শবে কদরে ফজিলত ও গুরুত্ব
‘শবে কদর’ শব্দটি ফারসী শব্দ। আরবীতে এর সমার্থবোধক শব্দ হল ‘লাইলাতুল কদর’। পবিত্র কুরআন, হাদীস ও ইসলামী গ্রন্থ সমূহে এই পরিভাষাই ব্যবহার হয়েছে। ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত বা রজনী, আর ‘কদর’ অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ এর অর্থ হল সম্মানিত রজনী বা মহিমান্বিত রজনী
এই ব্লগের সূচীপত্রঃ
✅ কুরআন হাদীসের আলোকে শবে কদরের ফজিলত ও গুরুত্ব
✅ শবে কদরের সময়কাল
✅ শবে কদরে আমাদের করণীয়
✅ শবে কদরের কি বিশেষ কোন নামাজ আছে?
✅ শবে কদর গোপন করার হেকমত
কুরআনে কারীমে শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত
রমজান মাস পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস। শবে কদর কুরআন নাযিলের রাত। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেন।
এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এ রাতের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ রাতে মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদিকে হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগি ও আমলের সমান সাওয়াব দান করেন। কুরআনুল কারীমে ‘আল-কাদর’ নামে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাযিল করা হয়েছে, যার অর্থ : “আমি তা (আল কুরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। তুমি কি জান মহিমান্বিত রজনী কি? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ; সে রাতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ (জিবরাইল আ.) অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি-সে রজনীতে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত”। (সূরা আল কাদর)
এই সূরার বর্ণনা অনুযায়ী শবে কদর বা লাইলাতুল কদর-এর তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে :
১. এ রাতে কুরআন নাযিল করা হয়। ২. এ রাত হাজার মাস (৮৩ বছর ৪মাস) অপেক্ষা উত্তম । ৩. এ রাতে হযরত জিবরাঈল আ. ফেরেশতাদল সহ শান্তির পয়গাম নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।
কুরআনুল কারীমের সূরা দুখানেও এ রাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। এ রাতটিকে বরকতময় রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ, “শপথ সুষ্পষ্ট কিতাব (আল-কুরআন) এর। আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি মুবারক রজনীতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় আমার আদেশক্রমে, আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা,সর্বজ্ঞ।(সুরা দুখান :আয়াত ২-৬)
হাদীসে রাসূলে শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত
হাদীস শরীফেও এ রাতের বহু ফজিলত ও গুরুত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
০১. আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রমাযানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় সওম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। সুলায়মান ইবনু কাসীর (রহ.) যুহরী (রহ.) হতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৪)
০২. অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, আনাস (রা.) বলেন, রমজান আসলে নবীজি বলতেন- তোমাদের কাছে এ মহিমান্বিত মাস (রমযান) এসেছে। এ মাসে এমন একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হল সে যেন সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। আর কেবল অভাগাই এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৪৪; সুনানে নাসাঈ, হাদিস : ২১০৬) রাসূল সা. বলেন, “
০৩. অন্য এক হাদীসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, “শবে কদরে হযরত জিবরাঈল আ. একদল ফেরেশতা নিয়ে দুনিয়ায় অবতরন করেন। তারা সে সব লোকের জন্য দু’আ করতে থাকেন, যারা এ রাতে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে । (বায়হাকী, তাফসীরে ইবনে কাছীর)
প্রকৃতপক্ষে শবে কদর উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য একটি মহা মূল্যবান নিয়ামত, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুগ্রহ। পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের উম্মতগণ দীর্ঘ আয়ু পাওয়ার কারণে স্বভাবতই আল্লাহর ইবাদত বেশিবেশি করতে পারতেন। পক্ষান্তরে উম্মতে মুহাম্মদী স্বল্প আয়ু পাওয়া সত্ত্বেও যাতে ইবাদত-বন্দেগীর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে সে জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দয়া পরবশ হয়ে তাদের জন্য এই মহিমান্বিত রজনীর ব্যবস্থা করেছেন।
শবে কদরের সময়কাল
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে শবে কদরের সুনির্দিষ্ট কোন দিন-তারিখ বর্ণিত হয়নি। তবে বিভিন্ন হাদীসের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে এটাই আমাদের সামনে প্রতিভাত হয় যে, শবে কদর রমযানুল মুবারকে হয়ে থাকে এবং বিশেষ করে রমযানের শেষ দশকের ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ তারিখে তথা যে কোন বেজোড় রাতে হতে পারে। তম্মধ্যে ২৭ তারিখেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশী ।
শবে কদরের সময়ের ব্যাপারে হাদীসের বর্ণন
০১. ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে রমাযানের শেষের সাত রাত্রে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়। (এ শুনে) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে। (বুখারী ১১৫৮, মুসলিম ১৩/৪০, হাঃ ১১৬৫, আহমাদ ৪৫৪৭)
০২. আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে রমাযানের মধ্যম দশকে ই‘তিকাফ করি। তিনি বিশ তারিখের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমাকে লাইলাতুল ক্বদর (-এর সঠিক তারিখ) দেখানো হয়েছিল পরে আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান কর। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ঐ রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে ই‘তিকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে (মসজিদ হতে বের হয়ে না যায়)। আমরা সকলে ফিরে আসলাম (থেকে গেলাম)। আমরা আকাশে হাল্কা মেঘ খন্ডও দেখতে পাইনি। পরে মেঘ দেখা দিল ও এমন জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। সালাত শুরু করা হলে আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই। (বুখারী ৬৬৯) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৮৬)
**০৩. ‘**আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রমাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর। (বুখারী ২০১৯, ২০২০, মুসলিম ১৩/৪০, হাঃ ১১৬৯, আহমাদ ২৪৩৪৬)
০৪. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তা (লাইলাতুল কদর [ক্বদর]) রমাযানের শেষ দশকে অনুসন্ধান কর। লাইলাতুল কদর [ক্বদর] (শেষ দিক হতে গণনায়) নবম, সপ্তম বা পঞ্চম রাত অবশিষ্ট থাকে। (বুখারী ২০২২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৮৭৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৮৯১)
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের সূরা ক্বদরে ঘোষণা করেছেন- লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের (ইবাদাতের) চেয়েও উত্তম। সহীহ শুদ্ধ হাদীস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল ক্বদর রমাযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে লাইলাতুল ক্বদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদীসে এ কথাও উল্লেখিত আছে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিজোড় রাত্রিতেই তা হয় না। (অর্থাৎ কোন বছর ২৫ তারিখে হল, আবার কোন বছর ২১ তারিখে হল, এভাবে। আমাদের দেশে সরকারী আর বেসরকারীভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইলাতুল ক্বদর সাব্যস্ত করার কোনই হাদীস নাই। লাইলাতুল ক্বদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে মহিমান্বিত রাত শবে কদরের মর্যাদা লাভে ধন্য হওয়ার তাওফিক দান করুন।(আমিন)
শবে কদরে আমাদের করণীয়
এই সম্মানিত ও মহিমান্বিত বরকতময় রজনী পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মুসলমানেরই প্রবল চেষ্টা থাকা উচিত। আর তার সর্বোত্তম পন্থা হলো, কলহময় এ পৃথিবী থেকে একটু পৃথক হয়ে দুনিয়াবী সকল ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে মসজিদে রমযানের শেষ দশদিন ‘ইতিকাফ’ করা। কারণ ইতিকাফের দ্বারা দুনিয়ার সকল কাজকর্ম ও ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সর্বক্ষণ আল্লাহর যিকর বা ইবাদত বন্দেগীতে রত থাকা যায়। শেষ দশ দিনের যে কোন দিনই শবে কদর হোক ইতিকাফে রত থাকার কারণে তা পাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা বিদ্যমান। আর শুধু নিজেরই সে চেষ্টা করলে যথেষ্ট নয়; বরং পরিবার পরিজনকেও শবে কদরের ফজিলত অর্জনে এবং তাতে ইবাদত বন্দেগী করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রাসূল সা. সর্বদা রমযানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকেও সজাগ রাখতেন। হযরত আয়েশা রা. বলেন, রমযানের শেষ দশ দিন এলে রাসূল সা. স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। নিজে সারারাত ইবাদত করতেন এবং পরিবার- পরিজনদের ইবাদতের জন্য সজাগ করে দিতেন। (বুখারী)
এ রাতের বিশেষ ৬ টি আমল
১. নিজেকে শুদ্ধ করা
লাইলাতুল কদরের বরকত লাভের প্রধান শর্ত হলো ভেতর ও বাইরের পবিত্রতা লাভ এবং একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়া। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি বলেন, ‘উত্তম হলো—যে রাতে কদর অনুসন্ধান করা হবে, তাতে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, গোসল-সুগন্ধি-উত্তম কাপড়ের মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধন করা। আর বাহ্যিক সৌন্দর্য সৌন্দর্যের জন্য যথেষ্ট নয়, যদি না মানুষের ভেতরটা সুন্দর হয়। মানুষের ভেতর সুন্দর হয় তওবা ও আল্লাহমুখী হওয়ার মাধ্যমে।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৮৯)
২. তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি লাইলাতুল কদর জানতে পারি, তাহলে সে রাতে কী পড়বো? তিনি বললেন, তুমি পড়বে,(উচ্চারণ) ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি’ (অর্থ) ‘হে আল্লাহ, আপনি সম্মানিত ক্ষমাকারী, আপনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (সুনানে তিরমিজি, আয়াত : ৩৫১৩)
৩. বেশী বেশী কোরআন তিলাওয়াত করা।
যেহেতু কদরের রাতের মর্যাদার সঙ্গে কোরআন নাজিলের বিষয়টি সম্পর্কিত। তাই বুজুর্গ আলেমদের মতে, কদরের রাতে কোরআন তিলাওয়াত করা তাৎপর্যপূণ। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা কদর, আয়াত : ১-৩)
৪. রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা।
প্রিয় রাসূল (সা.)-এর নাম শুনলে দরুদ পড়া তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। রব্বে কারিম রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নবির প্রতি রহমত নাজিল করেন এবং তার ফেরেশতারাও নবির জন্য রহমতের দোয়া করে। হে মুমিনরা! তোমরাও নবির প্রতি রহমতের দোয়া কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ (সূরা আহজাব : ৫৬)
রাসূলের প্রতি দরুদ পাঠের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ প্রেরণ করবে আল্লাহতায়ালা তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। (সহিহ মুসলিম)।
৫. তাহাজ্জুদ আদায় করা।
তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফজিলত সব সময় বেশি। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য তাহাজ্জুদের বিকল্প নেই। শেষ রাতে মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় যারা নিদ্রা ত্যাগ করেন, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার নিদর্শনাবলিতে কেবল তারাই বিশ্বাস করে যাদের এর মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আর তাদের প্রতিপালকের প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে আর তারা অহংকার করে না। তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ (সুরা সাজদা: ১৫-১৬)
মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’ (মুসলিম: ১১৬৩)
৬. এশা ও ফজর জামাতে আদায় করা।
এই রাতে এশা ও ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা প্রধান কর্তব্য। সারা রাত ইবাদত করে ফজরের জামাতে অংশ নিতে না পারলে এমন ইবাদতের কোনো ফজিলত নেই। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে।’ (মুসলিম: ৬৫৬)
মনে রাখতে হবে, লাইলাতুল কদরের বিশেষ কোনো নামাজ কিংবা পদ্ধতি নেই। কদরের রাতের নফল নামাজে বিশেষ সুরা পড়তে হবে—এমন কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে, তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। নামাজের পর আলাদা কোনো দোয়া বা মোনাজাত নেই। অনেকে তিন বার করে সুরা পড়েন। এসব বিশুদ্ধ পদ্ধতি নয়, জরুরি বা বাধ্যতামূলকও নয়। নিজের মতো করে দোয়া করবেন, নামাজে সুরা কেরাত পড়বেন অন্য সময়ের নফল নামাজের মতো।
পরিশেষ রাসুল (সা.)-এর কিছু হাদীস স্মরণ করিয়ে দেই। ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘শবে কদর’ থেকে বঞ্চিত হলো; সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হলো।’
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ আছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লাইলাতুল কদর’ পেল কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীতে সময় কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই।’
সুতরাং পবিত্র রমজানের মাসে লাইলাতুল কদর আপনার আমার দরজায় কড়া নাড়ছে। এ রাতটিকে খুঁজে আমল-ইবাদতে কাটিয়ে সৌভাগ্যবানদের তালিকাতে নাম লেখাবো নাকি হতভাগা থেকে যাবো; সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকেই।
শবে কদরের কি বিশেষ কোন নামাজ আছে?
লাইলাতুল কদরে নামাজের নিয়ম
লোক মুখে প্রসিদ্ধ আছে যে, শবে কদরে নফল নামাজ দু‘রাকাত করে যত বেশী পড়া যায় তত বেশি ছওয়াব। নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ইখলাছ, সূরা ক্বদর, আয়াতুল কুরছী বা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়া অধিক ছওয়াবের কাজ। এই ভাবে কম্পক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি যত রাকাত আদায় করা যায় ততই ভালো।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, লাইলাতুল কদরে বিশেষ কোনও নামাজের পদ্ধতি নেই। লাইলাতুল কদরের রাতে নামাজ দুই রাকাত করে যত সুন্দর করে, যত মনোযোগ সহকারে পড়া যায় ততই ভালো। দুই রাকাত, দুই রাকাত করে আপনি যত খুশি পড়তে পারবেন। এভাবে সালাতুস তাসবিহ ও পড়তে পারেন,এই রাতে কোরআন তেলাওয়াত করবেন। বেশি বেশি দোয়া পড়বেন। ইস্তেগফার পড়বেন। তওবা করবেন।
এই রাতে যে দোয়া বেশি পড়বেন
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, শবে কদরের রাতে আমার কোন দোয়াটি পড়া উচিত?’ তিনি তাঁকে পড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
শবে কদর গোপন করার হেকমত।
শবে কদর অনির্দিষ্ট থাকার মধ্যেও বেশ কিছু হেকমত ও কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে বলিয়া ওলামায়ে কেরাম বর্ণনা করিয়াছেন।
এক. শবে কদর নির্দিষ্ট থাকিলে অনেক দুর্বল মনের লোক এমন হইত, যাহারা অন্যান্য রাত্রের এবাদত একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিত। বর্তমান অবস্থায় আজই শবে কদর হইতে পারে এই সম্ভাবনায় অনুসন্ধানকারীদের জন্য বিভিন্ন রাত্রে এবাদত করার তওফীক নসীব হইয়া যায়।
দুই. অনেক মানুষ এমন আছে যাহারা গোনাহ না করিয়া থাকিতেই পারে না। শবে কদর নির্দিষ্ট হইলে ঐ নির্দিষ্ট রাত্র জানা থাকার পরও যদি গোনাহের দুঃসাহস করিত তবে তাহারা নিশ্চিত ধ্বংস হইয়া যাওয়ার আশংকা ছিল। একদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে তশরীফ আনার পর দেখিলেন যে, জনৈক সাহাবী ঘুমাইয়া রহিয়াছেন। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রাযিঃ)কে বলিলেন, তুমি তাহাকে জাগাইয়া দাও যেন সে ওযূ করিয়া নেয়। হযরত আলী (রাযিঃ) লোকটিকে জাগাইবার পর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, নেক কাজে তো আপনি খুবই দ্রুত আগাইয়া যান কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনি নিজে তাহাকে জাগাইলেন না কেন? হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেন, আমি জাগাইতে গেলে (ঘুমের ঘোরে) হয়ত সে অস্বীকার করিয়া বসিত। আর আমার কথা অস্বীকার করিলে কুফর হইয়া যাইত। পক্ষান্তরে তোমার কথা অস্বীকার করিলে কুফর হইবে না। এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা ইহা পছন্দ করিলেন না যে, এই মহান মর্যাদাবান রাত্রটির কথা জানার পর কোন বান্দা উহাতে গোনাহের দুঃসাহস করুক।
তিন. শবে কদর নির্দিষ্ট থাকিলে যদি ঘটনাক্রমে কাহারও এই রাত্রটি ছুটিয়া যাইত, তবে মনোকষ্টের দরুন তাহার জন্য আর কোন রাত্র জাগরণই নসীব হইত না। এখন তো অন্তত রমযানের দুই একটি রাত্র জাগা সকলের ভাগ্যে জুটিয়াই যায়।
চার, যতগুলি রাত্র শবে কদরের তালাশে জাগিয়া থাকিবে প্রত্যেকটির জন্যই পৃথক পৃথক সওয়াব লাভ করিবে।
পাঁচ. পূর্বে এক রেওয়ায়াতে বর্ণনা করা হইয়াছে যে, রমযানের এবাদতের উপর আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সহিত গর্ব করিয়া থাকেন। শবে কদর অনির্দিষ্ট থাকা অবস্থায় গর্ব করার সুযোগ বেশী হয়। কেননা, তারিখ নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বান্দা রাত্রের পর রাত্র জাগিয়া এবাদতে মশগুল হইয়া থাকে। যদি নির্দিষ্ট করিয়া বলা হইত যে, এই রাত্রই শবে কদর, তবে কি তাহারা এত রাত্র জাগ্রত থাকিয়া এবাদত করিতে চেষ্টা করিত?
এতদ্ব্যতীত আরও অন্যান্য কল্যাণও থাকিতে পারে। বস্তুতঃ এই সব কারণে আল্লাহ তায়ালার বিধান এইরূপ চলিয়া আসিয়াছে যে, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে তিনি গোপন করিয়া রাখেন। যেমন ইসমে আজমকে গোপন করিয়া রাখিয়াছেন। এমনিভাবে জুমার দিনে দোয়া কবূল হওয়ার খাছ ওয়াক্তকেও গোপন করিয়া রাখিয়াছেন। অনুরূপভাবে আরও বহু বিষয়ই তিনি গোপন রাখিয়া দিয়াছেন। অবশ্য এখানে ইহারও সম্ভাবনা রহিয়াছে যে, ঝগড়ার কারণে শুধুমাত্র সেই রমযানেই শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখটি ভুলাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর উল্লেখিত অন্যান্য হেকমত ও কল্যাণের কারণে চিরদিনের জন্যই অনির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
তথ্যসূত্র: ফাজায়েলে আমল
তথ্যসূত্রঃ. লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)