জুমার দিনের ফযিলত এবং করনীয়
ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র জুমা ও জুমাবারের রাত-দিন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। জুমার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলা হয়েছে। জুমার দিনের সওয়াব ও মর্যাদা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মতোই। এ দিন ইসলামী ইতিহাসে বড় বড় ও মহৎ কিছু ঘটনা ঘটেছে। জুমার গুরুত্ব আল্লাহ তায়ালার কাছে এত বেশি যে, কোরআনে সূরাতুল ‘জুমা’ নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাজিল করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন,
হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাজের জন্য আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) এগিয়ে যাও এবং বেচা-কেনা দুনিয়াবি যাবতীয় কাজকর্ম ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে।
(সূরা জুমা- ০৯)
এই ব্লগের সূচীপত্রঃ
✅ জুমার দিনের ৯ টি বৈশিষ্ট্য
✅ জুমার দিনের ১০ টি বিশেষ আমল
✅ বিনা ওজরে জুমা না পড়ার শাস্তি
✅ জুমা সম্পর্কৃত অন্যান্য ব্লগ
জুমার দিনের ৯ টি বৈশিষ্ট্য
১. জুমার দিন এই উম্মতের জন্য বিশেষ উপহার
আল্লাহ তাআলা পূর্বের জাতিবর্গকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমরা সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিনে আমার জন্য বিশেষ একটি ইবাদত কর। কিন্তু তারা সেই শ্রেষ্ঠতর দিনটি নির্ণয় করতে ভুল করেছে। চিন্তা-ভাবনা করে ইহুদীরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য শনিবারকে নির্বাচন করেছে আর নাসারারা নির্ধারণ করেছে রবিবারকে। অথচ সবচেয়ে সম্মানিত দিন হল জুমাবার। এ দিনের অনেক ফযীলত, অনেক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা মেহেরবানী করে সে দিনটি উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করেছেন।
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আমরা পরে আগমনকারীরাই কিয়ামতের দিন অগ্রগামী হব। তবে অন্যদেরকে (আসমানী) কিতাব দেওয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে। এই দিন (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম একটি দিনে সকলে একত্র হয়ে বিশেষ ইবাদত করা) তাদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এতে মতবিরোধ করেছে। আর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক দিনটির পথ দেখিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে মানুষ আমাদের অনুগামী। ইহুদীদের শ্রেষ্ঠ দিন জুমার পরের দিন শনিবার আর খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ দিন এর পরের দিন রবিবার।
সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৫
অর্থাৎ পৃথিবীতে আগমন করা ও আসমানী কিতাবের অধিকারী হওয়ার দিক থেকে আমার উম্মতে মুহাম্মদী অন্যান্য উম্মত থেকে পিছিয়ে আছি। কিন্তু যে দিনটিতে বিশেষ ইবাদতের জন্য আল্লাহ তাআলা অন্যান্য জাতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সে দিনটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা সবার চেয়ে অগ্রগামী। শ্রেষ্ঠ ও ফযীলতপূর্ণ দিন নির্ধারণের ব্যাপারে যেমন আমরা সবার থেকে এগিয়ে আছি তেমনি কিয়ামতের দিন মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও জান্নাতে দাখেল হওয়ার ক্ষেত্রেও উম্মতে মুহাম্মদী হবে সকল উম্মত থেকে অগ্রগামী।
২. জুমার দিন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ দিন বা সকল দিনের সর্দার
২. জুমার দিন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ দিন বা সকল দিনের সর্দার হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সূর্য যে সব দিন উদিত হয় অর্থাৎ দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিন হল জুমার দিন। এই দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে। ঐ দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। কিয়ামতও সংঘটিত হবে এ দিনেই।
সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৪০৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৮
অন্য আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে,
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- জুমার দিন হচ্ছে, সকল দিনের সর্দার। এই দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিন তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। আর জুমার দিনই সংঘটিত হবে কিয়ামত।
মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০২৬
৩. জুমার দিন গুণাহ মাফের দিন
যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, তার কাছে থাকা সুন্দরতম জামাটি পরিধান করল এবং সংগ্রহে থাকলে সুগন্ধি ব্যবহার করল, এরপর জুমাতে উপস্থিত হল, কারো কাঁধ ডিঙ্গিয়ে গেল না, তারপর আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী সুন্নত-নফল পড়ল, অতঃপর খতীব (খুতবার জন্য) বের হওয়া থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকল, তার এই নামায এ জুমা থেকে সামনের জুমা পর্যন্ত (গোনাহের) কাফ্ফারা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৭৭৮; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৭৬২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০৪৬৫
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-এক জুমা থেকে আরেক জুমা মধ্যবর্তী সময়ের (গোনাহের) জন্য কাফ্ফারা (পাপমোচনকারী), যদি কাবীরা গোনাহ না করা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪১৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৮১৪
৪. জুমার দিন মুসলমানদের ঈদের দিন
রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, এই দিন অর্থাৎ জুমার দিনকে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন বানিয়েছেন (সহিহ ইবনে মাজাহ-৯০৮)
বদরী সাহাবী আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – নিশ্চয় জুমার দিন হল সমস্ত দিনের সর্দার। জুমার দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে মহান দিবস। এমনকি এই দিন আল্লাহ তাআলার কাছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর তথা ইসলামের দুই ঈদের দিন থেকেও মহান।(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৫৫৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৫৪৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৪১)
৫. এই দিনের ৫ টি বিশেষ ফজিলত রয়েছে
জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার অন্যতম একটি বিষয় হল, এ দিন কালক্রমে সংঘটিত এমন কিছু মহাঘটনার নীরব সাক্ষী, যা পৃথিবীর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বা পৃথিবীকে নবজীবন দান করেছিল। এমনিভাবে এ দিনই সংঘটিত হবে ঐ মহাপ্রলয়, যা এই নশ্বর পৃথিবীর সমাপ্তি ঘটিয়ে এক অবিনশ্বর জগতের সূচনা করবে।
বদরী সাহাবী আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – নিশ্চয় জুমার দিন হল সমস্ত দিনের সর্দার। জুমার দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে মহান দিবস। এমনকি এই দিন আল্লাহ তাআলার কাছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর তথা ইসলামের দুই ঈদের দিন থেকেও মহান।
জুমার দিনের বিশেষ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ দিন আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এদিনেই আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করেছেন। জুমার দিন একটা সময় আছে, যাতে বান্দা আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাআলা তাকে তা-ই দান করবেন, যদি না সে হারাম কোনো বিষয়ের প্রার্থনা করে। তদ্রূপ, কিয়ামতও সংঘটিত হবে জুমার দিনেই।
নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারা পর্যন্ত জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। পৃথিবী, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, সাগর সবকিছু জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) উদ্বিগ্ন থাকে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৫৫৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৫৪৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০৮৪১
৬. জুমার রাতে আল্লাহ তাআলার দরবারে বান্দার আমল পেশ করা হয়
জুমার দিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, জুমারাতে আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দাদের আলম পেশ করা হয়। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ জুমারাতে আদম সন্তানের আমল (আল্লাহর সামনে) পেশ করা হয়। তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের আমল কবুল করা হয় না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০২৭২; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৬১২)
০৭. জুমার দিন দোয়া কবুলের দিন
মুসলমানদের জন্য জুমার দিন অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই দিনের কিছু সময়ে আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন বলে হাদিসে এসেছে। বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন সময়ের কথা উল্লেখ হয়েছে। তবে জুমার দিনে দোয়া কবুলের বিশেষ সময় কোনটি— সেটা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন – জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, সেই সময়টায় যদি কোনো মুসলিম নামাজ আদায়রত অবস্থায় থাকে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা বা দোয়া কবুল করবেন এবং এরপর রাসুল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে সময়টির সংক্ষিপ্ত তার ইঙ্গিত দেন। (বুখারি, হাদিস : ৬৪০০)
জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় কোনটি, তা নির্ধারণ নিয়ে যদিও বহু মত রয়েছে, তবে এসবের মধ্যে অগ্রগণ্য মত হল দুইটি :
এক. খতীব খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত। আবু মূসা আশআরী রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., আবু বুরদা রাহ. প্রমুখ এই মতের প্রবক্তা। হযরত আবু দারদা ইবনে আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি জুমার দিনের বিশেষ মুহূর্তটি সম্পর্কে বলেছেন, ইমামের মিম্বরে বসার সময় থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত সময়টিই সেই বিশেষ মুহূর্ত। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৯) (আরো দ্রষ্টব্য মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৬, ৫৫০৭; আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১৯/২২
দুই. জুমার দিনের শেষ সময় তথা আসরের নামাযের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা., আবু হুরায়রা রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., কা‘ব আহবার রাহ., সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ., মুজাহিদ রাহ. ও তাউস রাহ. প্রমুখ এই মত গ্রহণ করেছেন।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন— জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলিম এ সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে দান করেন। এ মুহূর্তটি তোমরা আসরের শেষ সময়ে অনুসন্ধান করো। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮)(আরো দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৩-৫৫০৫, ৫৫১৪; আততামহীদ ১৯/২০, ২৩-২৪; আলইস্তিযকার ৫/৮২, ৮৬, ৯৭)
সুতরাং আমরা জুমার দিন এই দুই সময় দুআর এহতেমাম করব। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঐ বিশেষ সময়ের ফযীলত লাভ হবে এবং আমাদের দুআ আল্লাহ কবুল করবেন।
৮. কবরের আজাব থেকে নাজাত
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে মুসলমান জুমার দিনে কিংবা জুমার রাতে মৃত্যুবরণ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের ফেতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন।
(তিরমিজি, হাদিস : ১০৯৫; মিশকাত, হাদিস : ১৩৬৭; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১১/১৪৭)
এ প্রসঙ্গে ইমাম সুয়ুতি (রহঃ) বলেন, ‘কেননা জুমার দিন জাহান্নাম উত্তপ্ত করা হয় না। এর দরজা বন্ধ থাকে। জাহান্নামের দারোগার এদিন অন্য দিনের মতো দায়িত্ব থাকে না। এদিন আল্লাহ যদি কোনো বান্দার মৃত্যু ঘটান তাহলে ওই বান্দা সে সুযোগ লাভে ধন্য হয়।’ (মিরআত: ৪/৪৪১ পৃষ্ঠা)
এ সম্পর্কে মুল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, জুমার দিনে বা রাতে যে মারা যাবে, তার থেকে কবরের আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে এটা মোটামুটি প্রমাণিত। তবে কিয়ামত পর্যন্ত আজাব আর ফিরে আসবে না এ কথার কোনো ভিত্তি আমার জানা নেই। (মিনাহুর রাওদিল আযহার ফি শরহি ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা : ২৯৫-২৯৬)
বোঝা যাচ্ছে, শুক্রবার দিনে অথবা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত— এই সময়ে মধ্যে কোনো মুসলিম ব্যাক্তির মৃত্যু হলে, সেক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ তাকে কবরের আজাব থেকে ফেতনা থেকে মুক্তি লাভ করিয়ে থাকেন।
৯. জুমার দিন জান্নাতবাসীদের জন্য মহা আনন্দ ও বিশেষ প্রাপ্তির দিন
জুমার দিনের একটি বিশেষ ফযীলত হল, জান্নাতবাসীদের জন্য এ দিনটি মহা আনন্দ ও বিশেষ প্রাপ্তির দিন। জান্নাতে প্রতি জুমার দিন বিপুল আনন্দ ও প্রাপ্তির সমাহার ঘটবে। আল্লাহ তাআলার বিশেষ ব্যাবস্থাপনায় নবী-রাসূল, নেককার বান্দাগণের মিলন-উৎসব হবে। সর্বোপরি জান্নাতীরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দীদার লাভে ধন্য হবে, যা হল জান্নাতের সর্বোচ্চ নিআমত। তাই ফিরিশতারা জুমার দিনকে স্মরণ করেন ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ তথা অনন্য প্রাপ্তিদিবস নামে। আনাস ইবনে মালেক রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসেছেন শুভ্র আয়নার মত একটা জিনিস নিয়ে। আয়নাটিতে একটি কালো দাগ। আমি বললাম, এটা কী?
জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেছেন, এটি হল জুমার দিন। এ দিনকে আল্লাহ তাআলা আপনার এবং আপনার উম্মতের জন্য ঈদের দিন বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনারা ইহুদী ও নাসারা থেকে অগ্রগামী। (তাদের বিশেষ ইবাদতের দিন যথাক্রমে শনিবার ও রবিবার, যা জুমার দিনের পরে আসে।) এই দিন একটা সময় আছে, যে সময় বান্দা আল্লাহর কাছে যে কল্যাণই প্রার্থনা করে আল্লাহ তাকে তা-ই দান করেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, জুমার দিনকে কালো দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হল কেন?
জিবরীল আলাইহিস সালাম জবাব দিয়েছেন, এই যে কিয়ামত দিবস তা এ দিনেই সংঘঠিত হবে। আখেরাতে জুমার দিনকে আমরা ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ নামে স্মরণ করব।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, ‘ইয়াউমুল মাযীদ’ কী?
জিবরীল আলাইহিস সালাম উত্তর দিয়েছেন, জান্নাতে আল্লাহ তাআলা প্রশস্ত ও সুগন্ধময় একটা উপত্যকা বানিয়েছেন এবং এতে তিনি শুভ্র মেশকের একাধিক টিলা স্থাপন করেছেন। জুমার দিন এলে আল্লাহ তাআলা এ উপত্যকায় অবতরণ করবেন। তখন সেখানে নবীগণের জন্য স্বর্ণের মিম্বরসমূহ রাখা হবে, শহীদগণের জন্য মুক্তার অনেক চেয়ার পাতা হবে এবং জান্নাতী হুরেরা আপন আপন কক্ষ থেকে অবতরণ করবে। এরপর সকলে মিলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও মাহাত্ম্যের স্তুতি গাইতে থাকবে।
জিবরীল আলাইহিস সালাম আরো বলেন, এরপর আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করবেন, (হে ফেরেশতারা!) আমার বান্দাদের (বিশেষ পোশাক) পরিধান করাও। সে অনুযায়ী তাদের সজ্জিত করা হবে।
তখন আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেবেন, আমার বান্দাদের জন্য (বিশেষ) খাদ্য পরিবেশন কর। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাদের জন্যই বিশেষ ভোজনের ব্যবস্থা করা হবে। এরপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমার বান্দাদের সামনে (বিশেষ) পানীয় উপস্থিত কর। সে হিসাবে তাদের সামনে পানীয় পরিবেশন করা হবে এরপর আল্লাহ তাআলার আদেশ, আমার বান্দাদের আতর-খোশবু লাগিয়ে দাও। তখন তাদেরকে সুরভিত করা হবে।
এবার আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করবেন, (হে আমার বান্দারা!) তোমরা আমার কাছে কী চাও?
তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমরা কেবল আপনার রিযা ও সন্তুষ্টি কামনা করি।
আল্লাহ তাআলা উত্তর দেবেন, আমি তোমাদের প্রতি রাজি হয়ে গেছি। (তবারানীর বর্ণনায় আছে, অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য এমন এমন নিআমতের দ্বার উন্মুক্ত করবেন, যা কখনো কোনো চোখ দেখেনি এবং কোনো হৃদয় কল্পনা করেনি।)
তারপর সবাইকে নিজ নিজ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ করবেন। সকলে আপন আপন জান্নাতে চলে যাবে এবং হুরেরা ঐসব কক্ষে আরোহণ করবে, যার প্রত্যেকটিই সবুজ (মূল্যবান রত্ন) পান্না বা লাল ইয়াকুতের তৈরি। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪২২৮; মুজামে আওসাত, তবারানী ৩/৫৫, হাদীস ২১০৫৪)
জুমার দিনের ১০ টি বিশেষ আমল
জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ ১০ টি আমল। তা হলো,
১.অন্যদিনের তুলনায় ঘুম থেকে আগে উঠা
হযরত আউস ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে এবং (স্ত্রীকেও) গোসল করাবে, প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগবে এবং জাগাবে, আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হবে, বাহনে চড়ে নয় বরং পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে এবং কোনরূপ অনর্থক কথা না বলে ইমামের কাছাকাছি বসে খুতবা শুনবে, তার (মাসজিদে যাওয়ার) প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্নত হিসেবে গণ্য হবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে সে এক বছর যাবৎ সিয়াম পালন ও রাতভর সলাত আদায়ের (সমান) সাওয়াব পাবে।
(আবু দাউদ: ৩৪৫, মান-সহিহ)
২. গোসল করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার দিন গোসলের ব্যাপারে খুব বেশি তাগিদ দিয়েছেন। জুমার দিন গোসল করা অতি উত্তম কাজ। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত।
০১. আউস ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন নিজেও গোসল করবে এবং (স্ত্রীকেও) গোসল করাবে অথবা উত্তমরূপে গোসল করবে এরপর ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে আসবে, আসার সময় হেঁটে আসবে, কোনো বাহনে চড়বে না, ইমামের কাছাকাছি বসবে, এরপর দুটি খুতবা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং (খুতবার সময়) কোনো অনর্থক কাজকর্ম করবে না, সে মসজিদে আসার প্রতিটি পদক্ষেপে একবছর নফল রোজা ও একবছর নফল নামাজের সওয়াব পাবে। (আবু দাউদ: ৩৪৫)
০২. সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্র হলো, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করবেন। (বুখারি: ৮৮৩)
হাদিসটি খেয়াল করলে দেখবেন, দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের সব গুনাহ মাফের জন্য জুমার নামাজের আগে উত্তমরূপে গোসল করা ও সাধ্যমতো পবিত্র হওয়া অন্যতম আমল। এরপর বাকি আমলগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকলে জুমার সকল বরকত ও রহমত হাসিল হবে ইনশাআল্লাহ।
৩. উত্তম কাপড় পরিধান করা
জুমার দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি উত্তম পোশাক পরা এবং দ্রুত জুমার নামাজে উপস্থিত হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফজিলত বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করে, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে, জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়, নির্ধারিত নামাজ আদায় করে, ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে তার এই আমল আগের জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব ছোট পাপ মোচন হবে।’ (আবু দাউদ: ৩৪৩)
জুমা ছাড়াও যেকোনো নামাজে পূত-পবিত্র হয়ে, সতেজ ও প্রফুল্ল মনে নামাজে দাঁড়ানো উচিত। কারণ নামাজ হলো বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সাক্ষাৎস্বরূপ। তাই মহান প্রভুকে হাজিরা দিতে পরিপাটি হয়ে, উত্তম পোশাক পরা উচিত। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে,
হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা (সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ) গ্রহণ করো।
(সুরা আরাফ: ৩১)
সুতরাং সামর্থ্য অনুযায়ী যত ভালো কাপড় পাওয়া যায়, তা পরিধান করা উত্তম। তবে পুরনো কাপড় পরাতেও দোষ নেই। তা যেন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় সেদিকে খেয়াল রাখা ভালো। অহংকার আসে এমন কাপড় পরিধান করা বাঞ্ছনীয় নয়। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৫/৩৩৩)
৪. সুগন্ধি ও তেল ব্যবহার করা
জুমার দিনের বিশেষ আমলগুলোর মধ্যে একটি আমল হলো, সুগন্ধি ও তেল ব্যবহার করা। জুমার দিনের আমলের বর্ণনা সম্বলিত একাধিক হাদিসে সুগন্ধি ও তেল ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন আল্লাহর রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
এর ফজিলত বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধান করে, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে, জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়, নির্ধারিত নামাজ আদায় করে, ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে তার এই আমল আগের জুমা থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব ছোট পাপ মোচন হবে।’ (আবু দাউদ: ৩৪৩)
হযরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্র হলো, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করবেন। (বুখারি: ৮৮৩)
৫. আগে আগে মসজিদে আসা
জুমার দিন তাড়াতাড়ি এবং সবার আগে মসজিদে যাওয়ার অনেক ফজিলত রয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা এসে হাজির হন। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা সর্বাগ্রে আগমনকারী দের নাম লিখতে থাকেন। প্রথম ভাগে যারা মসজিদে প্রবেশ করে তাদের জন্য উট, দ্বিতীয় ভাগে যারা আসে তাদের জন্য গরু, তৃতীয় ভাগে যারা আসে তাদের জন্য ছাগল, চতুর্থ ভাগে যারা আসে তাদের জন্য মুরগি ও সর্বশেষ পঞ্চম ভাগে যারা আসে তাদের জন্য ডিম কোরবানি বা দান করার সমান সওয়াব লেখেন। আর যখন ইমাম খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে পড়েন তখন ফেরেশতারা তাদের এ খাতা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যান।
(বুখারি-৯২৯, মুসলিম-২০২১)
হাদিস থেকে বোঝা যায়, জুমার দিন তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া উচিত এবং শুধু নির্ধারিত চার রাকাত নামাজ আদায় করা নয় বরং তাহিয়াতুল অজু দুই রাকাত ও তাহিয়াতুল মসজিদ দুই রাকাতসহ সাধ্যমতো বিভিন্ন নফল নামাজ আদায় করা উচিত।
৬. পায়ে হেঁটে মসজিদ যাওয়া
মুসল্লিদের জন্য জুমার নামাজে হেঁটে উপস্থিত হওয়া উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ। রাসূল (সা.) হেঁটে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন আর তাই এটি মুসলমানদের জন্য সুন্নত। তবে মসজিদ যদি বাড়ি থেকে বেশি দূরে হয়, তবে কষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
হযরত আউস ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে এবং (স্ত্রীকেও) গোসল করাবে, প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগবে এবং জাগাবে, আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হবে, বাহনে চড়ে নয় বরং পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে এবং কোনরূপ অনর্থক কথা না বলে ইমামের কাছাকাছি বসে খুতবা শুনবে, তার (মাসজিদে যাওয়ার) প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্নত হিসেবে গণ্য হবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে সে এক বছর যাবৎ সিয়াম পালন ও রাতভর সলাত আদায়ের (সমান) সাওয়াব পাবে। (আবু দাউদ: ৩৪৫, মান-সহিহ)
৭. ইমামের কাছাকছি বসে মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনা
হযরত আউস ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করবে…এবং কোনরূপ অনর্থক কথা না বলে ইমামের কাছাকাছি বসে খুতবা শুনবে, তার (মাসজিদে যাওয়ার) প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্নত হিসেবে গণ্য হবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে সে এক বছর যাবৎ সিয়াম পালন ও রাতভর সলাত আদায়ের (সমান) সাওয়াব পাবে। (আবু দাউদ: ৩৪৫, মান-সহিহ)
৮. বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা
রব্বে কারিম রাসূলে কারীম সাঃ এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ নবির প্রতি রহমত নাজিল করেন এবং তার ফেরেশতারাও নবির জন্য রহমতের দোয়া করে। হে মুমিনরা! তোমরাও নবির প্রতি রহমতের দোয়া কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও
(সূরা আহজাব : ৫৬)
শুক্রবার তথা জুমার দিন হলো সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন, এ দিনে দরুদ শরীফ পড়ার রয়েছে বিশেষ ফজিলত। নিচে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো-
৯. সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করা
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, তাকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত একটি নূর বেষ্টন করে রাখবে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৩৯২; সুনানে কুবরা বাইহাকী, হাদীস ৫৯৯৬) হাদীসটির সনদ হাসান।
আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে দাজ্জালের ফেতনা থেকে সে মুক্ত থাকবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩২৩)
১০. জুমার দিন বেশী বেশী দোয়া করা, কারণ এদিনে দোয়া অধিক পরিমাণে কবুল হয়
মুসলমানদের জন্য জুমার দিন অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই দিনের কিছু সময়ে আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন বলে হাদিসে এসেছে। বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন সময়ের কথা উল্লেখ হয়েছে। তবে জুমার দিনে দোয়া কবুলের বিশেষ সময় কোনটি— সেটা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, সেই সময়টায় যদি কোনো মুসলিম নামাজ আদায়রত অবস্থায় থাকে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা বা দোয়া কবুল করবেন এবং এরপর রাসুল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে সময়টির সংক্ষিপ্ত তার ইঙ্গিত দেন।(বুখারি, হাদিস : ৬৪০০)
জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় কোনটি, তা নির্ধারণ নিয়ে যদিও বহু মত রয়েছে, তবে এসবের মধ্যে অগ্রগণ্য মত হল দুইটি :
এক. খতীব খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত। আবু মূসা আশআরী রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., আবু বুরদা রাহ. প্রমুখ এই মতের প্রবক্তা।
হযরত আবু দারদা ইবনে আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি জুমার দিনের বিশেষ মুহূর্তটি সম্পর্কে বলেছেন, ইমামের মিম্বরে বসার সময় থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত সময়টিই সেই বিশেষ মুহূর্ত। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৯) (আরো দ্রষ্টব্য মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৬, ৫৫০৭; আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১৯/২২
দুই. জুমার দিনের শেষ সময় তথা আসরের নামাযের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা., আবু হুরায়রা রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., কা‘ব আহবার রাহ., সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ., মুজাহিদ রাহ. ও তাউস রাহ. প্রমুখ এই মত গ্রহণ করেছেন।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন— জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলিম এ সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে দান করেন। এ মুহূর্তটি তোমরা আসরের শেষ সময়ে অনুসন্ধান করো। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮)(আরো দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৩-৫৫০৫, ৫৫১৪; আততামহীদ ১৯/২০, ২৩-২৪; আলইস্তিযকার ৫/৮২, ৮৬, ৯৭)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন জুমার দিনে এমন একটি সময় আছে, সেই সময়টায় যদি কোনো মুসলিম নামাজ আদায়রত অবস্থায় থাকে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই তার সে চাহিদা বা দোয়া কবুল করবেন এবং এরপর রাসুল (সা.) তার হাত দিয়ে ইশারা করে সময়টির সংক্ষিপ্ত তার ইঙ্গিত দেন।(বুখারি, হাদিস : ৬৪০০)
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- জুমার দিন বারো ভাগ। (এর মধ্যে একটি সময় আছে, যাতে) কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা নিশ্চয় তা দান করবেন। সে সময়টি তোমরা অনুসন্ধান কর আসরের পর দিনের শেষ অংশটিতে। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০৩২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩৮৯১
সুতরাং আমরা জুমার দিন এই দুই সময় দুআর এহতেমাম করব। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঐ বিশেষ সময়ের ফযীলত লাভ হবে এবং আমাদের দুআ আল্লাহ কবুল করবেন।
বিনা ওজরে জুমা না পড়ার শাস্তি
সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন হলো শুক্রবার। এইদিনের শ্রেষ্ঠ নামাজ হলো জুমা। জুমার গুরুত্ব আল্লাহ তায়ালার কাছে এত বেশি যে, কোরআনে সূরাতুল ‘জুমা’ নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাজিল করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ! জুমার দিন যখন নামাজের জন্য আহ্বান জানানো হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে (মসজিদে) এগিয়ে যাও এবং বেচা-কেনা (দুনিয়াবি যাবতীয় কাজকর্ম ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে। (সূরা জুমা- ০৯)।
যারা জুমার নামাজ থেকে বিমুখ থেকে অন্য কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন, আল্লাহ তায়ালা ও তার দিক থেকেও বিমুখ থাকেন।
জুমার নামাজ সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। ফরজ নামাজ আদায় না করা কঠিন গুনাহের কাজ।ফরজ জুমা ত্যাগ করার বিষয়টি অন্য ফরজ নামাজের চেয়ে মারাত্মক। কেননা মুসলমানের কাছে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন জুমাবার। সেই জুমার ফরজ নামাজ আদায় না করা নিঃসন্দেহে বড় ধরণের কুফুরি। এছাড়াও জুমা ত্যাগকারীদের অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যার পরিণতিতে সে নেক আমল করার সুযোগ হারিয়ে ফেলবে। সেজন্যই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন,
যদি মানুষ জুমার সালাত পরিত্যাগ করা থেকে বিরত না থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন, যার ফলে তারা অলস ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(সুনানে দারামি: ১৫২৪)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স.) যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ থেকে দূরে থাকে (পড়ে না) তাদের সম্পর্কে বলেছেন, নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতঃপর যে সমস্ত লোক জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই।
(মুসলিম : ৬৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৩৮১৬, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৫৮, আসু-সুনানুল কুবরা : ৪৯৩৫)
অন্য হাদিসে এসেছে, হযরত আবূল জা’দ আয্-যামরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ ‘যে লোক নিছক অলসতা ও গাফিলতি করে পরপর তিন জুমা ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার অন্তরে মোহর মেরে দেন
(সহিহ তিরমিজি: ৫০০; ইবনু মাজাহ: ১১২৫)
আবু ইয়ালা (রহ) বিশুদ্ধ সনদে ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি তিন জুমা লাগাতার বর্জন করল সে ইসলাম থেকে নিজেকে দূরে ঠেলে দিলো। (আবু ইয়ালা: ২৭১২, সহিহ তারগিব: ৭৩৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।’ বর্ণনাকারী ইমাম শাফেয়ী রহঃ। (তাফসিরে মাজহারি, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ২৮৩) মেশকাতঃ হাদীস নং:১২৯৭)
ফরজ নামাজ ত্যাগকারীর ব্যাপারে মহানবী (স.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজ না পড়া। যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে গেল (কাফেরের মতো কাজ করল)’ (সহিহ মুসলিম: ৮২)। রাসুলুল্লাহ (স.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজের। যে নামাজ ত্যাগ করল সে কাফের হয়ে গেল।’ (তিরমিজি: ২৬২১)
ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে মহান আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর থেকে তার জিম্মাদারি তুলে নেন। হজরত মুআজ (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে দশটি নসিহত করেন, তার মধ্যে বিশেষ একটি এটাও যে, তুমি ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ত্যাগ করো না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ত্যাগ করল তার ওপর আল্লাহ তাআলার কোনো জিম্মাদারি থাকল না।’ (মুসনাদে আহমদ: ৫/২৩৮)
নামাজ পড়া মুসলিমদের একটি নিদর্শন। তাই হজরত উমর (র.) বলতেন, ‘নামাজ ত্যাগকারী নির্ঘাত কাফের’ (বায়হাকি: ১৫৫৯, ৬২৯১)। হজরত আলি (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে কাফের’ (বায়হাকি: ৬২৯১)। হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে মুসলমান নয়।’ (বায়হাকি: ৬২৯১)
ইমাম আহমদ এর মতানুযায়ী, অলসতা করে নামাজ বর্জনকারী কাফের এবং এটাই অগ্রগণ্য মত। কোরআন, হাদিস, সলফে সালেহিন এর বাণী ও সঠিক কিয়াসের দলিল এটাই প্রমাণ করে। (আল-শারহুল মুমতি আলা-জাদিল মুসতানকি: ২/২৬)
নামাজ পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহর দলিলগুলো প্রমাণ করে, বে-নামাজি ব্যক্তি ইসলাম নষ্টকারী বড় কুফরিতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোরআনের দলিল হচ্ছে- ‘অতএব তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও জাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দীনি ভাই।’ (সুরা তাওবা: ১১)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ ওজর ছাড়াই জুমার সালাত বর্জন করে সে যেন এক দীনার সদকা করে। এতে সক্ষম না হলে যেন অর্ধ দিনার সাদাকা করে। (আবু দাউদ: ১০৫৩.নাসায়ি, বিনা ওজরে জুমা ছেড়ে দেওয়ার কাফফারা), ইবনু মাজাহ: ১১২৮, অধ্যায়- সলাত কায়েম, বিনা ওজরে জুমা ত্যাগ, হাকিম: ১/২৮০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ফরজ নামাজের গুরুত্ব বোঝার তাওফিক দান করুন। জুমার ব্যাপারে কোনোরকম অলসতা না করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
জুমা সম্পর্কৃত অন্যান্য ব্লগ
✅ যেভাবে হলো জুমার নামাজের সূচনা – বিস্তারিত
✅ জুমআর নামাযের আগের ও পরের সুন্নাত নামায প্রসঙ্গ – বিস্তারিত
✅ জুমার দ্বিতীয় আজানের ইতিহাস – বিস্তারিত
তথ্যসূত্রঃ. লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)