তাহাজ্জুদের সুবর্ণ সুযোগ মাহে রমজান
রমজান গুনাহ মাফ ও তাকওয়া অর্জনের মাস। মুমিনদের জন্য এ মাসে অফুরন্ত সওয়াব অর্জনের সুযোগ দিয়ে রেখেছেন আল্লাহ তায়ালা। এ মাসে অল্প আমলেই অনেক বেশি ফজিলত।
এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করলো সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করলো। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করলো সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করলো। (শুআবুল ঈমান : ৩/৩০৫-৩০৬)
পবিত্র রমজান মাস রহমতের মাস। আর রহমতের সময় হলো তাহাজ্জুদের সময়। বছরের বিশেষ রাতগুলোতে সূর্যাস্তের পরে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এছাড়াও প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের সময়ে আল্লাহ’তায়ালা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের ফরিয়াদ শোনেন। তাহাজ্জুদ, রাতের নামাজ বা কিয়ামুল লাইল নামেও পরিচিত। তাহাজ্জুদ দুই দুই রাকাত করে আট রাকাত, বারো রাকাত বা আরও কম বা বেশিও পড়া যায়।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার আগে নবিজি (সা.)-এর ওপর এ সালাত ফরজ ছিল। তিনি আবশ্যিকভাবে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হলে এর আবশ্যকীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে নবিজি (সা.) ইন্তেকাল পর্যন্ত এ সালাত আদায় করেছিলেন নিয়মিতভাবে। তারই ধারাবাহিকতায় এখনো সুন্নাতে রাসূল হিসাবে এর বিধান বহাল আছে।
ফরজ নামাজের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। আল্লাহর রাব্বুল ইজ্জাত প্রিয় নবীজি (সা.) – কে লক্ষ্য করে কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করো, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে—মাকামে মাহমুদে (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৭৯)।’
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘হে কম্বলাবৃত! রাতে দণ্ডায়মান হও কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কোরআন তিলাওয়াত করো সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে তোমার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। তুমি নিজ পালনকর্তার নাম স্মরণ করো এবং একাগ্রচিত্তে তাতে নিমগ্ন হও (সুরা মুজাম্মিল, আয়াত: ১-৮)।’
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত! ওঠো, সতর্ক করো, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করো, স্বীয় পোশাক পবিত্র করো এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। অন্যকে কিছু দান করে অধিক প্রতিদান আশা করবে না। আর তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে ধৈর্য ধারণ করো (সুরা মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)।’
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল ছিলো নামাজ। তিনি নামাজে প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। নামাজের মাধ্যমে তিনি জীবনের যাবতীয় সঙ্কটের সমাধান খুঁজতেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নামাজকে আমার চোখের প্রশান্তি করা হয়েছে। ’ –সুনানে নাসায়ি: ৩৯৫০
ফরজ নামাজের পর শেষ রাতের নামাজ তথা তাহাজ্জুদ ছিলো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
তিনি বলেন, ‘রমজানের রোজার পর সবচেয়ে উত্তম রোজা মহররমের। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম হলো- রাতের নামাজ। ’ –সহিহ মুসলিম: ১১৬৩
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদের নামাজের মাধ্যমে গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত হতেন। এমনকি নিজের শরীরের প্রতিও কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) রাতে নামাজ আদায় করতেন; এমনকি তার পা ফুলে যেতো। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এতো কষ্ট করেন কেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপরের সব গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি কী কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না। ’ – সহিহ বোখারি: ৪৮৩৭
তাছাড়া, বুখারি ও মুসলিম শরিফে তাহাজ্জুদের বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিয়তের সঙ্গে সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রোজা পালন করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রাতে কিয়াম করে, তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী ৩৫, ১৯০১, ২০১৪, মুসলিম ১৮১৭)
মাহে রমজানে যারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার উদ্দেশে রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে সালাতুল তাহাজ্জুদ আদায় করে, সালাতুল তাহাজ্জুদ কেয়ামতের ময়দানে তার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। নামাজ বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি এই ব্যক্তিকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেইনি। এই ব্যক্তি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছে। সুতরাং তার পক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ অতএব, সালাতুত তাহাজ্জুদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (তিরমিজি : ২/১০৮)
বছরের অন্যান্য সময় শেষ রাতে অনেকেরই ওঠা হয় না। তাই তাহাজ্জুদ পড়া কঠিন হয়। কিন্তু রমজান মাসে সাহরির সুন্নত আদায়ের জন্য আমরা সবাই উঠি। আর সাহরির সময়ই হলো তাহাজ্জুদের সময়।
আর তাই রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় করা খুব সহজ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মাহে রমজানে বেশি বেশি ইবাদত, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অশেষ নেকি হাসিল ও আল্লাহ নৈকট্য অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্রঃ. লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)