ওয়াদা পূরণ করার গুরুত্ব
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাটাই মূল লক্ষ্য। আমরা সমাজে বসবাস করছি। এই সমাজে আমরা নানা ধরনের কাজ করে থাকি। তন্মধ্যে ওয়াদা পালন অন্যতম। ওয়াদা পালন ইসলামের অন্যতম একটি অধ্যায়। ওয়াদা শব্দের অর্থ অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। পরিভাষায় বলতে গেলে, কারো সাথে কোনো অঙ্গীকার করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। সামাজিকভাবে প্রকৃত মানুষ চেনা যায় ওয়াদা পালনের মাধ্যমে। ওয়াদা পালনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। সমাজে সম্মানি ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। মানুষের চরিত্রগত দিক বোঝা যায় ওয়াদা পালনের মধ্য দিয়ে। তা চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে কতিপয় ব্যক্তি রয়েছে যারা ওয়াদা পালন না করে ভঙ্গ করে থাকেন। এতে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় এবং অবিশ্বাসযোগ্য মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজে সে যত বড়ই সম্মানি ব্যক্তি হোক না কেন। সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে।
ওয়াদা পালনের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূরণ করো।’ (সুরা-মায়েদা, আয়াত-১)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সেই অঙ্গীকার পূর্ণ করো এবং পাকাপাকি কসম করার পরে তা ভঙ্গ করো না। আর এই ব্যাপারে তো তোমরা আল্লাহকে জামিন করেছ। তোমরা যা করো আল্লাহ তা জানেন।’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত-৯১) পবিত্র কোরআনে যেমন ওয়াদা পালনের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি হাদিস শরিফেও ওয়াদা পালনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারমধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত- আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা পালন করতে গিয়ে তিন দিন পর্যন্ত একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাসমা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের পূর্বে একদা আমি তাঁর কাছ থেকে কেনাকাটা করি। যার কিছু মূল্য পরিশোধ করতে বাকি রয়ে গিয়েছিল। আমি তার সাথে ওয়াদা করেছিলাম যে, আমি অবশিষ্ট দাম নিয়ে তার নির্ধারিত স্থানে এসে হাজির হব। আমি এই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলাম। তিন দিন পরে আমার স্মরণ হলো। এসে দেখলাম তিনি সেই নির্দিষ্ট স্থানে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি আমাকে খুব বিপদে ফেলেছিলে। আমি তিন দিন যাবৎ তোমার অপেক্ষা করছি। (আবু দাউদ)। উক্ত হাদিসের দ্বারা বোঝা যায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াদা পালনে কত সোচ্চার ছিলেন। এর থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। অথচ আমরা খেল-তামাশায় ওয়াদা ভঙ্গ করে ফেলি।
অনেক সময় আমরা অনেকেই দুষ্টামির ছলে বিভিন্ন ওয়াদা করে ফেলি। যেমন, তোমাকে এটা দেব, ওইটা দেব বা আমি এটা করব, ওইটা করব ইত্যাদি। আর যদি তা পালন না করা হয়, তাহলে অবশ্যই গুনাহগার হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, হজরত আবতুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমার মা আমাকে ডাকলেন। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ঘরে বসা ছিলেন। মা বললেন, এদিকে এসো। তোমাকে আমি কিছু দেব। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাকে বললেন। তুমি তাকে কি দিতে ইচ্ছা পোষণ করেছ? তিনি বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দিতে ইচ্ছা করেছি। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, সাবধান! যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তবে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা কথা বলা লেখা হতো। (আবু দাউদ)। আমাদের ব্যক্তি জীবনের সব ক্ষেত্রেই এমন খেল-তামাশায় বা দুষ্টামির ছলে এমন কাজ করা হতে বিরত থাকতে হবে। কেননা এর ভয়াবহতা খুব কঠোর।
ওয়াদা করার পর ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত। যেমন হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। (১) কথা বললে মিথ্যা কথা বলে। (২) ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে। (৩) আমানত রাখলে তা খেয়ানত করে। (তিরমিযি)। উক্ত হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, ইসলামে কতটা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো বিশেষ সমস্যার কারণে ওয়াদা পালন করতে না পারে তাহলে এক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে। যেমন হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো ব্যক্তি ওয়াদা করার সময় যদি তা পূরণের নিয়ত রাখে কিন্তু পরে (কোনো বিশেষ অসুবিধার কারণে) তা পূরণ করতে না পারে, তবে এতে তার অপরাধ হবে না। (তিরমিযি)। পরিশেষে বলা যায়, সমাজে সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে হলে অবশ্যই ওয়াদা পালনে সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক কর্মনীতিতে ওয়াদার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আসুন, ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলি। পরকালের সম্বল গড়ি।