কৃপণতা : সফলতা আর সমৃদ্ধির জন্য এ ব্যাধিকে দূর করতেই হবে
মাসিক আল কাউসার থেকে সংগৃহিত
আদমসন্তানকে পদে পদে বিভ্রান্ত করার যে প্রতিজ্ঞা শয়তান করেছিল, এর বাস্তবায়ন হিসেবেই নানান সময় নানানভাবে সে মানুষকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে। আল্লাহর পথ থেকে তাকে সরিয়ে দিতে শয়তানের চক্রান্তের কোনো অন্ত নেই। সুন্দরকে অসুন্দর আর অসুন্দরকে সুন্দর হিসেবে তুলে ধরতে সে সদা সচেষ্ট। এমন একটি চক্রান্তের বিষয়েই পবিত্র কুরআনে এভাবে সতর্ক করা হয়েছে-
اَلشَّیْطٰنُ یَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَ یَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ، وَ اللهُ یَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا ، وَ اللهُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ.
শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে কার্পণ্যের আদেশ করে। অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও দয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৮
মহান প্রভুর এ বাণীর মর্ম তো খুবই সরল। আল্লাহ মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন- সম্পদ ব্যয় করলে তিনি অনুগ্রহ করে সম্পদ আরও বাড়িয়ে দেবেন। এর বিপরীতে শয়তানের সতর্কবার্তা- সম্পদ যদি ব্যয় করে ফেল তাহলে তো গরীব হয়ে পড়বে, তাই নিজ সম্পদকে আঁকড়ে ধর, কৃপণতা অবলম্বন কর! কথাটি এভাবেও বলা যায়- কৃপণতা হচ্ছে শয়তানের একটি হাতিয়ার, যা দিয়ে সে মানুষকে সরল পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়।
নানা প্রয়োজনেই আমাদের সম্পদ ব্যয় করতে হয়। কখনো নিরেট ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিংবা পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন মেটাতে আমরা সম্পদ ব্যয় করি। কখনোবা সামাজিক প্রয়োজন মেটাই। সমাজবদ্ধভাবে চলতে গিয়ে সমাজের নানা চাহিদা আর প্রয়োজনও পূরণ করতে হয়। সম্পদ ব্যয় করতে হয় কোনো কোনো ধর্মীয় বিধানের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে কখনো তো সম্পদ ব্যয় করাটাই হয় মুখ্য। যেমন, যাকাত, সদাকাতুল ফিতর ইত্যাদি। আবার কখনো কোনো একটি ধর্মীয় বিধান পালন করতে গিয়ে আমাদের সম্পদ ব্যয় করতে হয়। টাকাপয়সা খরচ করে মক্কা মুকাররমায় গিয়ে হজ্ব পালন করতে হয়, কুরবানীর পশু কিনে কুরবানী আদায় করতে হয়। এভাবে সম্পদ ব্যয় কখনো হয় প্রয়োজনে, কখনো ইবাদত হিসেবে। আবার ব্যক্তিগত কিংবা দুনিয়াবি প্রয়োজনের তাগিদে যখন আমরা সম্পদ ব্যয় করি, নিয়তের বিশুদ্ধতায় তাও পুণ্য বয়ে আনতে পারে। মুমিনের সম্পদ ব্যয় কেমন হবে তার একটা সারগর্ভ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পাক কুরআনে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَا تُنْفِقُوْنَ اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ اللٰهِ، وَ مَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَیْرٍ یُّوَفَّ اِلَیْكُمْ وَ اَنْتُمْ لَا تُظْلَمُوْنَ.
তোমরা তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই (সম্পদ) ব্যয় করে থাক। আর যে সম্পদই তোমরা ব্যয় কর তোমাদেরকে তার প্রতিফল পূর্ণমাত্রায় দেয়া হবে এবং তোমাদের ওপর জুলুম করা হবে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৭২
এ তো হল সম্পদ ব্যয়ের নির্দেশনা। কিন্তু সম্পদ ব্যয় করতে গেলে যে কার্পণ্য নামক একটা অদৃশ্য বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়, পবিত্র কুরআনে তাও বলা হয়েছে-
وَ اُحْضِرَتِ الْاَنْفُسُ الشُّحَّ.
এবং মানুষ লোভহেতু স্বভাবত কৃপণ। -সূরা নিসা (৪) : ১২৮
এ কার্পণ্য মানুষের স্বভাবজাত। সম্পদ ব্যয়ের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে ক্ষমা ও দয়ার ঘোষণা করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে স্বভাবজাত এ কৃপণতাকে জয় করতে হবে। নিজের প্রয়োজনে, অন্যের প্রয়োজনে এবং ইবাদতের জন্যে, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে মুমিনকে নিজ উপার্জিত সম্পদ ব্যয় করে যেতে হবে। পরম করুণাময়ের এ সন্তুষ্টি ছাড়া আর মুমিনের চাওয়া-পাওয়ার কী আছে? পবিত্র কুরআনে তিনি কতটা সরলভাবে সম্পদ ব্যয়ের আহ্বান জানিয়েছেন লক্ষ করুন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ یَوْمٌ لَّا بَیْعٌ فِیْهِ وَ لَا خُلَّةٌ وَّ لَا شَفَاعَةٌ، وَ الْكٰفِرُوْنَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.
হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেই দিন আসার পূর্বে, যেদিন কোনো ক্রয়বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না। আর কাফেররাই জালেম। -সূরা বাকারা (২) : ২৫৪
সম্পদ যা কিছু আমাদের হাতে আছে তার সবই তো আল্লাহর দান। কোনো মুমিনই তা অস্বীকার করতে পারে না। এ আয়াতেও আল্লাহ তাআলা সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন : اَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰكُمْ অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো। সম্পদ যখন আল্লাহ দিয়েছেন, তা ব্যয়ের নির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন। কতটুকু ব্যয় করতে হবে, কতটুকু সঞ্চয় করতে হবে তার নির্দেশনাও দিয়েছেন এ পাক কুরআনেই। পড়–ন-
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.
তুমি তোমার হাত তোমার ঘাড়ে আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৯
অর্থাৎ সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্র যখন সামনে আসে তখন হাত পুরোপুরি গুটিয়েও রাখা যাবে না, আবার যত সম্পদ আছে তার সবই দান করে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে কার্পণ্যও করা যাবে না, অপ্রয়োজনে ব্যয় করে সম্পদের অপচয়ও করা যাবে না। স্বভাবধর্ম ইসলাম জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেমন আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ শিক্ষা দেয়, তেমনি সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনা-অপচয় ও কার্পণ্যকে দুই পাশে রেখে এর মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বান্দাদের কিছু পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে। সেখানে তাদের সম্পদ ব্যয়ের নীতি উল্লেখিত হয়েছে এভাবে-
وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَنْفَقُوْا لَمْ یُسْرِفُوْا وَ لَمْ یَقْتُرُوْا وَ كَانَ بَیْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا.
যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৭
সূরা বাকারার ২৫৪ নং আয়াত, যা আমরা উপরে উদ্ধৃত করে এসেছি, তাতে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে দিয়েছেন আমাদেরকে এই বলে- দুনিয়াতে তোমাদেরকে যে সম্পদ দেয়া হয়েছে তার ব্যবহার এবং তা থেকে উপকৃত হতে চাইলে তা ব্যয় করতে হবে দুনিয়াতেই। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে এ সম্পদ ব্যয় করার কোনো সুযোগ থাকবে না। সেখানে ক্রয়বিক্রয় বলতে কিছু থাকবে না। আবার দুনিয়ার এ জীবনে একজনের হাতে সম্পদ দেখে আরও দশজন তার বন্ধু বনে যায়। ন্যায়-অন্যায়ের পরোয়া না করে তার পক্ষে তারা দাঁড়িয়ে যায়। সম্পদকে কেন্দ্র করে এই যে বন্ধুত্ব, তাও এ দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ। দুনিয়াতে আল্লাহর দান এ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে যদি তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করা না যায়, পরকালে তাহলে এ সম্পদের ফল ভোগ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, সম্পদ ব্যয় করতে হবে। কী দুনিয়াবি ব্যক্তিগত প্রয়োজন আর কী ইবাদত; কার্পণ্যকে আশ্রয় দেয়া যাবে না কোথাও। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মুমিনের সম্পদ ব্যয়ও কীভাবে তার জন্যে পুণ্য বয়ে আনে, লক্ষ করুন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً، تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ، إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا، حَتّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ.
সন্দেহ নেই, আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই ব্যয় কর, তাতে তুমি পুরস্কৃত হবেই, এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাবার তুমি তুলে দাও তাতেও (রয়েছে তোমার জন্যে পুরস্কার)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৫
এই হচ্ছে মুমিনের সম্পদ ব্যয়ের ফল। নিজের ক্ষুধা মেটানোর জন্যেও যখন সে কিছু খাবে, তার লক্ষ্য তখন থাকে শারীরিক শক্ত অর্জন, যা কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহ পাকের ইবাদত করতে পারবে। স্ত্রী-সন্তানাদির জন্যে যখন সে কোনোকিছু কিনে নিয়ে আসে, তার লক্ষ্য থাকে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে প্রদত্ত দায়িত্ব পালন এবং তা দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। এমনকি নতুন কাপড়চোপর যখন সে কিনতে যায় তখনো তার মাথায় থাকে আল্লাহ তাআলার দেয়া নিআমতের প্রকাশ ও কৃতজ্ঞতার কথা। আর এ সম্পদ ব্যয় যদি হয় ফরয ইবাদত যাকাত আদায়ের জন্য, ওয়াজিব কুরবানী কিংবা সদাকাতুল ফিত্র আদায়ের জন্যে, এ সম্পদ ব্যয় যদি হয় আল্লাহ তাআলার অভাবী দুঃখী বান্দাদের অভাব ও দুঃখ ঘুচাবার জন্যে, আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্যে, যদি তা ব্যয় হয় তাঁর সৃষ্টির সেবায় রাস্তার ধারে নলকূপ স্থাপনে কিংবা পথিকদের জন্যে কোনো বিশ্রামাগার নির্মাণে, তাহলে তো এর পুরস্কারের কথা বলাই বাহুল্য। শর্ত একটাই- নিয়তটাকে খালেস করে নিতে হবে।
কিন্তু স্বভাবজাত কার্পণ্যকে যদি জয় করা না যায়, কার্পণ্য যদি ইবাদত পালনে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত দায়িত্ব আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার অশুভ পরিণতির কথাও বর্ণিত হয়েছে এ পাক কুরআনেই। কোথাও বলা হয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির কথা, কোথাও বলা হয়েছে সম্পদকে বেড়ি বানিয়ে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেয়ার কথা, কোথাওবা সেই সম্পদকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছেকা দেয়ার কথা।
وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ، بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ، سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ، وَ لِلهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ، وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ.
আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা দিয়েছেন, যারা তা নিয়ে কার্পণ্য করে, তারা যেন কিছুতেই মনে না করে- এটা তাদের জন্যে কল্যাণকর; বরং তা তাদের জন্যে অকল্যাণকর। তারা যা নিয়ে কৃপণতা করেছে অচিরেই তা তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে দেয়া হবে। আর আকাশসমূহ ও পৃথিবীর উত্তরাধিকার তো আল্লাহর। আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮০
اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا، الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ وَ یَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ وَ یَكْتُمُوْنَ مَاۤ اٰتٰىهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ، وَ اَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا مُّهِیْنًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক অহংকারীকে- যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে। আর কাফেরদের জন্যে আমি প্রস্তুত করে রেখেছি লাঞ্ছনাকর শাস্তি। -সূরা নিসা (৪) : ৩৬
وَ الَّذِیْنَ یَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَ الْفِضَّةَ وَ لَا یُنْفِقُوْنَهَا فِیْ سَبِیْلِ اللهِ، فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِیْمٍ، یَّوْمَ یُحْمٰی عَلَیْهَا فِیْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوٰی بِهَا جِبَاهُهُمْ وَ جُنُوْبُهُمْ وَ ظُهُوْرُهُمْ، هٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ.
আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও; যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ¦দেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। (তাদেরকে তখন বলা হবে,) এটাই সে সম্পদ, যা তোমরা নিজেদের জন্যে পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন কর। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৪-৩৫
কার্পণ্য নানা স্তরের হতে পারে। কেউ হয়ত নিজের প্রয়োজনে কিংবা ফরয-ওয়াজিব ইবাদতের ক্ষেত্রে সম্পদ ঠিকই ব্যয় করে, কিন্তু অন্যের প্রয়োজনে, দুঃস্থ-অভাবীদের সেবায় দু’পয়সাও তার পকেট থেকে বের হয় না। কেউ হয়ত নিজের প্রয়োজনের খরচটুকুও সহজে করতে পারে না। এর পেছনে কারণ তো একটাই- শয়তান তাকে ভয় দেখায়, সম্পদ ব্যয় করলে একসময় দরিদ্র হয়ে পড়বে।
কার্পণ্য যেমনই হোক, যে স্তরেরই হোক, তা নিন্দনীয়। স্তরভেদে নির্ণীত হবে তার নিন্দার পরিমাণ। এ নিন্দা সমাজের মানুষের চোখেও, শরীয়তের দৃষ্টিতেও। নিরেট দুনিয়াবি বিষয়ে কার্পণ্যকেও শরীয়ত পছন্দ করে না। যার যেখানে যতটুকু ব্যয় করা দায়িত্ব, তা তো করতেই হবে। যাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা তার দায়িত্ব, তা করতে হবে। এমনকি এ দায়িত্বের বাইরেও ব্যক্তিগত ধর্মীয় কিংবা সামাজিক যে প্রয়োজনগুলো সামনে এসে হাজির হয় সেগুলোও সাধ্যমতো পূরণ করতে হবে। নিজের, নিজের পরিবার-পরিজনের জন্যে সাধ্যমতো কিছুটা আরামের ব্যবস্থা করা, তাদের জন্যে একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা, নিজের অবস্থানুসারে গায়ের জামাটাও একটু ভালো হওয়া- এগুলো শরীয়ত অপছন্দ করে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে শরীয়তের নির্দেশনা এমনই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنّ اللهَ يُحِبّ أَنْ يَرَى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِه.
অবশ্যই আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহের নিদর্শন দেখতে ভালোবাসেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮১৯
তবে কথা হল, সম্পদ ব্যয় করার আগে একটু ভেবে নিতে হবে- ব্যয়ের এ খাত শরীয়তের দৃষ্টিতে কাক্সিক্ষত কিংবা সমর্থিত কি না। শরীয়ত যেখানে অনুমোদন করে না, সমাজের নিন্দার চোখেও সেখানে সম্পদ ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ أَعْطَى لِلهِ، وَمَنَعَ لِلهِ، وَأَحَبّ لِلهِ، وَأَبْغَضَ لِلهِ، وَأَنْكَحَ لِلهِ، فَقَدْ اسْتَكْمَلَ إِيمَانَهُ.
যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দান করে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে দান থেকে বিরত থাকে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যে ভালোবাসে আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যে ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্যেই যে বিয়ে দেয়, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫২১
কোনো অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিপদগ্রস্তকে সহায়তা করা- এসব তো ধর্ম ও সমাজ উভয় দৃষ্টিতেই পরম কাক্সিক্ষত বিষয়। এখানে যে পিছিয়ে থাকে, নিন্দার তীরে সে আক্রান্ত হবেই। অসুস্থকে যে সেবা করে না, অভাবীকে যে সাহায্য করে না, তার জন্যে কতটা ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, হাদীসের ভাষায় তা পড়–ন-
إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِي. قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنّ عَبْدِي فُلاَنًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِي عِنْدَهُ، يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِي. قَالَ: يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: أَمَا عَلِمْتَ أَنّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِي فُلاَنٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي، يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِي. قَالَ: يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبّ الْعَالَمِينَ! قَالَ: اسْتَسْقَاكَ عَبْدِي فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِي.
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে আদমসন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কীভাবে আপনাকে দেখতে যাব, আপনি যে বিশ্বজগতের প্রভু! তিনি বলবেন, তুমি কি জান না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল আর তুমি তাকে দেখতে যাওনি? তুমি কি জান না, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে?
হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! আমি কী করে আপনাকে খাওয়াব, আপনি তো রাব্বুল আলামীন! তিনি বলবেন, তুমি কি জান না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তখন তুমি তাকে খেতে দাওনি? তুমি কি জান না, তুমি যদি তাকে খাওয়াতে, তাহলে তা আমার কাছে পেতে?
হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে পানি পান করাব, আপনি তো সারা জাহানের প্রভু! তিনি বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি যদি তাকে পানি পান করাতে, তা আমার কাছে পেতে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৯
আসলে আমরা ভয় পাই দারিদ্র্যকে। এ ভয় থেকেই আঁকড়ে থাকি আমাদের উপার্জিত সব সম্পদ। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা, সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তা ইত্যাদি আমাদেরকে সম্পদ ব্যয়ে নিরুৎসাহিত করে। অথচ হাদীস শরীফে উচ্চারিত হয়েছে একইসঙ্গে সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা। একটি-যে সম্পদ ব্যয় করে তার জন্য, আরেকটি-যে সম্পদ জমিয়ে রাখে তার জন্য। লক্ষ করুন-
مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا: اللّهُمّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُولُ الآخَرُ: اللّهُمّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا.
প্রতিদিন সকালেই দুইজন ফেরেশতা নেমে আসে। তাদের একজন দুআ করে- হে আল্লাহ! যে সম্পদ ব্যয় করে তাকে আপনি এর বদলা দান করুন। অপরজন বলে- হে আল্লাহ! যে সম্পদ জমিয়ে রাখে তার সম্পদ ধ্বংস করে দিন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪২
বোঝা যাচ্ছে, শুধু পরকাল নয়, দুনিয়ার জীবনের সমৃদ্ধির জন্যেও কার্পণ্যের এ দেয়াল টপকাতেই হবে। মুমিনের সফলতার জন্য এর বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা-
وَ مَنْ یُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ.
অন্তরের কার্পণ্য থেকে যাদেরকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। -সূরা হাশর (৫৯) : ৯