অহংকারের কারণ
অহংকারী ব্যক্তি মনে করে সত্তাগতভাবেই সে তার সাথি- সঙ্গীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। ফলে তার মাঝে কারও প্রতি বিনয় বা কারও প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার মানসিকতা থাকে না। অহংকারের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটিনিম্নরূপ। যথা—
১. আনুগত্য ও বিনয় না থাকা
কারও আনুগত্য ও অন্যের প্রতি বিনয় প্রকাশের আগ্রহ ও গুণ না থাকা অহংকারের অন্যতম কারণ। অহংকারী ব্যক্তি কারও আনুগত্য করতে চায় না। আনুগত্য না করার এ আগ্রহ বাড়তে বাড়তে এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, যে মহান আল্লাহ-র হাতে আসমান- জমিনের সর্বময় ক্ষমতা, যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান, সে তাঁরও আনুগত্য করতে চায় না।
তার এ ধরনের মানসিকতার কারণে ধীরে ধীরে তার মাঝে অমুখাপেক্ষিতার অনুভূতি জন্মে। ফলে তার থেকে যাবতীয় অবাধ্যতা ও অনাচার প্রকাশ পেতে থাকে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى ﴿1﴾ أَنْ رَاهُ اسْتَغْنى কখনোও নয়; নিশ্চয়ই মানুষ সীমালঙ্ঘন করে। কারণ, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে। [সূরা আলাক : ৬-৭]
অর্থাৎ দুনিয়ার ধন-দৌলত, সম্মান-প্রতিপত্তি যা কিছু সে চাইত, তার সবই সে লাভ করেছে- এ দৃশ্য দেখে সে কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে বরং বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে এবং সীমালঙ্ঘন করতে শুরু করেছে।
বর্ণিত আয়াতটি একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হলেও ব্যাপক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের একটি নৈতিক দুর্বলতা বর্ণনা করা হয়েছে। মানুষ যতদিন নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী মনে না করে, ততদিন সে সীমালঙ্ঘন করে না। কিন্তু যখন সে মনে করতে থাকে যে, সে কারও মুখাপেক্ষী নয়, তখন তার মধ্যে অবাধ্যতা এবং সীমালঙ্ঘন প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অথচ আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছেন রক্তপিণ্ড থেকে, তাকে তার মায়ের গর্ভে যত্নে রেখেছেন, বেড়ে ওঠার যাবতীয় উপায়-পদ্ধতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন; তারপরও যখনই সে নিজেকে ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার অহঙ্কারের কারণ অধিকারী মনে করা শুরু করে, তখনই সে অবাধ্যতা করতে শুরু করে, এমনকি তার রবের সাথেও সীমালঙ্ঘন করে।
বাগাভী বলেন, মানুষ সীমালঙ্ঘন করে এবং স্বীয় প্রভুর অবাধ্যতা করে, কেননা সে নিজেকে ধনী, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অভাবমুক্ত মনে করে।[মাআলিমুত তানযীল : ৮/৪৭৯ সামান্য পরিবর্তনের সাথে]
২. শ্রেষ্ঠত্ব লাভের বাসনা
অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য লাভের প্রবল বাসনা অহংকারের অন্যতম কারণ। অহংকারী ব্যক্তি মনে করে, সমাজ ও সমাজের মানুষ কর্তৃক তাকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখা, তাকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া এবং তারব্যক্তিত্ব ও সম্মানের স্বীকৃতি দেওয়া তার হক ও ন্যায্য অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
সমাজ যদি তার সম্মান ও মর্যাদার স্বীকৃতি না দেয়, তা হলে সে মনে মনে ভাবতে থাকে, তার ইপ্সিত মর্যাদা ও কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছা যাবে অহংকারের মাধ্যমে।
৩. অযোগ্যতা ও দোষ লুকানোর মানসিকতা
একজন অহংকারী সবসময়ই মানুষের দৃষ্টিতে বড় হয়ে থাকতে চায়। ফলে সে সর্বাত্মক চেষ্টা করে তার কোনো দোষ-ত্রুটি ও অযোগ্যতা যেন মানুষের দৃষ্টিতে ধরা না পড়ে। মানুষ যেন তার কোনো দুর্বলতা, অদক্ষতা ও মন্দ গুণের কথা জানতে না পারে। এ জন্য সে নিজেকে বড় বলে জাহির করে এবং অহংকারের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না, অহংকারের মাধ্যমে মূলত সে নিজেকে অপমান ও লাঞ্ছিতই করছে। মানুষকে তার গোপন বিষয়াশয় ও দোষত্রুটি অনুসন্ধানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে ; পথ দেখাচ্ছে।
কেননা, সে যখন নিজেকে নিজের যোগ্যতার চেয়েও বড় ওমর্যাদাসম্পন্ন বলে প্রকাশ করবে, তখন সঙ্গত কারণেই মানুষ তারপ্রকৃত অবস্থা ও বাস্তবতা অনুসন্ধানে আগ্রহী হবে। এভাবে মানুষ তারদোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা ও গোপন বিষয়াশয় সম্পর্কে অবহিত হবে। তার কমতিগুলো মানুষের চোখের সামনে চলে আসবে। ফলে মানুষ তাকেতুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে; ছোট ও নিকৃষ্ট মনে করবে।
অথচ ইচ্ছে করলে সে পারত নিজের দোষত্রুটি গুলোকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে – বিনয়-নম্রতা ও মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অবলম্বন করে, যা সে জানে না সে ব্যাপারে চুপ থেকে, যা করতে সে সক্ষম নয় সে ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে, চ্যালেঞ্জ থেকে বিরত থেকে এবং লৌকিকতা ও ভিত্তিহীন দাবি থেকে দূরেথেকে।
৪. বিনয়ের ক্ষেত্রে অন্যদের বাড়াবাড়ি
অনেক সময় বিনয়ের ক্ষেত্রে অন্যদের বাড়াবাড়িও অহংকারীদের অহংকারে লিপ্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ নিজেদেরকে খুবই ছোট ভাবে, সামনে অগ্রসর হয়ে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে কিংবা কোনো আমানত বহনে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে এ সুযোগে অহংকারী ব্যক্তি মনে করে, মানুষ এসব থেকে দূরে থাকছে তাদের অযোগ্যতা ও অসমর্থতার কারণে এবং এভাবে তারা তার যোগ্যতা, দক্ষতা ও মর্যাদার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে। এক পর্যায়ে সে মনে করতে থাকে, এর জন্য একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি সে-ই। অপর দিকে শয়তান সবসময়ই তাকে ফুসলাতে থাকে এবং এক সময় সে নিজেকে সকলের চেয়ে বড় ও মহান ভাবতে শুরু করে। পাশাপাশি অন্যদের ছোট ও তুচ্ছ ভাবতে থাকে। এভাবেই সে অহংকারে লিপ্ত হয়ে পড়ে
৫. মূল্যায়নের মাপকাঠিতে ত্রুটি
মানুষের মাঝে কাউকে মূল্যায়ন করা ও মর্যাদা দানের মাপকাঠি নির্ধারণে ত্রুটি করাও অহংকারে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম বড় কারণ। এজন্য আপনি দেখবেন, সমাজের মানুষ ধনী ও পদমর্যাদার অধিকারীদের প্রাধান্য দেয়, যদিও তারা পাপাচারী হয়। অন্যদিকেএকজন মুত্তাকী, পরহেযগার ও নেককার ব্যক্তিকে অবমূল্যায়ন করা হয় লোকটি ধনী, পদমর্যাদার অধিকারী কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী না হওয়ার কারণে। এভাবে অযোগ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়াটা তাকে অহংকারে লিপ্ত করতে উৎসাহিত করে। ফলে এক সময় সে অন্যদের তুলনায় নিজেকে বড় ও মহৎ ভাবতে থাকে এবং অন্যদের তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট জ্ঞান করতে থাকে।
নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে একটি বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মানুষকে কোন মাপকাঠির ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং প্রত্যেককে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
যেমন, এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সাহল ইবনে সা’দ বলেন-امَرَّ رَجُلٌ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ مَا تَقُوْلُوْنَ فِي هَذَا؟قَالُوا حَرِيٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ يُنْكَحَ وَإِنْ شَفَعَ أَنْ يُشَفّعَ وَإِنْ قَالَ أَنْ يُسْتَمَعَ ،قَالَ ثُمَّ سَكَتَ ، فَمَرَّ رَجُلٌ مِنْ فُقَرَاءِ الْمُسْلِمِينَ فَقَالَ مَا تَقُولُونَ فِي هَذَا؟ قَالُوا حَرِيٌّ إِنْ خَطَبَ أَنْ لَا يُنْكَحَ وَإِنْ شَفَعَ أَنْ لَا يُشَفَّعَ وَإِنْ قَالَ أَنْ لَا يُسْتَمَعَ ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا خَيْرٌ مِنْ مِلْءٍ الْأَرْضِ مِثْلَ هَذَا.
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। তখন তিনি [সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ করে] বললেন, এ লোকটির ব্যাপারে তোমরা কী বল? [তোমাদের কী ধারণা?] তাঁরা উত্তর দিলেন, এ লোক যোগ্য ও উপযুক্ত— যদি সে কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তা হলে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায়। যদিসে কারও ব্যাপারে সুপারিশ করে, তা হলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। যদি কোনো কথা বলে, তা হলে তার কথা শোনা হয়।বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর নবীজি চুপ করে রইলেন। এরপর সেখান দিয়ে একজন দরিদ্র মুসলিম অতিক্রম করলেন। নবীজি উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ করে বললেন, এ ব্যক্তিটি সম্পর্কে তোমরা কী বল? সাহাবায়ে কেরাম জওয়াব দিলেন, সে এমন যে- যদি কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তা হলেতার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায় না। কারও জন্য সুপারিশ করলে সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না। কোনো কথা বললে তা শোনা হয় না। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, এ ব্যক্তিটি দুনিয়া ভর্তি ওই লোকটির ন্যায় ধনীদের চেয়ে উত্তম। [বুখারী, হাদীস নং ৫০৯১]
৬. অন্যায় তুলনা ও নেয়ামতদাতাকে ভুলে যাওয়া
অন্যায় তুলনা ও নেয়ামতদাতাকে ভুলে যাওয়া। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতকে অন্যদের নেয়ামতের সাথে তুলনা করা এবং আল্লাহ -কে ভুলে যাওয়া। এটিও অহংকারের অন্যতম বড় কারণ। একজন মানুষকে আল্লাহ তাআলা যেসব নেয়ামত দান করেছেন, সেসব নিয়ে সে নিজেকে ওইসব লোকের সাথে তুলনা করা, যাদেরকে কোনো না কোনো হিকমতের কারণে আল্লাহ সেগুলো দান করেননি।
অতঃপর মনে মনে ভাবতে থাকা যে, সে এসব নেয়ামতের যোগ্য হকদার এবং এগুলো সে প্রাপ্ত হয়েছে তার অধিকার ও যোগ্যতার বলে। এভাবে সে নিজেকে নিজে বড় হিসেবে দেখতে থাকে। অপরদিকে যাদেরকে এসব নেয়ামত দান করা হয়নি, তাদেরকে ছোট, তুচ্ছ ও উক্ত নেয়ামতের অযোগ্য বলে জ্ঞান করতে থাকে।
বই : অহংকার করবেন না
লিখক : শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ