ইবাদত

শীতকাল মুমিনের বসন্ত

একজন মুসলমানের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঋতু ও বসন্ত আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীতেই কাটে। তবে ইবাদত-বন্দেগীর জন্য সুন্দর ও সহজতম একটি সময় হলো শীতকাল। শীতকালকে বলা হয় মুমিন বান্দার ইবাদতের বসন্তকাল। কারণ শীতকালে রাত দীর্ঘ হয়। যে কারণে বান্দা যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রামের পর শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ ও রোনাজারি করতে পারে। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ পায়। দিনের বেলায় সময় ছোট হওয়াতে কোনো প্রকারের কষ্ট ও ক্লান্তি অনুভব করা ছাড়াই রোযা রাখতে পারে। যা অনেক বড় ফযীলতপূর্ণ একটি আমল। এ ছাড়া আরো অনেক আমল আছে, যা বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় শীতকালে আদায় করা সহজ হয়।

শীতকালে রোযা

হাদিসের ভাষায় শীতকালকে গনিমতে বারিদাহ তথা ঠান্ডা গনিমত বলা হয়েছে। অর্থাৎ শীতকালে রোযা রাখাকে হাদিসে বিনা পরিশ্রমে অর্জিত গনিমত বলা হয়েছে।
হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
শীতকালে রোযা রাখা ঠান্ডা গনিমত। (মুসনাদে আহমদ- ১৮৯৭৯)
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কি তোমাদেরকে গনিমতে বারিদার দিকে পথ দেখাবো না? তাঁরা বললেন, কেন নয়! তিনি বললেন, শীতকালে রোযা রাখা হচ্ছে গনিমতে বারিদাহ তথা বিনা পরিশ্রমে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মতো।
অর্থাৎ, শীতকালে রোযা রাখলে অল্প সময়ে তা পূর্ণ হয়ে যায়। পরিবেশ ঠান্ডা থাকার কারণে পিপাসা এবং ক্লান্তি অনেক কম অনুভব হয়।
রোযার ফযীলত বর্ণনায় নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন-
রোযা হচ্ছে জাহান্নামের ঢাল স্বরূপ। যুদ্ধের ঢালের মতো। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস- ১৩৩৬)
অন্য এক হাদীসে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন-
আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানের প্রত্যেক ভালো কাজের বিনিময় দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু রোযা আমার জন্যই। এর প্রতিদান আমিই দেবো। কেননা, বান্দা আমার জন্যই তার প্রবৃত্তি ত্যাগ করেছে এবং পানাহার থেকে বিরত থেকেছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস- ১১৫১)
এছাড়া রোযার ফযীলত সম্পর্কে তাঁর অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে।
শীতকালের এই সুবর্ণ সুযোগকে রোযা রাখার মাধ্যমে আমরা লুফে নিতে পারি। অলসতায় সুযোগ নষ্ট করা বুদ্ধিমান মুমিনের কাজ হতে পারে না।
এ সময়ে আমরা বিশেষভাবে সপ্তাহে দু’দিন সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতে পারি।
কারণ, এ দু’দিন নবীজি (সা.) রোযা রাখতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নিশ্চয় বান্দার আমলসমূহ সোমবার এবং বৃহস্পতিবার উপস্থাপন করা হয়। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস- ২৪৩৬)
এছাড়া প্রতি মাসের তিন দিনের রোযাও রাখতে পারি, যেগুলোকে আইয়্যামে বীযের রোযা বলা হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে আমার বন্ধু (মুহাম্মাদ সা.) তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন, এগুলো যেন আমি মৃত্যু পর্যন্ত না ছাড়ি। এক. প্রতি মাসে তিনটি রোযা। দুই. চাশতের সালাত। তিন. বিতির আদায় করে ঘুমানো। (সহীহ বুখারি, হাদীস- ১১৭৮)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমার জন্য যথেষ্ট যে, তুমি প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোযা রাখবে। কেননা, তোমার জন্য রয়েছে প্রত্যেক নেক আমলের বিনিময়ে তার দশগুণ নেকি। এভাবে সারা বছরের রোযা হয়ে যায়। (সহীহ বুখারি- ১৮৭৪)

কিয়ামুল্লাইল- তাহাজ্জুদ

সালাতুত তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশ অবগত আছি। কুরআন-হাদিসে তাহাজ্জুদের প্রতি অনেক গুরুত্ব ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য ফযীলত এই সালাতের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
“তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে) যে রাতের মুহূর্তগুলোর ইবাদত করে, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে। যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না, উভয়ে কি সমান? (কিন্তু) উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে”। (আয-যুমার- ৯)
আরো ইরশাদ করেন-
“রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে, যা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত ‘ইবাদত’। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন”। (সূরা বনী-ইসরাঈল- ৭৯)
রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদীনায় আসার পর মুসলমানদেরকে কিয়ামুল্লাইল তথা তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য বেশি বেশি উৎসাহ দিতেন। তাহাজ্জুদ জান্নাতে প্রবেশের সহজ একটি পথ। তাহাজ্জুদ কবরের আলো। এর মাধ্যমে বান্দা মাকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্থানে) পৌঁছতে পারে।
বিখ্যাত সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবীজি (সা.) সর্বপ্রথম মদীনায় আসার পর যে বিষয়ে কথা বলেছেন তা হচ্ছে- হে লোক সকল! সালামের প্রসার করো। মানুষকে খাবার খাওয়াও। রাত্রে নামায আদায় করো, যখন মানুষ ঘুমে বিভোর থাকে। তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে শান্তির সাথে। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস- ১৩৩৪)
হযরত হাসান বাসরী (রহ.) বলেন, মুমিন বান্দার জন্য উত্তম সময় হচ্ছে শীতকাল। কারণ, এ সময় রাত দীর্ঘ হয়, ফলে মুমিন সালাত আদায় করতে পারে। দিন ছোট হয়, ফলে রোযা রাখতে পারে।
তিনি আরো বলেন, “উত্তম ইবাদত হচ্ছে গভীর রাতে সালাত আদায় করা”।
শীতকালে সাধারণত রাত অনেক দীর্ঘ হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণের বিশ্রাম হয়ে সময় আরো অনেক বেঁচে যায়। এ সময় মুমিন বান্দাদের জন্য শেষ রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করার সুবর্ণ সুযোগ হয়। মহান রবের দরবারে রোনাজারি করে গুনাহ মাফ করার এবং দুনিয়া আখেরাতে সফলতা ও সম্মান অর্জন করার এক সুন্দর সুযোগ থাকে। তাহাজ্জুদের সময় দুআ কবুল হওয়ার বরকতময় এক মুহূর্ত।
সৌভাগ্যবান মুমিন তো সেই, যে রাত্রের মূল্যবান সময়কে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নষ্ট করে না।

কুরআন তিলাওয়াত

কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত আছি। কুরআনের প্রতিটি হরফে দশ নেকি। কুরআন তিলাওয়াত করলেও নেকি শুনলেও নেকি। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে ঈমান দৃঢ় ও মজবুত হয়। কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর (গবেষণা) করলে তাকওয়া অর্জিত হয়। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।
শীতের দীর্ঘ রাতে বিশেষভাবে শেষরাত্রের নির্জনতায় আমরা কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি। কুরআনের সান্নিধ্যে থেকে নিজের ঈমানকে শানিত করতে পারি। শীত আসলে হযরত উবাইদ বিন উমায়ের (রহ.) বলতেন, হে কুরআনের লোকেরা! তিলাওয়াতের জন্য তোমাদের রাত দীর্ঘ হয়েছে, সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত করো। রোযার জন্য তোমাদের দ্বীন ছোট হয়েছে, সুতরাং রোযা রাখো।

ঠান্ডায় অযু করা

শীতের সময় পানি বেশ ঠান্ডা থাকে। অযু করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এমন কষ্টকর পরিস্থিতিতে কেউ যদি পরিপূর্ণরূপে অযু করে, তাহলে তার জন্য হাদীসে রয়েছে বিশেষ পুরস্কারের সুসংবাদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্তুর প্রতি পথ দেখাবো না, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা গুনাহ মাফ করবেন এবং সম্মান বৃদ্ধি করবেন! (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, কেন নয় ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজী (সা.) বললেন, কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে অযু করা। (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ৪৭৫)
লেখকঃ রাশেদুল ইসলাম

ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা, (আকবর কমপ্লেক্স) মিরপুর ১

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

1 Comment

  1. মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর লিখুনি

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *