অহংকার কী?

মানুষের একটি মারাত্মক ব্যাধি হলো ‘অহংকার’। অহংকার করে জেনেও কোনো ব্যক্তিই অহংকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। এটি এমন এক মারাত্মক মানসিক ও চারিত্রিক রোগ; যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। অহংকারী ব্যক্তি চরম ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত। যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতেও যেতে পারবে না। অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। একে আরবীতে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায-সকল রোগের জননী’।

অহংকারের আভিধানিক অর্থ

ইবনে ফারেস রহ. বলেন, [আল-কিবর] অর্থ গর্ব, অহংকার ও বড়ত্ব। : [আল-কিবরিয়া] অর্থও অনুরূপ। বলা হয়- وَرَدُّوْ الْمَجْدَ كَابِرًا عَنْ كَابِرٍ. তারা মর্যাদা ও সম্মান বড়দের থেকে উত্তরাধিকারীরূপে লাভ করেছে। অর্থাৎ বড়রা ইজ্জত সম্মান ও মহত্ত বড়দের থেকেই লাভ করেছেন। [মু’জামু মাকায়ীসিল লুগাহ : ৫/১৫৪]

ইবনে মানযুর বলেন, ji [আল-কিবর] শব্দটি [কাফ বর্ণ যেরবিশিষ্ট হলে] এবং [আল-কিবরিয়া] শব্দটির অর্থ গর্ব, অহংকার, বড়ত্ব এবং ঔদ্ধত ও স্বেচ্ছাচার।

অহংকারের পারিভাষিক অর্থ

শরয়ী পরিভাষায় অহংকার কাকে বলে বা অহংকারের সংজ্ঞা কী- তা নবীজি (সা,) নিজেই তাঁর পবিত্র হাদীসে বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন, এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, নবীজি এ ইরশাদ করেছেন- لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَال الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ.

যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, [হে আল্লাহর রাসূল!] মানুষ চায় তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক [এ-ও কি অহংকার]? নবীজি বললেন, আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অহংকার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায়কে অস্বীকার করা এবং মানুষকে অবজ্ঞা করা। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৫, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৯৯]

বর্ণিত হাদীসে নবীজি দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ অংশে অহংকারের পরিচয় বর্ণনা করেছেন।

এক.[ দম্ভভরে সত্যকে অস্বীকার করা।]

অর্থাৎ তুচ্ছ মনে করে সত্যকে অস্বীকার করা এবং বড়ত্ব ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে সত্যকে গ্রহণ করে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা।

আমরা আমাদের বর্তমান সমাজে এমন অনেক মানুষ দেখতে পাই, যাদের কাছে তাদের তুলনায় বয়সে কিংবা পদ ও মর্যাদাগতভাবে নিম্নমানের কেউ যদি এমন কোনো বিষয় উপস্থাপন করে, যা সন্দেহাতীতভাবেই সত্য ও হক বলে প্রমাণিত কিন্তু তা তাদের মতামত ও বিশ্বাসের পরিপন্থী অথবা তারা যা স্থির করে নিয়েছে কিংবা যে অনুযায়ী আমল করছে তার পরিপন্থী, তা হলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে; তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। পাশাপাশি হক উপস্থাপনকারীকে হীন ও তুচ্ছ ভাবতে থাকে এবং তার বিরোধিতায় হঠকারিতা প্রদর্শন করে। অনেক সময় এমনও হয় যে, তাদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য কল্যাণও সত্যের দিকটিতেই নিহিত থাকে। অপরদিকে তারা যে বাতিলের উপর অবিচল ও অনড় হয়ে বসে আছে, তাতে তাদের কোনো কল্যাণ বা মঙ্গল থাকে না।

আমাদের সমাজে এ শ্রেণির মানুষের সংখ্যাই বেশি। বিশেষত ছোটখাটো পরিসরে তারা এমনটা করে থাকে অধিকহারে। যেমন, পরিবারের অভ্যস্তরে, স্কুল-মাদরাসাতে, কর্মক্ষেত্রে ও সহপাঠীদের সাথে। এ ধরনের অহংকারীরা যে জিনিসটার ভয় করে, তা হচ্ছে, যদি সে অন্যের কাছ থেকে সত্যকে গ্রহণ করে, তা হলে তার তুলনায় ওই ব্যক্তির সম্মান বেড়ে যাবে। মানুষ তাকে সম্মান করবে এবং সে নিজের জন্য যে মর্যাদা ও আসন কামনা করে, লোকটি সেক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যাবে। সে আশঙ্কা করে, অন্যের কাছ থেকে সত্য গ্রহণ করলে অন্যের অনুসারী হতে বাধ্য হতে হবে।

এই অহংকারী যদি একবার বিবেককে কাজে লাগাত এবং জ্ঞানের আলোকে চিন্তা করত, তা হলে সে বুঝতে পারত, তার মান-মর্যাদা ও সম্মান হকের আনুগত্য ও অনুসরণে; বাতিলের উপর একগুঁয়েমিতে নয়।

উমর ইবনুল খাত্তাব আবু মুসা আশআরী -র কাছে পত্র লিখলেন- তোমার গতকালের কৃত ফায়সালার পর যদি তুমি সত্যকে তার বিপরীত উপলব্ধি করতে পার, তা হলে তোমার নফস যেন তোমাকে সত্যের প্রতি রুজু করতে বাধা না দেয়। কেননা, সত্য চিরন্তন। সত্যের দিকে রুজআত করা [ফিরে আসা] বাতিলের উপর অনড় থাকার চেয়ে অনেক শ্রেয়। [দারাকুতনী : ৪/২০৬]

আবদুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, আমরা একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে উবাইদুল্লাহ ইবনে হাসানও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বিচারক। আমি তাঁকে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তরদানে ভুল করলেন। আমি তাঁকে বললাম, আল্লাহ আপনাকে সংশোধন করে দিন। এ মাসআলার ক্ষেত্রে সঠিক ফায়সালা হচ্ছে এমন। আমার কথা শুনে তিনি কিছুক্ষণ মাথা নুইয়ে রাখলেন। অতঃপর মাথা তুলে বললেন, ‘আমি আমার কথা থেকে রুজু করলাম। আমি আমার কথা থেকে ফিরে এলাম। আমি ছোট। আমার ভুল হয়েছে।” “আমি আমার কথা থেকে রুজু করলাম। আমি আমার কথা থেকে ফিরে এলাম। আমি ছোট। আমার ভুল হয়েছে।’ মিথ্যায় থেকে নেতা হওয়ার চেয়ে সত্যের ব্যাপারে অধীনস্ত হয়ে থাকা আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয়। [তারীখে বাগদাদ : ১০/৩০৮]

দুই.[ মানুষকে অবজ্ঞা করা ]

আল গাম্ত: অর্থ অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ মনে করা, ছোট মনে করা।

সুতরাং,গামতুন নাস: অর্থ মানুষকে অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ মনে করা, ছোট মনে করা, নিকৃষ্ট জ্ঞান করা তাদেরকে কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। তাদের হক আদায় না করা। মানুষের গুণ ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি না দেওয়া। তাদের গুণের কারণে তাদের প্রশংসা না করা, বরং নিজেকে তাদের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ মনে করা।

মানুষকে হেয়জ্ঞান, অবজ্ঞা ও নিকৃষ্ট মনে করার এ অপরাধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, যখন ওই অহংকারী মানুষের ইজ্জত ও সম্মানের দেয়ালকে ধ্বংস করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। মানুষের যোগ্যতা ও গুণাগুণকে মিটিয়ে দিতে চেষ্টা চালাতে থাকে। মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা বলে, অপবাদ আরোপ করে তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ছোট করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। এভাবে ওই অহংকারী নিজের জন্য উচ্চ মর্যাদা ও আসনকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে। একজন অহংকারী যখন নিজের মেধা, গুণ ও যোগ্যতার বলে মর্যাদার স্তরে উন্নীত হতে না পারে, তখন সে নিজের আসন ও মর্যাদা ধরে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে অন্যদের মর্যাদা ও কৃতিত্বকে নষ্ট করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। অন্যের মর্যাদাকে মানুষের মাঝে খাটো করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

ইমাম যুবাইদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘অহংকার হলো নিজেকে বড় মনে করা, নিজের ভালো গুণে প্রীত হওয়া, অন্য মানুষকে নীচ ও ছোট মনে করা, যাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া দরকার তাদের চেয়ে নিজকে উঁচু মনে করাই অহংকার।

অহংকার কী?

অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। একে আরবীতে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায’ তথা সকল রোগের জননী। বরং বলা যায়, এ জগতের প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার। সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব আমাদের পিতা আদম-কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ করেছিলেন, তোমরা আদমকে সেজদা কর। আদম-কে সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ যখন ফেরেশতাদের তাঁর মানব-সৃষ্টির ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তখন তারা বলেছিল, আপনি আমাদের রেখে এমন কোনো জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা নৈরাজ্য ঘটাবে, একে অন্যের রক্ত ঝরাবে, অথচ আমরা তো আপনার সার্বক্ষণিক ইবাদতে মগ্ন!

‘যাহোক, অবশেষে আদম-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, তোমরা আদমকে সেজদা কর, তখন সকলেই সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। এই তো ফেরেশতাদের পরিচয়। তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা-ই করে। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- آبی وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَفِرِينَ) সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা বাকারা : ২]

এই হল প্রথম অহংকারের ইতিহাস। কুরআনে কারীমে বর্ণিত প্রথম পাপের বিবরণ। এ পাপের কারণে শয়তান অভিশপ্ত হল, জান্নাত থেকে বিতাড়িত হল, মানুষের শত্রুতার ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে এল। কত শক্ত শপথ সেদিন সে করেছিল- قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ﴿۲﴾ ثُمَّ لَاتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَ مِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ

সে বলল, আপনি যেহেতু আমাকে পথচ্যুত করেছেন তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। [সূরা আ’রাফ : ১৬-১৭]

এই যে শয়তানের শপথ এবং এ শপথের শক্তিতে সে বিভ্রান্ত ও পথহারা করে যাচ্ছে বনী আদমকে, এর মূলে তো সেই অহংকার। অহংকার তাই বিবেচিত হয় সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক রোগ হিসেবে। অহংকার একটি ঘাতক ব্যাধি। পবিত্র কুরআনে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে এই ঘাতক ব্যাধির কথা। ঘাতক ব্যাধি বলার কারণ তা মানুষের অন্তর্জগতকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর এর পরকালীন ক্ষতি তো রয়েছেই। যে অহংকার শয়তানকে ‘শয়তানে’ পরিণত করেছে, অভিশপ্ত করে দিয়েছে, রহমতবঞ্চিত করেছে, সে অহংকারের মন্দ দিক সম্পর্কে আর কিছু না বললেও চলে। এরপরও আল্লাহ ইরশাদ করেছেন- سَأَصْرِفْ عَنْ ابْتِي الَّذِيْنَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ . পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব। [সূরা আ’রাফ : ১৪৬]

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেছেন- الهُكُمْ إِلَهُ وَاحِدٌ، فَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ قُلُوبُهُمْ مُنْكِرَةٌ وَهُمْ مُسْتَكْبِرُونَ ﴿۲۲﴾ لَا جَرَمَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। সুতরাং, যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহংকারে লিপ্ত। স্পষ্ট কথা, তারা যা গোপনে করে আল্লাহ তাজানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তাও। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না। [সূরা নাহল : ২২-২৩]

বই : অহংকার করবেন না

লিখক : শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *