ইবাদত

জিলহজের প্রথম দশ দিনের তাৎপর্য কী?

[১] আল্লাহ আযযাওয়াজাল তাঁর কুরআনে উল্লেখ করার মাধ্যমে এই দিনগুলোকে সম্মানিত করেছেন,

আল্লাহ তা’লা বলেন ,لِيَشْهدوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَمِ যাতে তারা সাক্ষ্য হতে পারে তাদের জন্য কল্যাণকর বিষয়ের (আখিরাতে এবং দুনিয়াতে হাজ্জের পুরষ্কার ইত্যাদি), নির্দিষ্ট দিনগুলোয় যেন তারা আল্লাহকে স্মরণ করতে পারে তাদেরকে (কুরবানির উদ্দেশ্যে) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তুসমূহের জন্য। সূরা হাজ্জ, ২২ : ২৮/

অধিকাংশ আলিমগণ এই বিষয়ে একমত যে ওই ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হল জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন; কেননা ইবনু আব্বাসের (রদিআল্লাহু আনহু) উক্তি রয়েছে, “এই নির্ধারিত দশ দিন হল প্রথম দশ (জিলহজ্জের)।” সহিহ বুখারি ৯৬৯, সুনানে আবু দাউদ ২৪৩৮

[২] আল্লাহ এই দিনগুলোকে সম্মানিত করেছেন কুরআনে এই দিনগুলোর শপথ নিয়ে,

আর কোনো কিছুর নামে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের শপথ সেই বিষয়ের অপরিসীম গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের ইঙ্গিত দেয়। আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন, وَالْفَجْرِ () وَلَيَالٍ عَشْرٍ শপথ ঊষার। শপথ দশ রজনীর। সূরা ফাজর, ৮৯ : ১-২ ইবনু আব্বাস, ইবনুল জুবাইর, মুজাহিদসহ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আলিমগণের অভিমত হলঃ এই আয়াতে জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের কথা বলা হয়েছে।তাবারি ২৪/৩৯৬ আর ইবনু কাসির (রহিমাহুল্লাহ) এই মতটির ব্যাপারে বলেছেন, “এটিই সঠিক মত”।

[৩] এই দিনগুলোকে সবচেয়ে সম্মানিত এবং সর্বোত্তম দিন হিসেবে ধরা হয়

আহমাদ এবং আত-তাবারানি ইবনু উমার হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ বলেন,“আল্লাহর দৃষ্টিতে এই দিনসমূহ (জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন) থেকে মর্যাদাপূর্ণ দিন আর নেই এবং এই দিনগুলোতে করা ইবাদাতের চেয়ে প্রিয় ইবাদাত আর নেই। সুতরাং এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (لا اله الا الله), তাকবির ( الله اكبر) এবং তাহমিদ )الحمد لله) পড়।” (আহমাদ ৭/২২৪, আহমাদ শাকির (রহিমাহুল্লাহ) একে সহিহ বলেছেন)

وَقَفَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ بَيْنَ الْجَمَرَاتِ فِي الْحَجَةِ الَّتِي حَجَّ بِهَذَا، وَقَالَ ” هَذَا يَوْمُ الْحَجَ الأَكْبَرِ ، فَطَفِقَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ اللَّهُمَّ اشْهَدْ”. وَوَقَعَ النَّاسَ فَقَالُوا هَذِهِ حَجَّةُ الْوَدَاعِ

ইবনু উমার (রদিআল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, “নাহরের দিন (১০ই জিলহজ্জ) রাসূলুল্লাহ তাঁর হাজ্জের সময় জামরাতের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘আজকের দিনটি হল সর্বশ্রেষ্ঠ দিন।’ রাসূলুল্লাহ বারংবার বলতে লাগলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন (আমি আপনার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি)’। এরপর তিনি মানুষদের বিদায় দিলেন। তাই লোকেরা বলতে থাকল, এটা হাজ্জাতুল ওয়াদা’ (বিদায় হাজ্জ)। সহিহ বুখারি ১৭৪২

قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِمِنِّى ” أَتَدْرُونَ أَى يَوْمِ هَذَا ” قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ” فَإِنَّ هَذَا يَوْمُ حَرَام أَفَتَدْرُونَ أَى بَلَدٍ هَذَا قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ بَلَدُ حَرَامٍ، أَتَدْرُونَ أَيُّ شَهْرٍ هَذَا قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ” شَهْرُ حَرَام ” قَالَ ” فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمْ دِمَاءَ كُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِ كُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا

ইবনু উমার (রদিআল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, মিনায় রাসূলুল্লাহ বললেন, “তোমরা কি জানো আজকের দিনটি কী?” লোকেরা উত্তর দিল, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “আজকের এই দিনটি হল ইয়াউমুল হারাম (পবিত্র দিন)। আর তোমরা কি জানো এই শহরটা কী?” লোকেরা জবাব দিল, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “বালাদুন হারাম (পবিত্র শহর)।

আর তোমরা কি জানো এই মাসটা কী মাস?” লোকেরা উত্তর দিল, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।” তিনি বললেন, “এই মাসটি হল হারাম (পবিত্র মাস)।” এরপর রাসূলুল্লাহ বললেন, “সন্দেহাতীত, আল্লাহ তোমাদের রক্ত, সম্পদ এবং সম্মান একে অপরের জন্য হারাম (পবিত্র) করেছেন তোমাদের এই দিনের, এই মাসের, এই শহরের পবিত্র হওয়ার মতই।” (সহিহ বুখারি ৬০৪৩)

[৪] এই দিনগুলোর ইবাদাত জিহাদ থেকেও উত্তম (সাধারণ অবস্থায় সর্বোত্তম যে ইবাদাত আমরা করতে পারি)

জিহাদের ফযিলতের তুলনায় আর কোনো ইবাদাতের ব্যাপারেই এত বেশি সংখ্যক হাদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের ইবাদাত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ থেকেও উত্তম৷ রাসুলুল্লাহ বলেছেন যে কারও যদি জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনে ইবাদাতকারীর চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে হয়, তাহলে তাকে তার সম্পদ আর পরিবার নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে চলে যেতে হবে; সে আর ফিরে আসবে না এবং তার সম্পদ খুইয়ে ফেলবে। عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ ” مَا الْعَمَلُ فِي أَيَّامِ الْعَشْرِ أَفْضَلَ مِنَ الْعَمَلِ فِي هَذِهِ “. قَالُوا وَلَا الْجِهَادُ قَالَ ” وَلَا الْجِهَادُ إِلا رَجُلٌ خَرَجَ يُخَاطِرُ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ بِشَيْءٍ

ইবনু আব্বাস (রদিআল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ বলেন, “অন্য কোনো দিনের কোনো আমলই এই দিনগুলোতে (জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনে) করা ইবাদাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর নয়।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এমনকি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? তিনি বললেন, “এমনকি জিহাদও নয়; অবশ্য এমন ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে কিনা নিজের জান আর মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে যায় আর সেগুলোর কিছুই না নিয়ে ফেরে।” (সহিহ বুখারি ৯৬৯, সুনানে আবু দাউদ ২৪৩৮, জামি’ আত-তিরমিযি ৭৫৭ ইত্যাদি)

[৫] কয়েকজন সাহাবা এবং তাবেঈদের আমল

কয়েকজন সাহাবা এবং তাবেঈনের (সাইদ ইবনু জুবাইরও তাঁদের একজন) থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন আসতো, তাঁরা এই সুযোগ কাজে লাগাতেন আর এত বেশি পরিমাণ ইবাদাত করতেন যে এর চেয়ে বেশি ইবাদাত করা আর সম্ভব ছিল না।

এই দিনগুলো কেন এত মর্যাদাপূর্ণ ?

ইবনু হাজার আসকালানি (রহিমাহুল্লাহ) এই দিনগুলোর বিশেষ মর্যাদার বাহ্যিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই দিনগুলো এত মর্যাদাপূর্ণ কারণ এই সময়ে শ্রেষ্ঠ ইবাদাতসমূহ পালন করা হয় যা আর অন্য কোনো সময়েই হয় না। (অর্থাৎ, সালাত, দান-সাদাকা, সাওম এবং হাজ্জ সব ইবাদাতই করা হয়)

এই দিনগুলো কি রমাদানের শেষ দশ দিন হতেও উত্তম?

অধিকাংশ আলিমগণ এই মত দিয়েছেন যে, জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন রমাদানের শেষ দশ দিন থেকে উত্তম৷º কেননা রমাদানের শেষ দশদিনের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে লাইলাতুল কদর এর কারণে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম৷ পরের হাদিসটি জিলহজ্জের প্রথম দশদিনের প্রত্যেক দিন এবং রাতের ইবাদাতের সমন্বয় যে লাইলাতুল কদরের ইবাদাতের সমতুল্য তার ওপর আলোকপাত করে। النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامٍ سَنَةٍ وَقِيَامُ كُلّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ “

আবু হুরাইরাহ (রদিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ বলেন, “আল্লাহর নিকট জিলহজ্জের দশ দিনের ইবাদাতের তুলনায় আর কোনো দিনের ইবাদাতই অধিক প্রিয় নয়। এই দিনগুলোর প্রত্যেক দিনের সিয়াম এক বছরের সিয়ামের ন্যায় আর এর প্রত্যেক রাতের সলাতুত তাহাজ্জুদ লাইলাতুল কদরের শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায়ের ন্যায়।” জামি’ আত-তিরমিযি ৭৫৮, সুনান ইবনু মাজাহ ৭/১৮০০, সুনানে বায়হাকি কুবরা ৩৭৫৭; হাদিসটি যয়িফ

শাইখুল মুহাদ্দিস সুলাইমান আল-আলওয়ান তাঁর সহিহুল বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন, “উলামাগণ, আল্লাহ তাঁদের উপর রহমতবর্ষণ করুন – রমাদানের শেষ দশ দিন শ্রেষ্ঠ নাকি জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন শ্রেষ্ঠ – এই ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।ফুকাহাদের একদল বলেছেন যে রমাদানের শেষ দশ দিন শ্রেষ্ঠ। আবার অপরদল বলেছেন নিশ্চয়ই জিলহজ্জের প্রথমদশ দিনই শ্রেষ্ঠ।আবার আরেকদল আলিম আরও গভীর বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন এই বলেঃ “নিশ্চয়ই রমাদানের শেষ দশ ‘রাত’ জিলহজ্জের শেষ দশ‘রাত’ থেকে উত্তম, এবং জিলহজ্জের প্রথম দশ ‘দিন’ রমাদানের শেষ দশ ‘দিন’ থেকে উত্তম৷”

আর এটা হল ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) সহ কয়েকজনের মত। আর এই মতটিও আরও একটু ভালভাবে দেখতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “আর কোনো দিবসই… (জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের চেয়ে উত্তম নয়)।” আর হাদিসে সাধারণভাবে‘আল-ইয়াওম’ সম্বোধন করা হয়েছে যা মূলত রাত আর দিন উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে (অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা)।

তাই যা বললে আরও সঠিক হয় তা হলঃ “নিশ্চয়ই জিলহজ্জের প্রথম দশ রমাদানের শেষ দশের চেয়ে উত্তম।” রাত-দিনের পার্থক্য(করে বলা প্রয়োজন) নেই। আর লাইলাতুল কদরের রাত যখনই হয়, তা জিলহজ্জের দশ দিন আর রাত থেকেও উত্তম; কেননা এইরাত একাই জিলহজ্জের দশ (দিন ও রাত) থেকে উত্তম। আর রমাদানের বাদবাকি রাত; সেগুলো জিলহজ্জের থেকে উত্তম নয়।”

কিতাব : জিলহজের প্রথম ১০ দিন

লেখক : আহমদ মুসা জিবরীল

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *