সামাজিক দৃষ্টিতে অধিক সন্তান গ্রহণের ফজিলত
অধিক সন্তান গ্রহণ শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণ নয়, বরং সমাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনে জনসংখ্যার ইতিবাচক ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে অধিক সন্তান গ্রহণের সামাজিক ফজিলত বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো—
১. বৃহত্তর মুসলিম সমাজ গঠন
একটি সমাজের শক্তি নির্ভর করে তার জনসংখ্যার ওপর। মুসলিম সমাজের সদস্য সংখ্যা যত বেশি হবে, তত বেশি ইসলাম প্রচার ও প্রতিরক্ষার সুযোগ তৈরি হবে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—
تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ، فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الْأُمَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“তোমরা এমন নারীকে বিয়ে করো, যে স্বামীকে ভালোবাসবে এবং অধিক সন্তান জন্ম দেবে। কেননা কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্যে গর্ব করব।” (আবু দাউদ: ২০৫০, নাসায়ি: ৩২২৭)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব, যা ভবিষ্যতে উম্মাহর শক্তি বৃদ্ধি করবে।
২. পারিবারিক বন্ধন ও সহায়ক সমাজ গঠন
বড় পরিবার সমাজে সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। বেশি সন্তান থাকলে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং ভাই-বোনের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। ভবিষ্যতে তারা একে অপরের সহায়ক হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা সমাজে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ঐক্য তৈরি করে।
৩. বৃদ্ধ বয়সে সহায়ক শক্তি
অধিক সন্তান থাকলে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের জন্য নির্ভরযোগ্য অবলম্বন থাকে। সন্তানরা মা-বাবার সেবায় নিয়োজিত হলে সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন হয় না এবং পারিবারিক সহায়ক কাঠামো বজায় থাকে। এটি ইসলামের পারিবারিক মূল্যবোধের অন্যতম ভিত্তি।
আল্লাহ বলেন: وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا۟ إِلَّا إِيَّاهُ وَبِٱلْوَٰلِدَيْنِ إِحْسَٰنًۭا
“তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে।” (সূরা আল-ইসরা: ২৩)
অর্থাৎ অধিক সন্তান থাকলে তারা বাবা-মায়ের খেদমত ও সহযোগিতার মাধ্যমে ইসলামের আদর্শ বজায় রাখতে পারে।
৪. শ্রমশক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
একটি সমাজের উন্নতির জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। অধিক সন্তান থাকলে ভবিষ্যতে সমাজে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর জনশক্তি তৈরি হয়। বর্তমানে যেসব দেশে জনসংখ্যা কম, তারা জনশক্তির সংকটে ভুগছে, যেমন জাপান ও ইউরোপের দেশগুলো।
ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান কম নেওয়া বৈধ নয়। আল্লাহ বলেন:
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍۢ ۖ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ
“তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা কোরো না। আমিই তাদের এবং তোমাদের রিজিক দান করি।” (সূরা আল-ইসরা: ৩১)
অর্থাৎ সন্তান বেশি হলে তারা নিজের রিজিক নিয়ে আসবে এবং সমাজের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
৫. নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণ
অধিক সন্তান থাকলে ইসলামিক সংস্কৃতি ও নৈতিকতা সংরক্ষণ করা সহজ হয়। এক মুসলিম পরিবারে বেশি সন্তান থাকলে তারা কুরআন-হাদিস শেখার সুযোগ পায় এবং ভবিষ্যতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।”
(বুখারি: ৫০২৭)
যদি প্রতিটি মুসলিম পরিবার বেশি সন্তান জন্ম দেয় এবং তাদের ভালোভাবে দ্বীন শেখায়, তাহলে পুরো সমাজ ইসলামের আলোয় আলোকিত হবে।
৬. আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি
একটি সমাজের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় জনসংখ্যা থাকা জরুরি। যদি মুসলিম সমাজের সংখ্যা কমতে থাকে, তাহলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অন্য জাতিগুলো তাদের সহজেই পদদলিত করতে পারবে। কিন্তু অধিক সন্তান থাকলে তারা নিজেরা আত্মরক্ষা করতে পারবে এবং ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন: “আমি নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি: ‘তোমরা বংশবৃদ্ধি করো, কেননা আমি তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখে গর্ব করব।’” (মুসনাদ আহমদ: ১৯৫০৫)
৭. জ্ঞানী ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি
একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষিত ও যোগ্য নেতৃত্বের ওপর। বেশি সন্তান থাকলে সেখান থেকে বড় বড় আলেম, মুফতি, হাকিম, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ তৈরি হতে পারে, যারা সমাজের কল্যাণে কাজ করবে।
উপসংহার
অধিক সন্তান গ্রহণ শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কল্যাণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি গোটা সমাজের উন্নতি, শক্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। জনসংখ্যার কারণে যদি একটি মুসলিম সমাজ শক্তিশালী হয়, তাহলে তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে সমৃদ্ধ হবে। অতএব, মুসলিমদের উচিত সন্তান গ্রহণকে বরকতের নিদর্শন মনে করা এবং আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা রেখে সমাজের কল্যাণে অধিক সন্তান গ্রহণ করা।
সংকলক:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স