ইবাদত

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল

[১] বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করা

(ক) তাহলিল অর্থাৎ, “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ” পড়া।

(খ) তাকবির অর্থাৎ,“আল্লাহু আকবার” বলা।

(গ) তাহমিদ অর্থাৎ, “আলহামদুলিল্লাহ্” পড়া।

(ঘ) তাসবিহ অর্থাৎ “সুবহানাল্লাহ্” পড়া।

আহমাদ এবং আত-তাবারানি আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রদিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ বলেন, “আল্লাহর দৃষ্টিতে এই দিনসমূহ (জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন) থেকে মর্যাদাপূর্ণ দিন আর নেই এবং এই দিনগুলোতে করা ইবাদাতের চেয়ে প্রিয় ইবাদাত আর নেই। সুতরাং এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (لا اله الا الله), তাকবির (الله اكبر) এবং তাহমিদ (الحمد لله) পড়া”। (আহমাদ ৭/২২৪, শুআবুল ঈমান ৩৪৭৪, আহমাদ শাকির (রহিমাহুল্লাহ) একে সহিহ বলেছেন)

(ঙ) ইস্তিগফার করা;“আস্তাগফিরুল্লাহ”পড়া”।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “শেষ বিচারের দিন কেউ যদি নিজ আমলনামা হাতে পেয়ে সন্তুষ্ট হতে চায়, তাহলে সে যেন বেশি বেশি ইস্তিগফার করে।” আর ইস্তিগফার কেবল নিজের জন্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না। বরং পুরো উম্মাহর জন্য ইস্তিগফার করবেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে কেউ যদি পুরো উম্মাহর জন্য ইস্তিগফার করে, তবে সে উম্মাহর প্রত্যেকের জন্যই নেকি পেয়ে যাবে। তাই পড়া যেতে পারে, “আল্লাহুম্মাগফির লিল মু’মিনিন ওয়াল মু’মিনাত”

(চ) রাসূলুল্লাহর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করা।

যখনই কেউ রাসূলুল্লাহর ওপর দরুদ পড়ে, তখন একজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহর কাছে গিয়ে বলে – অমুকের ছেলে তমুক আপনাকে সালাম দিয়েছে। যখনই আপনি রাসূলুল্লাহর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করেন, তখন একজন ফেরেশতাও আপনার ওপর সালাম পেশ করে থাকে। আর কারও জন্য ফেরেশতাদের সালাম হল আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তির জন্য ক্ষমা চাওয়া।

(ছ) সহিহ হাদিসে উল্লেখ পাওয়া তসবিহগুলো পাঠ।

আসলে এই তাসবিহগুলো সবসময়ই আমাদের অন্তরে ও জিহ্বায় থাকা উচিত; তবে জিলহজ্জের এই দিনগুলোর জন্য এগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ স্বরূপ যখন কেউ সকালে গাড়িতে করে কাজে যায় কিংবা বিকালে অফিস থেকে ফিরে, অথবা কোনো লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময়, অথবা যখনই কেউ একটুখানি অবসর পায় তখনই তার উচিত আল্লাহর যিকির করা। আবু হামযা আল-বাগদাদি বলেন, “আপনার পক্ষে এটা দাবি করা অসম্ভব যে আপনি আল্লাহকে ভালবাসেন কিন্তু আপনি একাগ্রভাবে আল্লাহর প্রশংসা করছেন না। আর এটা অসম্ভব যে আপনি একনাগাড়ে আল্লাহর প্রশংসা করছেন কিন্তু এর মিষ্টতা এই জীবনে উপলব্ধি করছেন না। আর এটা অসম্ভব যে আপনি আল্লাহর প্রশংসা করে জীবনে মিষ্টতা উপলব্ধি করছেন কিন্তু আপনি তাঁকে ব্যতীত অন্য কোনোকিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।”

সবসময় আল্লাহ আযযাওয়াজালের প্রশংসা করতে না পারা মূলত মুনাফিকের লক্ষণ। এর নিজের মধ্যেই বিপদ রয়েছে। আল্লাহ তা’লা বলেন( وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَوَةِ قَامُوا كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلاً ওরা (মুনাফিকেরা) যখন সলাতে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায় শিথিলচিত্তে, লোকদেখানোর জন্য,আর ওরা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে থাকে।সূরা নিসা, ৪: ১৪২

আল্লাহ তা’লা বলছেন যে মুনাফিকেরা খুব কমই আল্লাহকে স্মরণ করে।

ইবনু আব্বাস (রদিআল্লাহু আনহু) বলেন, “আল্লাহ্ তা’লা সকল ইবাদাতের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবংঅজুহাতের সুযোগ রেখেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম হল যিকির। যিকিরের কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই, কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই এবং কোনো অজুহাত নেই। ”আল্লাহ্ তা’লা বলেন, তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর দাঁড়ানো, বসা এবং শয়ন অবস্থায়। সূরা নিসা, ৪ : ১০৩

তাকবিরের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য

জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনে পুরুষদের তাকবির হবে সশব্দে। এই দশ দিনে তাকবির, তাহমিদ, তাহলিল এবং তাসবিহ পড়া হল সুন্নাহ। আর এই সময়ে ঘরে, বাইরে, মসজিদে, রাস্তায় যেখানেই আল্লাহর স্মরণ জায়িজ আছে সেখানেই সশব্দে আল্লাহ আযযাওয়াজালের যিকির এবং বড়ত্ব ঘোষণা করা হল উত্তম ইবাদাত। পুরুষরা এই যিকিরগুলো করবে সশব্দে আর নারীরা করবে নীরবে। আর এর দলিল হল পূর্বেই উল্লেখিত আয়াত ,لِيَشْهَدُ و أَمَنَفِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمُ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَمِ যাতে তারা সাক্ষ্য হতে পারে তাদের জন্য কল্যাণকর বিষয়ের,নির্দিষ্ট দিনগুলোয় যেন তারা আল্লাহকে স্মরণ করতে পারে তাদেরকে (কুরবানির উদ্দেশ্যে)তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তুসমূহের জন্য। সূরা হাজ্জ, ২২ : ২৮

আর অধিকাংশ আলিমগণ এই বিষয়ে ঐক্যমত যে আয়াতে উল্লেখিত ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ হল জিলহজ্জের প্রথম দশদিন৷

তাকবিরে যুক্ত হতে পারে এই শব্দগুলো

তাকবিরে যুক্ত হতে পারে এই শব্দগুলো الله اكبر الله اكبر لا اله الا الله والله اكبر الله اكبر الله اكبر ولله الحمد কাছাকাছি উচ্চারণঃ আল্লহু আকবার আল্লহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাল্লহু, ওয়াল্লহু আকবার আল্লহু আকবার, ওয়ালিল্লা-হিল হামদ। এছাড়া আল্লাহ্ তা’লার অন্যান্য তাসবিহও যুক্ত হতে পারে।

আজকের যুগে তাকবির তো এক ভুলে যাওয়া সুন্নাহে পরিণত হয়েছে, বিশেষত এই সময়ের (জিলহজ্জের) প্রথমদিন গুলোতে। এটা এতই হারিয়ে বসেছে যে একেবারে গুটিকয়েক বান্দা ছাড়া কারও কাছে লোকেরা (সজোরে) তাকবির শুনে না বললেই চলে। মৃত সুন্নাহকে জীবিত করার জন্য এবং উদাসীনদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই তাকবির সশব্দে পড়তে হবে। ইবনু উমার এবং আবু হুরাইরাহ (রদিআল্লাহু আনহুম) জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন বাজার এলাকায় গিয়ে সশব্দে তাকবির দিতেন আর লোকেরা তাঁদের তাকবির শুনে নিজেরাও তাকবির দিতো।

মানুষকে তাকবির দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণ মূলত এই যে প্রত্যেককে এই তাকবির আলাদাভাবে দিতে হবে, জামাআতবদ্ধভাবে নয়; কেননা শরীয়াতে এই তাকবির জামাআতবদ্ধভাবে দেওয়ার কোনো ভিত্তি পাওয়াযায় না।

(২) সাধ্যানুযায়ী সিয়াম পালন করা

রাসূলুল্লাহ (সা,) বলেছেন, “যারা শুধু আল্লাহর জন্যই সিয়াম রাখে, প্রত্যেক দিনের সিয়ামের জন্য জাহান্নাম থেকে এমনএক পরিখা সমান দূরত্ব দূরে সরে যাবে, যা কিনা আসমান আর জাহান্নামের দূরত্বের সমান।” তাহলে চিন্তা করুন এইদিনগুলোতে সিয়াম রাখলে জাহান্নাম থেকে আপনার দূরত্ব কতখানি হয়ে যাবে।সিয়াম রাখার পুরষ্কার হল এই যে, আল্লাহ আযযাওয়াজাল জান্নাতিদেরকে বলেন ,كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ অতীতে তোমরা যা কিছুই আগে প্রেরণ করেছো,তার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যে খাও এবং পান কর। (সূরা হাক্ক, ৬৯: ২৪)

আর একজন সিয়াম পালনকারী সিয়াম ভাঙ্গার পূর্বমুহুর্তে একটি মাকবুল দুআ তথা কবুল হয় এমন দুআও পুরষ্কার হিসেবে পেয়ে থাকে। অন্যসব আমলে আল্লাহ আযযাওয়াজাল সওয়াব বৃদ্ধি করেন সাত গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত; একমাত্র সিয়াম এর ব্যতিক্রম ৷ কেননা আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেছেন যে সিয়াম তাঁর এবং কেবলমাত্র তাঁরই জন্য। আমরা তো জানি সিয়াম আল্লাহর জন্য, সালাত আল্লাহর জন্য, যিকর আল্লাহর জন্য; সমস্ত ইবাদাতই আল্লাহর জন্য। কিন্তু কেন আল্লাহ আযযাওয়াজাল সিয়ামের বিষয়টিই নির্দিষ্ট করে শুধু তাঁর জন্য করলেন? আপনাদের কী মনে হয়?

এর কারণ হল এই যে, সিয়াম এমন এক গোপন ইবাদাত যেখানে এর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউই জানে না, কেউই জানে না আপনি কি সত্যিই সিয়াম ছিলেন নাকি ভান করে ছিলেন। আর তাই আপনার সিয়ামের জন্য আল্লাহ আযযাওয়াজাল স্বয়ং প্রতিদান দেবেন।

ইব্রাহিম বিন হানী তাঁর মৃত্যুর সময় সিয়ামরত ছিলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে যান। আর তাই তার পুত্র পানি নিয়ে এসে পিতাকে পান করতে বললেন। ইব্রাহিম জিজ্ঞেস করলেন, “মাগরিব কি হয়েছে?” ছেলে বলল “না।” বাবা বললেন, “এরকম একটি দিনের জন্যই তো মানুষ আমল করে থাকে।” অতঃপর সিয়ামরত অবস্থায়ই তিনি রব্বে কারিমের নিকট চলে গেলেন৷

নাফিসাহ বিনতে হাসান বিন জাইদ; এই মহিয়সী নারীও তাঁর মৃত্যুশয্যায় সিয়ামরত ছিলেন। তাঁর পুত্র তাঁকে জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করলে তিনি বলেছিলেন “সুবহানাল্লাহ! আমি ৩০ বছর ধরে আল্লাহর কাছে সিয়ামরত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করছি, আর তুমি কিনা এখন আমার সিয়াম ভাঙতে চাইছো?” তিনি এই আয়াতটি তিলাওয়াত করতে করতে মারা গেলেন –قُل لمَن مَّا فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ قُل لِلَّهِ كَتَبَ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ لَيَجْمَعَنَكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَمَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ বলুন, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সেসব কার? বলুনঃ আল্লাহরই।তিনি নিজের জন্য কর্তব্য স্থির করে নিয়েছেন যেতিনি তোমাদের সকলকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করবেন,এতে কোনোই সন্দেহ নেই।সূরা আনআ’ম, ৬ : ১২

(৩) যথাসম্ভব সাদাকাহ করা

যদিও সারা বছর জুড়েই আমাদের সাদাকাহ করা উচিত, তবে জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনে আমাদের প্রত্যেকের আরও বেশি করে আল্লাহর রাস্তায় সাদাকাহ করা উচিত। আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন ,وَمَا أَنفَقْتُم مِن شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ، وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ এবং তোমরা যা কিছু ব্যয় কর (সৎকর্মের জন্য) তিনি তার প্রতিদান দেন। আর তিনিই সর্বোত্তম প্রতিদানকারী। (সূরা সাবা, ৩৪ : ৩৯)

ইবনু কাসির (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আল্লাহ তা’লা দানশীল মুমিনদেরকে এই জীবনে করা সাদাকাহের জন্য আখিরাতে তার দানের সমপরিমাণ বা তারও অধিক প্রতিদান দিবেন।

ইবনু উমার (রদিআল্লাহু আনহু) যখন আল্লাহর এই আয়াত শুনলেন, لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ তোমরা যা ভালোবাস, তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনোই তাকওয়া অর্জন করতে পারবে না; আর তোমরা যা থেকেই ব্যয় করে থাক, আল্লাহ তা সম্পর্কে সম্যক অবগত। (সূরা আলি ইমরান, ৩ : ৯২) আয়াতটি শোনার পর ইবনু উমার (রদিআল্লাহু আনহু) আশেপাশে তাকালেন এবং তাঁর মালিকানাধীন এক দাসীর চেয়ে অধিক ভালোবাসার আর কিছু পেলেন না। আর তাই তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তখনই সেই দাসীকে আজাদ করে দিলেন।

সাঈদ বিন উবাদাহ প্রতিদিন মাসজিদের ৮০ জন দরিদ্র মুসলমানকে খাওয়ানোর জন্য তাঁর ঘরে নিয়ে যেতেন। তাঁর পুত্রও উত্তরাধিকার সূত্রে আল্লাহর রাস্তায় উদারভাবে ব্যয় করার গুণটি পেয়েছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ছিল কায়িস বিন সাঈদ বিন উবাদাহ। তিনি যখন ধনী ছিলেন তখন তিনি লোকদেরকে ঋণ দিতেন। একবার তিনি দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু লোকেরা তাঁকে দেখতে যাওয়া থেকে বিরত থাকল। কারণ বেশিরভাগই তাঁর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল আর ভেবে বসেছিল যে তিনি হয়তো সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। কায়িস যখন এইব্যাপার জানতে পারলেন, তখন তিনি ঘোষণা করলেন, “ভ্রাত্বত্বের পথে যে ধনসম্পদ বাধা হয়ে যায়, সেই সম্পদধ্বংস হোক। আমি তাদের সবার ঋণ মাফ করে দিলাম।

(৪) কুরআন তিলাওয়াত

কুরআন তিলাওয়াত তো এই দশ দিন ছাড়াও প্রতিদিনের অভ্যাস হওয়া উচিত। কুরআন তিলাওয়াতকারী বান্দারা আল্লাহ আযযাওয়াজালের নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারি। নাবি (সা,) কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন যে ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ণ নয় বরং আলিফ হল একটি বর্ণ, লাম একটি বর্ণ এবং মিম একটি বর্ণ। আর প্রত্যেকটি বর্ণের জন্য তিলাওয়াতকারীর জন্য রয়েছে দশটি করে হাসানাত সুতরাং আপনি কেবল আলিফ-লাম-মীমের জন্যই ত্রিশটি হাসানাত পেয়ে যাবেন।

আসমাকে (রদিআল্লাহু আনহা) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কুরআন তিলাওয়াতের সময় রাসূলুল্লাহর (সা,) সাহাবারা কীরূপ অবস্থায় থাকতেন। তিনি বলেছিলেন যে তাঁদের চোখ কান্নায় ভিজে যেত আর পেশিগুলো জর্জরিত হয়েনযেত; ঠিক যেমনটা

আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেছেন, اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَا مُتَشَبِها مَثَانِي تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبِّهِمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْوَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَالِكَ هُدَى اللَّهِ يَ دِى بِهِ مَن يَشَاءُ وَ مَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ

আল্লাহ তা’য়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ বাণীসমূহ অবতীর্ণ করেছেন, এমন একটি কিতাব যা সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যার বিষয়াবলির করা হয়েছে পুনরাবৃত্তি; যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এতে তাদের গা শিউরে উঠে, তখন তাদের দেহ ও অন্তঃকরণ আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর হিদায়াত, তিনি যাকে ইচ্ছা এর দ্বারা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার তো কোনোই পথপ্রদর্শক নেই। সূরা যুমার, ৩৯ : ২৩

ইবনু মাসউদ (রদিআল্লাহু আনহু) বলেছিলেন, “আমাদের জন্য কুরআন হিফজ করা ছিল কঠিন, তবে মেনে চলা ছিল সহজ। তবে এমন একসময় আসবে যখন হিফজ করা হবে সহজ, কিন্তু এটি মেনে চলা সহজ হবে না।”আর এখন তো আমরা এমন এক সময়ে আছি যখন কুরআন হিফজেরও অভাব, কুরআনের আনুগত্যের ও অভাব।

মুজাহিদকে (রহিমাহুল্লাহ) একবার দুই ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; যাদের একজন আল-বাকারাহ আর আলি-ইমরান তিলাওয়াত করেছে এবং অপরজন একই সময় নিয়ে কেবল আল-বাকারাহ তিলাওয়াত করেছে। তাহলে এদের মধ্যে কে উত্তম? তিনি উত্তর দিলেন, “উত্তম তিনি যিনি একই সময়ে শুধু আল-বাকারাহ তিলাওয়াত করেছেন; কারণ তিনি এর অর্থ অনুধাবনের জন্য বেশি সময় পেয়েছেন।”

আমরা সবাই তো রাসূলুল্লাহকে (সা,) ভালবাসি এবং শেষ বিচারের দিন তাঁকে দেখার ইচ্ছা করি। তাহলে ভাবুন কী হবে, যদি তিনি আপনার সম্পর্কে আল্লাহ আযযাওয়াজালের নিকট এই আয়াতটির মাধ্যমে অভিযোগ করে থাকেন, ( وَقَالَ الرَّسُولُ يَنرَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْءَانَ مَهْجُورًا) এবং রাসূল বলবেন, ‘হে আমার রব! আমার জাতির লোকেরা এই কুরআনকে পরিত্যক্ত গণ্য করেছিল।’ সূরা ফুরকান, ২৫ : ৩০

ইবনুল কাইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “কুরআনকে পরিত্যাগ করা হয় ৫ উপায়েঃ

i.কুরআন তিলাওয়াত শোনা পরিত্যাগ করা,

ii.কুরআনের হালাল-হারাম তথা বিধিবিধান পরিত্যাগ করা,

iii.ছোট-বড় যেকোনো কলহ-বিবাদের ক্ষেত্রে কুরআনের দিকে প্রত্যাবর্তন না করা,

iv. কুরআনের ব্যাপকতা ও বোধগম্যতা ত্যাগ করা,

V.অসুস্থ হৃদয় নিরাময়ের জন্য কুরআনের ব্যবহার ত্যাগ করা। (হতাশা এবং অসুস্থ অনুভূতি নিরাময়ে কুরআনেরপরিবর্তে অন্যান্য উপায় অবলম্বন করা)”

[৫] অবিরত এবং অবিচলভাবে দুআ করতে থাকা

যে ব্যক্তি দুআ করে না, সে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়ে যেতে পারে; কেননা রাসূলুল্লাহ (সা,) বলেন, مَنْ لَمْ يَسْأَلِ اللَّهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِ “যে আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার উপর নিজের ক্রোধ চাপিয়ে দেন। ”জামি’ আত-তিরমিযি, ৩৩৭৩

যখন আপনি অধিরভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকবেন, তখন জেনে রাখুন আল্লাহ আপনার দুআ কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ। যখন উলামাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমরা কীভাবে বুঝব যে আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের দুআ কবুল করবেন? তাঁদের উত্তর ছিল এমন – যখন কেউ পানিতে ডুবে যেতে থাকে আর বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে সাহায্য চাইতে থাকে, আল্লাহর কাছে সেভাবে চাইলে (আল্লাহ সেই দুআ কবুল করেন)

দুআ করবার জন্য দুআ কবুলের সময়গুলো খুঁজে বের করুন। সেই সময় গুলোর অন্যতম হলঃ

i.রাতের শেষ তৃতীয়াংশ,

ii.ফরয সলাতের পূর্বে আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়,

iii.জুমুআর দিনে ইমাম যখন মিম্বরে অবস্থান করেন,

iv. বৃষ্টির সময়

v.সিজদাহরত অবস্থায় ইত্যাদি।

দুআ শুরু করুন আল্লাহ আযযাওয়াজালের প্রশংসা এবং রাসূলুল্লাহর (সা,) প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করে৷ ইস্তিগফারও তাওবাহ করুন।

অতঃপর দুআ করবার সময় নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখুনঃ

i.অবিচল থাকুন এবং আল্লাহর কাছে অনবরত দুআ করতে থাকুন,

ii.দুআর সাথে অন্তরকে জুড়ে নিন,

iii.উযু অবস্থায় থাকুন,

iv. দুআর আগে সাদাকাহ করুন,

v. যেসমস্ত সময়ে দুআ কবুল হয়, সেই সময়গুলোতে দুআ করুন।

ইমাম শাওকানি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “তোমার দুআ কবুল হয়েছে বলে জানবে যখন তোমার অন্তর প্রস্তুত থাকে,যখন কান্না আসে এবং অশ্রু ঝড়ে যায় আল্লাহর জন্য, যখন দুআয় তুমি থাক অটল। আর সবশেষে, যখন তোমার এমন অনুভূতি হয় যে কাঁধ থেকে যেন বিরাট এক বোঝা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

”রাসূলুল্লাহ বলেন, مَا مِنْ عَبْدِ بَاتَ عَلَى طُهُورٍ ثُمَّ تَعَارَ مِنَ اللَّيْلِ فَسَأَلَ اللهَ شَيْئًا مِنْ أَمْرِ الدُّنْيَا أَوْ مِنْ أَمْرِ الآخِرَةِ إِلَّا أَعْطَاهُ এমন কেউই নেই যে কিনা পবিত্র অবস্থায় ঘুমোতে যায়,অতঃপর গভীর রাতে উঠে এই দুনিয়া বা আখিরাতের জন্য উত্তম কিছু চায়,অথচ আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা তা পূর্ণ করেন না। (সুনান ইবনু মাজাহ ৩৮৮১, হাদিসটি হাসান)

[৬] কিয়ামুল লাইল

যারা গভীর রাতে কিয়ামুল লাইল আদায় করে তাঁদের জন্য জান্নাতে স্বচ্ছ দেয়ালের প্রাসাদ প্রস্তুত আছে। এছাড়া স্বয়ং আল্লাহ আযযাওয়াজাল রাতের ইবাদাতকারীদের প্রতি হাসেন। আর আল্লাহ তা’য়ালা কারও প্রতি হাসার অর্থ হল সে আল্লাহর দৃষ্টিতে উত্তম অবস্থায় রয়েছে। এটাই নেককারদের পথ, গুনাহ থেকে হিফাজতকারী। আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন, فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مَن قُرَةٍ أَعْيُنٍ جَزَاءُ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ কেউ জানে না তাঁদের আমলের প্রতিদানস্বরূপ কী অসাধারণ নয়নাভিরাম পুরষ্কার লুকিয়ে রাখা আছে। সূরা সাজদাহ, ৩২ : ১৭

হাসান আল-বসরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “গুনাহের ফল ছাড়া কারও কখনও রাতের সলাত ফসকে যায় না।”উম্মুল মুমিনিন আইশা (রদিআল্লাহু আনহা) বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা,) সাধারণ অবস্থায়) কখনও রাতের সালাত ত্যাগ করতে দেখিনি।”( আইশা (রদিআল্লাহু আনহা) থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ কখনও রাতের সলাত আদায় করতে না পারলেপরদিন বার রাকাআত নফল আদায় করতেন। আর অসুস্থতা, সফর, জিহাদ-ফি-সাবিলিল্লাহ ইত্যাদি সাধারণ অবস্থার ব্যতিক্রম৷)

[৭] আরাফার দিনের মর্যাদা এবং এই দিনে সিয়াম রাখা

রাসূলুল্লাহ বলেন, مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللَّهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ مِنْ يَوْمٍ عَرَفَةَوَإِنَّهُ لَيَدْنُو ثُمَّ يُبَاهِي هِمُ الْمَلاَ بِكَةَ فَيَقُولُ مَا أَرَادَ هَؤُلاَءِ الْمَلَائِكَةَআল্লাহ তা’য়ালা আরাফার দিনের তুলনায় অধিক সংখ্যক বান্দাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না। তিনি কাছে আসেন এবং ফেরেশতাদের নিকট তাঁর বান্দাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘এরা কী চায়?” সহিহ মুসলিম ১৩৪৮

শয়তানকে আর কোনো সময়েই এই দিনের চেয়ে বেশি অসহায় অবস্থায় পাওয়া যায় না। কারণ হল এই দিনে ওর আগের সমস্ত লাফঝাঁপ বৃথা হয়ে যায়। শয়তান অসহায় হবেই বা না কেন? আরাফার ময়দানে যে মানুষেরা তাওবাহ করে যাচ্ছে আর যারা হাজ্জে উপস্থিত হতে পারেনি তাঁরাও তো সিয়াম রাখছে আর আল্লাহ আযযাওয়াজালের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছে!

এই দিনে সিয়াম থাকা হলে বিগত এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় ।

আবু কাতাদাহ (রদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহকে আরাফার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেসকরা হল। তিনি বললেন, ‘তা (ঐ দিনের) পূর্বের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহের ক্ষতিপূরণ”।পুনরায় আশুরার দিনে সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, ‘তা এর বিগত এক বছরের গুনাহেরক্ষতিপূরণ।”

হাফসাহ (রদিআল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, “চারটি জিনিস রাসূলুল্লাহ (সা,) কখনও ছাড়তেন নাঃ

i. আশুরা দিনের সিয়াম রাখা,

ii. (জিলহজ্জের প্রথম) দশের সিয়াম,

iii. আইয়্যামের তিনটি সিয়াম

iv. আল-গাদাহের (ফজরের ফরয) আগে দু রাকাআত।” (সুনান আন-নাসাঈ ২৪১৬, হাদিসটি হাসান)

তবে যারা হাজ্জে যায়, তাঁদের জন্য সিয়াম না রাখাই উত্তম। وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ – رضى الله عنه – أَنَّ النَّبِيَّ – صلى الله عليه وسلم – { نَهَى عَنْ صَوْمِ يَوْمٍ عَرَفَةً بِعَرَفَةً আবু হুরাইরাহ (রদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা,) আরাফাতেই অবস্থান করা লোকদের জন্য আরাফাহ দিনের সিয়াম রাখতে নিষেধ করেছেন

ইমাম তিরমিযি (রহিমাহুল্লাহ) মন্তব্য করেন, “আলিমগণের পছন্দের মত হল আরাফার দিন বান্দা সিয়াম রাখবে যদিনা সে আরাফাতেই অবস্থান করে।”

[৮] ১০ই জিলহজ্জ পশু কুরবানি

আসমান-জমিন ও দিন-রাতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আযযাওয়াজাল কিছু দিনকে অন্য দিনের ওপর আমল করে নেওয়ার জন্য মর্যাদা দিয়েছেন। কুরবানি এমনই একটি আমল। দশম দিনে কুরবানির আমলে রয়েছে বিরাট পুরষ্কার, যারা হজ্জে গিয়েছে এবং যারা হজ্জে যায়নি তাঁদের উভয়দলের জন্যই। কুরবানি দেওয়ার সময় ১০ই জিলহজ্জ থেকে এর পরের তিন দিন পর্যন্ত অর্থাৎ, ১৩ই জিলহজ্জ পর্যন্ত। এই কুরবানি আল্লাহর তাওহিদের ঘোষণার জন্য, একমাত্র তাঁর প্রশংসার জন্য, পিতা ইবরাহিমকে (আলাইহিস সালাম) অনুসরণের জন্য। আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ অতএব আপনার রব্বের উদ্দেশ্যে সলাত আদায় এবং কুরবানি করুন। সূরা কাউসার, ১০৮ : ২

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ বলুন, নিশ্চয়ই আমার সলাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ জগৎসমূহের রব্ব আল্লাহর জন্য। (সূরা আনআ’ম, ৬ : ১৬২)

যখন কুরবানি দিবেন, তখন পড়তে পারেন, بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُم تَقَبَّلْ مِنِّي وَمِن أَهْلِي بَيْتِي

কাছাকাছি উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি ওয়াআল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা তাক্ববাল মিন্নি, ওয়া-মিন আহলি বাইতি।অর্থাৎ, আল্লাহর নামে (কুরবানি করছি), আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; ইয়া আল্লাহ আমার এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কবুল করুন। সহিহ মুসলিমের ১৯৬৬ এবং ১৯৬৭ অনুসারে

বরেণ্য আলিমগণ সকলে একমত যে, সাদাকাহর জন্য হলেও কুরবানি সম্পন্ন করা পশু কিনে দিয়ে দেওয়ার চেয়ে উত্তম। কেননা কুরবানি নিজেই একটি ইবাদাত। সর্বোচ্চ সাতজন একটি উট বা গরু কুরবানিতে অংশিদার হতে পারে। ঘরের কর্তা নিজের জন্য এবং তার উপর নির্ভরশীল নারী, শিশুদের পক্ষ থেকে কুরবানি করতে পারে; সাহাবারা এবং সালাফেরা এমনটিই করতেন। যেই কুরবানির নিয়ত করে, কুরবানি সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তার চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকা উচিত।কুরবানির পর পশুর গোশতের একাংশ নিজে খাবে; আর অপরাপর অংশগুলো দিয়ে আত্নীয় স্বজন ও গরিব মিসকিনদের ওকে আদায় করবে।

যদিও এমনটা বাধ্যতামূলক নয় যে কুরবানির জন্য আপনাকেই নিজ হাতে জবেহ করতে হবে, তবে এটাই সর্বোত্তম। আপনি কেবল তত্ত্বাবধানে থাকতে পারেন অথবা অপারগ হলে কাউকে দায়িত্ব দিয়েও করাতে পারেন।কুরবানি অবশ্যই হতে হবে ঈদুল আযহার সলাতের পরে; আর হাতে সময় পাবে পরের তিনদিন (১৩ই জিলহজ্জপর্যন্ত)। যারা ঈদের সলাতের আগেই কুরবানি করে ফেলেছিল, তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা,) নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তারা আবার কুরবানি করে।

[৯] তাওবাহ

রাসূলুল্লাহর অনুসরণে প্রতিদিনই তাওবাহ করা উচিত।আল্লাহ আযযাওয়াজাল বলেন, إنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালবাসেন এবং ভালবাসেন পবিত্রতা অর্জনকারীদের৷

নাবি মুসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয় যেখানে তিনি তার সম্প্রদায়কে সাথে নি য়েআল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দুআ করছিলেন। আল্লাহ আযযাওয়াজাল মুসাকে (আলাইহিস সালাম) বললেন, তাঁর সাথে উপস্থিতদের মাঝে এমন একজন আছে যে চল্লিশ বছর যাবত গুনাহ করেই যাচ্ছে এবং তখনও সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আছে।মুসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর কওমের দিকে ফিরে বললেন, সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই বের হয়ে যেতে হবে। কারণ তার কারণেই দুআ কবুল করা হচ্ছে না। ঐ গুনাহগার লোকটি তখন নীরবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো, যাতে তার গুনাহগুলো গোপন রাখা হয় যেভাবে আল্লাহ ৪০ বছর যাবত সেগুলো গোপন রেখেছেন; এবং তাকে যাতেক্ষমা করা হয়।

আল্লাহ আযযাওয়াজাল দেখলেন লোকটির তাওবাহ আন্তরিক। তখনই আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করলেন এবং বৃষ্টি দিলেন। মুসা (আলাইহিস সালাম) অবাক হয়ে গেলেন, ‘কেউ বের হয়ে যাওয়ার আগেই কেন বৃষ্টি হচ্ছে?” আল্লাহ আযযাওয়াজাল উত্তরে বললেন, ‘ঐ ব্যক্তির তাওবাহ কবুল করা হয়েছে এবং তার পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।”

এছাড়াও হাদিসে এসেছে, كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءُ وَخَيْرُ الْخَطَّابِينَ التَّوَّابُونَ প্রত্যেক বনি আদমই গুনাহগার, আর গুনাহগারদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাওবাহ করে। আল্লাহ আযযাওয়াজাল চাইলে গুনাহকে উত্তম আমলে রূপান্তর করে দিতে পারেন। সুনান ইবনু মাজাহ ৩৭/ ৪৩৯২, হাসান

তিনি বলেন, إِلَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلاً صَلِه ، فَأُوْلَيْكَ يُبَدِّلُ اللهُ سَيِّاتِهِمْ حَسَنَتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورٌ أَرَّحِيمًا )তারা ব্যতীত যারা তাওবাহ করে, ঈমান আনে এবং নেক আমল করে; আল্লাহ তাদের গুনাহসমূহকে পরিবর্তন করে তারা ব্যতীত যারা তাওবাহ করে, ঈমান আনে এবং নেক আমল করে; আল্লাহ তাদের গুনাহসমূহকে পরিবর্তন করেদেবেন হাসানাতে (উত্তম জিনিসে)। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা ফুরকান, ২৫ : ৭০

আল্লাহ আযযাওয়াজাল সকল ধরনের গুনাহেরই তাওবাহ কবুল করেন এবং ক্ষমা করে দেন। তিনি সুবহানাহু বলেন, قُلْ يَنعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ )বলে দিন, ওহে আমার বান্দারা যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা যুমার, ৩৯ : ৫৩

কিন্তু তাই বলে আমাদের তাওবাহ করতে যেন দেরি না হয়; কারণ আমরা জানিনা কখন আমাদের মৃত্যু এসে যাবে।

কিছু বিষয় আছে যেগুলো সুন্দর তাওবার ক্ষেত্রে সাহায্য করে,

i, আল্লাহ আযযাওয়াজাল ক্ষমা করতে পারেন – এই ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা।

ii. মুসলিমদের সাথে উত্তম আচরণ করা।

iii. ইবাদাত, যেগুলো আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্ক তৈরি করবে।

iv. উত্তম বন্ধুত্ব।2626

V. সবসময় আল্লাহর দয়ার কথা অন্তরে রাখা।

vi. মৃত্যুকে স্মরণ করা।

vii. সবর, যার দুটো দিক রয়েছেঃ পাপ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সবর এবং ভালো কাজ করার ব্যাপারে সবর।

viii. নিজের ব্যাপারে সচেতন হওয়া।

ix. এটা অনুভব করা যে, প্রতিটা মানুষেরই একটি উদ্দেশ্য রয়েছে।

যেমন আল্লাহ আযযাওয়াজাল নিৰ্দেশ দিয়েছেন,८أَدْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ আপন পালনকর্তার পথে আহ্বান করুন হিকমাহ দিয়ে ও উত্তম উপদেশে,আর তাদের সাথে আলোচনা করুন পছন্দনীয় পন্থায়। সূরা নাহল, ১৬ : ১২৫

একইসাথে কিছু বিষয় এমন আছে যা বান্দার তাওবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেগুলো মূলত উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর বিপরীত।

তাওবার নিয়ম

i. কৃত গুনাহের ব্যাপারে অনুতপ্ত হওয়া এবং অনুশোচনা দেখানোর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।

ii. উক্ত গুনাহ পুনরায় না করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর হওয়া।

iii.গুনাহের কাজটি ঢেকে দেওয়ার জন্য উত্তম আমল করা।

iv.যদি গুনাহটি কোনো বান্দার হকের সাথে জড়িত হয়, তাহলে অবশ্যই তার সাথে মিমাংসা করে নেওয়া।

(উদাহরণস্বরূপ যদি কোনো মুসলিমের নামে গীবত করে থাকেন অথবা তার সম্পদ চুরি করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে এবং তার প্রাপ্য সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যদি আর এমন মনে হয় যে এতে সমস্যা আরও বাড়বে, তাহলে যেভাবে তার গীবত করা হয়েছে, একইভাবে তার নামে ভালো ভালো কথা প্রচার করুন। অথবা তাকে তার সম্পদ পরোক্ষভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন, আর এমন হলে এটিও উত্তম।)

[১০] সাধারণ সুন্নাহ ও নফল সালাত

প্রতিদিন ১২ রাকাআত সুন্নাহ সলাতের জন্য আপনি জান্নাতে একটি প্রাসাদ পাবেন।রাসূলুল্লাহ তো বেশি বেশি সালাত আদায় করার তাগিদ দিয়েছেন। কারণ আমরা যতবার আল্লাহ আযযাওয়াজালের সামনে সিজদায় ঝুঁকি, এটি আমাদের একটি করে গুনাহ ঝরিয়ে দেয়। আর যতবার সিজদাহ থেকে উঠি, আল্লাহতা’লা আমাদের আমলনামায় একটি করে সাওয়াব যোগ করে দেন।

আমি আল্লাহ আযযা ওয়াজালের কাছে আমাদের যাবতীয় ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবংদুআ করছি যেন আমরা তাঁর রহমত এবং ক্ষমা লাভের জন্য জিলহজ্জের পবিত্র দিনগুলোর সুযোগ নিতে পারি ।আমিন।

কিতাব : জিলহজের প্রথম ১০ দিন

লেখক : আহমদ মুসা জিবরীল

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *