ইসলাম

কুদৃষ্টির অশুভ পরিণাম ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি

হযরত উসমানগণী রাযি.-এর কাছে এক ব্যক্তি এল যার দৃষ্টি পথে অবাঞ্চিত স্থানে পড়েছিল। তিনি লোকটির চোখ দেখেই বুঝে ফেললেন। বললেন- مَا بَالُ أَقْوَا مٍ يَتَرَبَّحُ الزِّنَا مِنْ أَعْيُنِهِمْ এজাতির কী হয়ে গেল! তাদের চোখ দিয়ে ব্যভিচার টপকে পড়ছে।’ লোকটি অবাক হয়ে গেল। বলে ওঠল, এখনও অহির ধারা অবশিষ্ট আছে? উসমান রাযি. উত্তর দিলেন, না, এটা তো মুমিনের অন্তদৃষ্টি। اتَّقُوْا فِرَاسَةَ الْمُؤْمِنِ فَإِنَّهُ يَنْظُرُ بِنُوْرِ اللَّهِ “মুমিনের অন্তর্দৃষ্টিকে ভয় কর। কারণ তিনি আল্লাহর নূর দ্বারা দেখেন।’

কাশফের অধিকারীরা লিখেছেন, কুদৃষ্টির কারণে এমন অন্ধকার সৃষ্টি হয় যে, যা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকেরা ধরে ফেলেন। পক্ষান্তরে শালীন ও আল্লাহভীরু ব্যক্তির চোখে থাকে নূর।

কুদৃষ্টির দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি

শাইখুলহাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ. বলেন, একব্যক্তির ঘটনা। মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন দিল। লোকটি বলল, আমার জিহবা তো কালেমার জন্য নড়ে না। জিজ্ঞেস করা হল, কারণ কী? সে জানাল, এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল তোয়ালে খরিদ করার জন্য। আমার ভালো লেগে ওঠে। আমি কামদৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখেছিলাম।

ইবনুলজাওযী রহ. লিখেছেন, মিসরের জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আযান দেয়ার উদ্দেশে মিনারে ওঠল। পাশের ছাদে দৃষ্টি পড়তে জনৈক সুন্দরী খৃস্টান নারীর প্রতি তার চোখ পড়ল। ভাবল, নতুন ভাড়াটিয়া মনে হচ্ছে, আযানের পর গিয়ে পরিচিত হব। আযানের পর মুয়াজ্জিন গেল ওই প্রতিবেশীর বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়ার পর মহিলাটির বাবা বের হল। কথাবার্তার একটা পর্যায়ে জানা গেল, এতো মহিলা নয়; বরং কুমারী মেয়ে। এখনও বিয়ে হয় নি। মুয়াজ্জিন বিয়ের প্রস্তাব দিল। মেয়ের বাবা শর্ত জুড়ে দিল, আমাদের ধর্মগ্রহণ করতে হবে। মুয়াজ্জিনের অন্তরে কামনার এমন ভূত চেপে বসেছিল যে, সে ‘হ্যাঁ” বলে দিল। মেয়ের বাবা বলল, ঠিক আছে, চল, ছাদে গিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। মুয়াজ্জিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠতে লাগল। হঠাৎ পা পিছলে সে পড়ে গেল এবং ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে গিয়ে সেখানেই মারা গেল। نہ خدا ہی ملا نہ وصال صنم – نہ ادھر کے ہے نہ ادھر کے ہے আল্লাহকে পেল না, প্রতিমারও ঘনিষ্ঠ হল না। – এ কূলও পেল না, ওই কূলও রইল না।

কুদৃষ্টির নগদ সাজা

কুদৃষ্টির একটি ধরন হল, কারো ঘরের দরজা-জানালা কিংবা ছিদ্র দিয়ে দেখা। হাদীসশরীফে এ ব্যপারে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। এমনকি ঘরের মালিককে দর্শনকারীর চোখ ফুঁড়ে দেয়ার অধিকারও দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- إِنَّ إِمْرَأَ إِطَّلَعَ عَلَيْكَ بِغَيْرِ إِذْنِ فَخَذَفْتَه بِحِصَاةٍ فَفَقَأَتْ عَيْنُهِ مَا كَانَ عَلَيْكَ مِنْ جَنَاحٍ ‘কেউ যদি অনুমতি ছাড়া তোমার ঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখে তুমি তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ কর। এর দ্বারা যদি তার চোখ ফুটো হয়ে যায় তোমার কোনো অপরাধ হবে না।’ (ইবনেকাসীর, খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৮০)

কুদৃষ্টির কারণে পবিত্র কুরআন ভুলে গেল

ইমাম ইবনুলজাওযী রহ. ‘তালবীসে ইবলীস’ কিতাবে লিখেছেন, আবু আব্দুল্লাহ ইবনে আজলা বলেন, আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে একটি খৃস্টান সুশ্রীবালককে দেখছিলাম। ইত্যবসরে আবু আবদিল্লাহ বালখী রহ, আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি বললাম, চাচা! একটু দেখুন, এই সুদর্শন চেহারাটিকে কিভাবে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেয়া হবে! আমার এ উত্তর শুনে তিনি তার দুটো হাত দ্বারা আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, এই কুদৃষ্টির ফল তুমি পাবে। বেশ কিছুকাল যদিও চলে গেছে। কিন্তু চল্লিশবছর পর আমি গুনাহটির প্রতিক্রিয়া দেখলাম। পবিত্র কুরআন আমি ভুলে গেলাম।(তালবীসেইবলীস, পৃষ্ঠা : ৩৪৯) আবু লআইয়ান বলেন, আমি আমার উসতাদ আবুবকর দাক্কাকের সাথে যাচ্ছিলাম। ইতোমধ্যে একটি কিশোরের কমনীয় চেহারার ওপর আমার কামদৃষ্টি পড়ে। উসতাদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন। বললেন, তুমি এর পরিণতি ভোগ করবে। কিছুদিন পর আমি কুরআন মাজীদ ভুলে গেলাম।

কুদৃষ্টির অনির্ধারিত শাস্তি

আল্লাহতাআলা বলেন- يَعْلَمُ خَائِنَةُ الْأَعْيُنِ وَ مَا تُخْفِي الصُّدُورُ ‘তিনি চোখের খেয়ানত ও অন্তরের মাঝে লুকায়িত বিষয়সমূহ সম্পর্কে জানেন।’ আলোচ্য আয়াতে ‘কুদৃষ্টি গুনাহ’ এটা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত কোনো শাস্তির কথা বলা হয় নি।

এর রহস্য হল, মানুষ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের লোক হল, যাদের অনুভূতিশক্তি এতটাই ভোঁতা যে, এরা কথায় নয়; বরং জুতায় মানে। আয়াতটিতে তাদেরকে হুমকি দেয়া হয়েছে যে, আমি চোখের খেয়ানত সম্পর্কে জানি। যদি বিরত না থাকো তাহলে মর্মস্পর্শী শাস্তি দেয়া হবে। چوریاں آنکھوں کی اور سینوں کی راز – جانتا ہے سب کو تواے بے نیاز ‘চোখের চুরি আর অন্তরের ভেদ, – হে অমুখাপেক্ষী আল্লাহ! তুমি জান সবকিছু।’

আরেক ধরনের লোক হল, অনুভূতিপ্রবণ; তারা যখন অনুধাবন করতে পারে যে, আমাদের মালিক আমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন, তখন তারা লজ্জায় কাতর হয়ে যায়। আয়াতটিতে তাদেরকেও লজ্জা দেয়া হচ্ছে। এদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কুদৃষ্টির সাজা প্রত্যেককেই তার স্বভাব অনুপাতে দেয়া হবে। জনৈক লোকের ভাষায় – جیسے روح و یسے فرشتے ‘আত্মা যেমন ফেরেশতা তেমন।’ جتنا بے حیا اتنی زیادہ سزا ‘নিলজ্জতা যত সাজাও হবে তত।’

কুদৃষ্টির প্রভাব অন্তরে

হযরতে আকদাস থানবী রহ. বলেন, দৃষ্টিদানের মাধ্যমে অন্তরের গুনাহর অস্তিত্ব আসে। অনেকে পরনারী ও সুশ্রীবালকের দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকায়। তখন অন্তরের এর একটা ছাপ পড়ে যায়। তারপর সে নির্জনে কল্পনার মাধ্যমে উক্ত লালসা চরিতার্থ করে। অন্তরের এ গুনাহ চোখের গুনাহরস চেয়েও জঘন্য। ফকীহগণ লিখেছেন, কোনো ব্যক্তি নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসকালে যদি পরনারীর কল্পনা করে তাহলে তার ব্যভিচারের গুনাহ হবে।

কুদৃষ্টি এবং নূরবিহীন চেহারা

কুদৃষ্টির কারণে চেহারার নূর চলে যাওয়া কুদৃষ্টির অন্যতম প্রভাব। হাদীসে আছে- عَنْ أَبِي أُمَامَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَتَغُصَّنَّ أَبْصَارَكُمْ وَلَتَحْفَظَنَّ فُرُوْجَكُمْ أَوْ لَيَكْسِفَنَّ اللَّهُ وُجُوْهَكُمْ ‘আবুউসামা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের চোখ অবশ্যই নিম্নগামী করবে এবং তোমাদের গুপ্তাঙ্গ সংরক্ষণ করবে তা না হলে আল্লাহতাআলা তোমাদের চেহারা বিনষ্ট করে দিবেন।'(তাবারানী বর্ণিত, আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠ ২৬)

চেহারা বিনষ্ট হওয়ার প্রথম ধাপ হল, চেহারাকে নূরবিহীন করে দেয়া। সুন্দর হওয়া সত্বেও চেহারার মায়া চলে যাবে।

কুদৃষ্টি এবং সৌন্দর্যপ্রেমের ধোঁকা

কিছু অজ্ঞলোক বলে থাকে, আমরা সুদর্শন চেহারা দেখে মহান আল্লাহর বড়ত্বের সাথে পরিচিত হই। এটা নিচক প্রতারণা ও শয়তানি প্রবঞ্চণা। মহান আল্লাহর বহু সৃষ্টি আছে যেগুলো দেখা বৈধ এবং যেগুলো তাঁর বিস্ময়কর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। ফুলের বিচিত্র বাহার দেখুন, সেগুলোর সৌরভ নিয়ে ভাবুন। ফলের সুগন্ধি কিভাবে মানুষের অন্তপ্রাণকে আচ্ছন্ন করে নেয়, তা সম্পর্কে চিন্তা করুন। ফলের বৈচিত্র ও মিষ্টতা সম্পর্কে ভাবুন। মহান আল্লাহ বলেন- أَنْظُرُوْا إِلَى ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ ‘ফলের প্রতি তাকাও যখন তা পূর্ণতা লাভ করে।

সমুদ্র লেক ও ঝর্ণাধারাগুলো দেখুন। পৃথিবীর প্রশস্ততা আকাশের উচ্চতা মানুষকে আহবান করে নিজেকে নিয়ে ভাবনার প্রতি। মহান আল্লাহ বলেন- أَفَلَا يَنْظُرُوْنَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ وَإِلى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ وَ إِلَى الْأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আকাশের দিকে কিভাবে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং পর্বতমালার দিকে, কিভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে এবং ভূমন্ডলের দিকে কিভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে?”

ভাবতে মনে চাইলে চাঁদ সূর্য তারকার সৌন্দর্য নিয়ে ভাবুন। বাতাসে উড়ন্ত দৃষ্টিনন্দন পাখি, পানির সাতারু বিচিত্র মৎসরাজি কি ভাবনার জন্য যথেষ্ট নয়? শুধু মানুষের চেহারা ভাবনার জন্য রয়ে গেল? এসবই খোঁড়া অজুহাত। গুনাহর অজুহাত নিকৃষ্ট গুনাহর মতই। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর সামনে একবার মনের কাছে পরাজিত একলোক এই অজুহাত পেশ করল যে, আমি তো সুশ্রী চেহারাগুলো দেখি আল্লাহর সৃষ্টিনিপুনতা ও কুদরতের কারিশমা অনুধাবন করার জন্য। তিনি লোকটিকে অত্যন্ত শিক্ষণীয় উত্তর দিলেন, বললেন, তুমি তোমার মায়ের লজ্জাস্থান নিয়ে ভাবো যে, কিভাবে এত সঙ্কীর্ণ পথ দিয়ে তোমার মত মানুষ জন্ম দিয়েছেন!

তথ্যসূত্র: বই: কুদৃষ্টি

লিখক: আল্লমা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *