্য দিয়েই রূপার নিসাব পূর্ণ হয়ে আরো অনেক বেশি টাকা রয়ে যাচ্ছে।
এরকম অবস্থায়, অর্থাৎ স্বর্ণকে মূল ধরলে যাকাত আবশ্যক যদি না হয়, তাহলে রূপার নেসাব দেখা হবে, যদি রূপার নেসাব সবগুলো মিলে পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে রূপার নেসাব অনুযায়ী যাকাত আবশ্যক হবে। আর যদি রূপার নেসাব ছাড়া স্বর্ণের হিসেবেই নেসাব পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে স্বর্ণ হিসেবেই যাকাত আবশ্যক হবে।
আশা করি বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে।
গরীবদের হকের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণ ও রূপার মাঝে যেটি দিয়েই যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়ে যায়, সেটি হিসেবেই যাকাত আবশ্যক হয়েছে বলে সাব্যস্ত হবে।
## সুতরাং ৩ নং প্রশ্নে স্বর্ণ অনুযায়ী যাকাতের নিসাব পূর্ণ না হলেও যেহেতু রূপার অনুযায়ী পূর্ণ হচ্ছে, তাই উক্ত ব্যক্তির উপর যাকাত আবশ্যক বলে সাব্যস্ত হবে।
فى الدر المختار-وَلَوْ بَلَغَ بِأَحَدِهِمَا نِصَابًا دُونَ الْآخَرِ تَعَيَّنَ مَا يَبْلُغُ بِهِ، وَلَوْ بَلَغَ بِأَحَدِهِمَا نِصَابًا وَخُمُسًا وَبِالْآخَرِ أَقَلَّ قَوَّمَهُ بِالْأَنْفَعِ لِلْفَقِيرِ (رد المحتار، كتاب الزكاة، باب زكاة المال-3/229، وكذا فى الهداية-1/196، وكذا فى الهندية-1/179، وكذا فى التاتارخانية-2/237، وكذا فى المبسوط للسرخسى-2/191
২ নং এর জবাব
যদি ব্যক্তির কাছে শুধু স্বর্ণ থাকে কোন অর্থ না থাকে, তাহলে যদি স্বর্ণের নেসাব পূর্ণ না হয়, তথা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ না থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত আবশ্যক হবে না। যদি নেসাব পূর্ণ হয় তাহলে যাকাত আবশ্যক হবে। আর যদি স্বর্ণের সাথে নগদ অর্থ বা স্বর্ণ থাকে, তাহলে ১ ও ৩ প্রশ্নের উত্তরের মূলনীতির আলোকে যাকাত আবশ্যক হওয়া ও না হওয়া নির্ভর করবে।
তেমনি যদি কারো কাছে শুধু রূপা থাকে, স্বর্ণ বা নগদ অর্থ না থাকে, তাহলে যদি রূপার নেসাব পূর্ণ না হয়, তাহলে তার উপর যাকাত আবশ্যক হবে না। যদি নেসাব পূর্ণ হয় তাহলে যাকাত আবশ্যক হবে। আর যদি রূপার সাথে নগদ অর্থ বা স্বর্ণ থাকে, তাহলে ১ ও ৩ প্রশ্নের উত্তরের মূলনীতির আলোকে যাকাত আবশ্যক হওয়া ও না হওয়া নির্ভর করবে।
وفى بدائع الصنائع- فاما اذا كان له ذهب مفرد فلا شيئ فيه حتى يبلغ عشرين مثقالا، فاذا بلغ عشرين مثقال ففيه نصف مثقال (بدائع الصنائع-2/18
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে লুৎফুর রহমান ফরায়েজী পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।