এ জীবন,দেহ,চোখ,কান,জিহবা সবই আল্লাহর আমানত
আল্লাহ তা’আলা একটা ভারকে আমানত শব্দে ব্যক্ত করেছেন। তা কি সে আমানত ভার, যা মানুষের সামনে পেশ করা হলে নিশ্চিন্তে গ্রহণ করে নিল ? মুফাসসিরগণ বলেন, তা হল মানুষের বর্তমান জীবন। অর্থাৎ তাকে বলা হয়েছিল, তোমাকে এমন এক জীবন দিতে চাই, যে জীবনে তোমার ভালো কাজ করারও এখতিয়ার থাকবে এবং মন্দ কাজ করারও এখতিয়ার থাকবে। ভালো কাজ করলে তো আমার সন্তুষ্টি লাভ হবে এবং জান্নাতের স্থায়ী নিয়ামতের অধিকারী হবে আর যদি মন্দ কাজ কর, তবে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। তোমার উপর আমার ক্রোধ পতিত হবে এবং জাহান্নামের স্থায়ী আযাব ভোগ করবে। বল, তোমরা কি এরূপ জীবন গ্রহণ করবে ? কেউ প্রস্তাবে রাজি হল না, কিন্তু মানুষ তা স্বীকার করে নিল ।
হাফিজ সীরাজী (রহঃ) বলেন, اسماء بار امانت نتوانست کشید قرعہ فال بنام من دیوانه زند ‘আমানতের ভার বহনে আসমান তো সক্ষম হল না । সে তো এই বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল যে, এটা বহনের সাধ্য আমার নেই, কিন্তু এই পাগল মানুষ ঠিকই তা কাঁধে তুলে নিল। লটারিতে নাম উঠল আমারই। যা হোক কুরআন মাজীদ একেই আমানত নামে অভিহিত করেছে।
এই দেহও এক আমানত
এই জীবনটাই আমাদের কাছে আমানত । এ আমানতের দাবি হল গোটা জীবনকে আল্লাহ তা’আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধান মোতাবেক পরিচালিত করা । প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে আল্লাহ প্রদত্ত সর্বাপেক্ষা বড় আমানত হল তার নিজ অস্তিত্ব।এ আমানত ভার প্রতিটি মানুষের কাঁধে চাপানো। এর বাইরে নেই কেউ।
মানবদেহ তার অংগ-প্রত্যংগ তার সময় ও শক্তি তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা সবই তার কাছে আমানত । কেউ কি নিজেকে তার হাতের মালিক মনে করে ? এমন কে আছে, যে বলতে পারে এই চোখের মালিক আমি নিজে? কেউ তা বলবে না। বরং আমার প্রতিটি অংগই আমার কাছে গচ্ছিত আমানত। আমি এর মালিক নই। কাজেই আমি আমার ইচ্ছামত একে ব্যবহার করতে পারি না। এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত। তিনি আমাদেরকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এর দাবি হল, আমি আমার অংগ-প্রত্যংগ এবং আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতাকে কেবল সেই কাজেই ব্যবহার করব, যে কাজের জন্য এগুলো আমাকে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া অন্য কোন কাজে কিছুতেই ব্যবহার করব না । তা করলে আমানতের খেয়ানত হয়ে যাবে।
চোখ এক আমানত
উদাহরণত চোখ আল্লাহ তা’আলার এক নিআমত । তিনিই আমাদেরকে এটা দিয়েছেন। এটা এমনই এক নিয়ামত, যা সারা দুনিয়ার সমস্ত অর্থ- সম্পদ ব্যয় করেও অর্জন করা সম্ভব নয়। জন্ম থেকেই যেহেতু এই সরকারী মেশিন আমাদের কপালে লাগানো আছে এবং অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে, তাই আমাদের কাছে এর কদর নেই। এর জন্য আমাদের কোন পয়সা খরচ করতে হয়নি, কোন মেহনতও করতে হয়নি। তাই এ মুক্ত মালের কোন মূল্য আমরা দেই না।
আল্লাহ না করুন কখনও যদি দৃষ্টিশক্তিতে দুর্বলতা দেখা দেয় এবং এমন রোগ দেখা দেয়, যদ্দরুন এ শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পাওয়ার আশংকা দেখা দেয় তখন এর মূল্য ঠিকই বুঝে আসে। তখন মানুষ তার এই এক অংগের জন্য সারা জীবনের সবটা সঞ্চয়ও ব্যয় করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এটা এমনই এক মেশিন, যার না সার্ভিসিং দরকার পড়ে, না ওভারহলিং। এমনিভাবে না আছে এর কোন মাসিক খরচ, না ট্যাক্স ও ভাড়া। একদম মুফতের মাল।
আল্লাহ তা’আলা এই মেশিন আমাদেরকে আমানতস্বরূপ দান করেছেন। বলে দিয়েছেন, তোমরা এটা ব্যবহার কর, এর দ্বারা দুনিয়া দেখ, দুনিয়ার মনোরম দৃশ্যাবলী উপভোগ কর এবং সব কিছুই কর, তবে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র আছে, তাতে এই সরকারি মেশিন ব্যবহার করো না। যেমন, এর দ্বারা পরনারীর দিকে তাকিও না।
সুতরাং আমরা যদি এর দ্বারা পরনারী দেখি, তবে আমানতের খেয়ানত হয়ে যাবে। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাতকে খেয়ানত শব্দে উল্লেখ করেছেন । ইরশাদ হয়েছে- يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ ‘তিনি জানেন চোখের খেয়ানত এবং সেই সব কিছু যা অন্তর গোপন করে।
অর্থাৎ যা দেখতে নিষেধ করা হয়েছে যে ক্ষেত্রে চোখ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে । সেখানে চোখকে ব্যবহার করে যে খেয়ানত তুমি করেছ, তা আল্লাহর অগোচর নয়। তিনি তা ঠিকই জানেন । সময় মত কৈফিয়ত নেবেন। এটা ঠিক এরকম, যেমন কেউ নিজের কোন মাল অন্যের কাছে আমানত রাখল, আর সেই লোক লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের আড়ালে তা নিজে ব্যবহার করল। আল্লাহ প্রদত্ত নিআমতের অন্যায় ব্যবহারও ঠিক এরকমই।
কিন্তু নির্বোধ মানুষ চিন্তা করে না যে, আল্লাহ তা’আলার দৃষ্টির আড়ালে নেই কোন কিছু। কিছুই তাঁর থেকে লুকানো যায় না। তাই আল্লাহ তা’আলা চোখের খেয়ানতকে কঠিন গুনাহ ও গুরুতর অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য ভয়ানক শাস্তির সতর্কবাণী শুনিয়েছেন।
পক্ষান্তরে চোখের এ আমানত ও নি’আমতকে সঠিক জায়গায় ব্যবহার করলে আল্লাহ তা’আলা খুশী হন এবং এজন্য বান্দার প্রতি রহমত নাযিল করেন । হাদীছ শরীফে আছে,কেউ যদি ঘরে ঢুকে নিজ স্ত্রীর প্রতি মহব্বতের দৃষ্টিতে তাকায় এবং স্ত্রীও স্বামীকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে, তবে আল্লাহ তা’আলা তখন উভয়ের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করেন । কেননা, তারা আমানতের সঠিক ব্যবহার করেছে, যদিও সে দৃষ্টি ছিল নিজেদের জৈবিক আনন্দের জন্য। হোক তা ব্যক্তিগত ও জৈবিক আনন্দের জন্য, কিন্তু তা যেহেতু আল্লাহ তা’আলার হুকুম মোতাবেক করেছে, তাই তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার রহমত নাযিল হয়েছে।
জিহবা আল্লাহর আমানত
জিহবাও আল্লাহ তা’আলার এমন এক নি’আমত যা বান্দা জন্ম থেকেই লাভ করেছে এবং মৃত্যু পর্যন্ত তা তার সংগে থাকে। জিহবার সামান্য একটু নাড়াচাড়ার মাধ্যমে মানুষ যে কত রকম কাজ নেয় তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এটা কত বড় নি’আমত তা তো এর দ্বারাই বোঝা যায় যে, সামান্য একটু নাড়লেই উচ্চারণ করা যায়, سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ
আর হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে এতে দাড়িপাল্লার অর্ধেক ভরে যায়। সুতরাং এর মাধ্যমে আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত । সেটাই হবে এর যথার্থ ব্যবহার। তার পরিবর্তে একে যদি মিথ্যা বলা, গীবত করা, মুসলিমদের মনে আঘাত করা ও অন্যকে কষ্টদানের কাজে ব্যবহার করা হয় তবে তা হবে আমানতের খেয়ানত।
বই : মন্দচরিত্র ও তার সংশোধন
লিখক : জাস্টিজ আল্লামা তাকী উসমানী