ব্যভিচারের অপকার ও তার ভয়াবহতা
১. কোনো বিবাহিতা মহিলা ব্যভিচার করলে তার স্বামী, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন মারাত্মকভাবে লাঞ্ছিত হয়। জনসমক্ষে তারা আর মাথা উঁচু করে কথা বলতে সাহস পায় না।
২. কোনো বিবাহিতা মহিলার ব্যভিচারের কারণে যদি তার পেটে সন্তান জন্ম নেয় তা হলে তাকে হত্যা করা হবে অথবা জীবিত রাখা হবে। যদি তাকে হত্যাই করা হয় তা হলে দু’টি গুনাহ একত্রেই করা হলো। আর যদি তাকে জীবিতই রাখা হয় এবং তার স্বামীর সন্তান হিসেবেই তাকে ধরে নেওয়া হয় তখন এমন ব্যক্তিকেই পরিবারভুক্ত করা হলো যে মূলতঃ সে পরিবারের সদস্য নয় এবং এমন ব্যক্তিকেই ওয়ারিশ বানানো হলো যে মূলতঃ ওয়ারিশ নয়। তেমনিভাবে সে এমন ব্যক্তির সন্তান হিসেবেই পরিচয় বহন করবে যে মূলতঃ তার পিতা নয়। আরো কতো কি?
৩. কোনো পুরুষ ব্যভিচার করলে তার বংশ পরিচয়ে গরমিল সৃষ্টি হয় এবং একজন পবিত্র মহিলাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় ।
৪. ব্যভিচারের কারণে ব্যভিচারীর ওপর দরিদ্রতা নেমে আসে এবং তার বয়স কমে যায়। তাকে লাঞ্ছিত হতে হয় এবং তারই কারণে সমাজে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ছড়ায়।
৫. ব্যভিচার ব্যভিচারীর অন্তরকে বিক্ষিপ্ত করে দেয় এবং ধীরে ধীরে তাকে রোগাক্রান্ত করে তোলে তেমনিভাবে তার মধ্যে চিন্তা, ভয় ও আশঙ্কার জন্ম দেয়। তাকে ফিরিশতা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এবং শয়তানের নিকটবর্তী করে দেয়। সুতরাং অঘটনের দিক দিয়ে হত্যার পরেই ব্যভিচারের অবস্থান। যার দরুন বিবাহিতের জন্য এর শাস্তিও জঘন্য হত্যা।
৬. কোনো ঈমানদারের জন্য এ সংবাদ শ্রবণ করা সহজ যে, তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু এ সংবাদ শ্রবণ করা তার জন্য অবশ্যই কঠিন যে, তার স্ত্রী কারোর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। সা’দ ইবন উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَوْ رَأَيْتُ رَجُلاً مَعَ امْرَأَتِي لَضَرَبْتُهُ بِالسَّيْفِ غَيْرَ مُصْفَح “আমি কাউকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে দেখলে তৎক্ষনাৎই আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেবো”।সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮৪৬, ৭৪১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৯৯
উল্লিখিত উক্তিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে পৌঁছতেই তিনি বললেন, «أَتَعْجَبُوْنَ مِنْ غَيْرَةِ سَعْدٍ؟ واللهِ لَأَنَا أَغْيَرُ مِنْهُ ، وَاللهُ أَغْيَرُ مِنّي ، وَمِنْ أَجْلِ غَيْرَةِ اللهِ حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ»
“তোমরা কি আশ্চর্য হয়েছো সা’দের আত্মসম্মানবোধ দেখে? আল্লাহর কসম খেয়ে বলছিঃ আমার আত্মসম্মানবোধ তার চেয়েও বেশি এবং আল্লাহ তা’আলার আরো বেশি। যার দরুন তিনি হারাম করে দিয়েছেন প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ধরনের অশ্লীলতাকে”।(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৮৪৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৯৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ وَاللهِ مَا مِنْ أَحَدٍ أَغْيَرُ مِنَ اللَّهِ أَنْ يَزْنِيَ عَبْدُهُ أَوْ تَزْنِيَ أَمَتُهُ “হে মুহাম্মাদ-এর উম্মতরা! আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি: আল্লাহ তা’আলার চাইতেও আর কারোর আত্মসম্মানবোধ বেশি হতে পারে না। এ কারণেই তো তাঁর অসহ্য যে, তাঁর কোনো বান্দা অথবা বান্দী ব্যভিচার করবে”।(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯০১)
৭. ব্যভিচারের সময় ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর ঈমান সঙ্গে থাকে না। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إذَا زَنَى الرَّجُلُ خَرَجَ مِنْهُ الْإِيْمَانُ؛ كَانَ عَلَيْهِ كَالظُّلَّةِ، فَإِذَا انْقَطَعَ رَجَعَ إِلَيْهِ الْإِيْمَانُ “যখন কোনো পুরুষ ব্যভিচার করে তখন তার ঈমান তার অন্তর থেকে বের হয়ে মেঘের ন্যায় তার উপরে চলে যায়। অতঃপর যখন সে ব্যভিচারকর্ম সম্পাদন করে ফেলে তখন আবারো তার ঈমান তার নিকট ফিরে আসে”।(আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬৯০)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «مَنْ زَلَى أَوْ شَرِبَ الْخَمْرَ نَزَعَ اللهُ مِنْهُ الْإِيْمَانَ كَمَا يَخْلَعُ الْإِنْسَانُ الْقَمِيْصَ مِنْ رأسه “যে ব্যক্তি ব্যভিচার অথবা মদ পান করলো আল্লাহ তা’আলা তার ঈমান ছিনিয়ে নিবেন যেমনিভাবে কোনো মানুষ তার জামা নিজ মাথার উপর কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে ব্যভিচার ও সমকামিতার ভয়াবহ পরিণতি ভয়াবহ পরিণতি থেকে খুলে নেয়”।(হাকিম: ১/২২; কান্যুল উম্মাল, হাদীস নং ১২৯৯৩)
৮. ব্যভিচারের কারণে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর ঈমানে ঘাটতি আসে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا يَزْنِي الزَّانِي حِيْنَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ ، وَلَا يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنُ ، وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ ؛ وَالتَّوْبَةُ مَعْرُوْضَةٌ بَعْدُ “ব্যভিচারী যখন ব্যভিচার করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ পানকারী যখন মদ পান করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। তবে এরপরও তাদেরকে তাওবা করার সুযোগ দেওয়া হয়”।(আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬৮৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪০০৭)
৯. ব্যভিচারের প্রচার-প্রসার কিয়ামতের অন্যতম আলামত । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ ، وَيَثْبُتَ الْجَهْلُ، وَيُشْرَبَ الْخَمْرُ، وَيَظْهَرَ الزَّنَا» “কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, মূর্খতা ছেয়ে যাবে, (প্রকাশ্যে) মদ্য পান করা হবে এবং প্রকাশ্যে ব্যভিচার সংঘটিত হবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৭১)
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, مَا ظَهَرَ الرَّبَا وَالزِّنَا فِي قَرْيَةٍ إِلَّا أَذِنَ اللَّهُ بِإِهْلَاكِهَا» “কোনো এলাকায় সুদ ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে আল্লাহ তা’আলা তখন সে জনপদের জন্য ধ্বংসের অনুমতি দিয়ে দেন”।
১০. ব্যভিচারের শাস্তির মধ্যে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্য কোনো দণ্ডবিধিতে নেই। যা নিম্নরূপ:
ক. বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি তথা হত্যা খুব ভয়ানকভাবেই প্ৰয়োগ করা হয়। এমনকি অবিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি কমানো হলেও তাতে দু’টি শাস্তি একত্রেই থেকে যায়। বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শারীরিক শাস্তি এবং দেশান্তরের মাধ্যমে মানসিক শাস্তি ।
খ. আল্লাহ তা’আলা এর শাস্তি দিতে গিয়ে ব্যভিচারী অথবা ব্যভিচারিণীর প্রতি দয়া করতে নিষেধ করেছেন।
গ. আল্লাহ তা’আলা এর শাস্তি জনসমক্ষে দেওয়ার জন্য আদেশ করেছেন। লুক্কায়িতভাবে নয়।
১১. ব্যভিচার থেকে দ্রুত তাওবা করে খাঁটি নেক আমল বেশি বেশি করতে না থাকলে ব্যভিচারী অথবা ব্যভিচারিণীর খারাপ পরিণামের বিপুল আশঙ্কা থাকে । মৃত্যুর সময় তাদের ঈমান নসীব নাও হতে পারে। কারণ, বার বার গুনাহ করতে থাকা ভালো পরিণামের বিরাট অন্তরায়। বিশেষ করে কঠিন প্রেম ও ভালোবাসার ব্যাপারগুলো এমনই।
প্রসিদ্ধ একটি ঘটনায় রয়েছে, জনৈক ব্যক্তিকে মৃত্যুর সময় কালেমা পড়তে বলা হলে সে বলে, أَيْنَ الطَّرِيقُ إِلَى حَمَّامِ مِنْجَاب» “মিনজাবের গোসলখানায় কীভাবে যেতে হবে, কোন পথে”? এর ঘটনায় বলা হয়, জনৈক ব্যক্তি তার ঘরের দরোজায় দাঁড়ানো ছিলো। এমতাবস্থায় তার পাশ দিয়ে জনৈকা সুন্দরী মহিলা যাচ্ছিলো। মহিলাটি তাকে মিনজাব গোসলখানার পথ জিজ্ঞাসা করলে সে তার ঘরের দিকে ইশারা করে বললো, এটিই মিনজাব গোসলখানা। অতঃপর মহিলাটি তার ঘরে ঢুকলে সেও তার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলো। মহিলাটি যখন দেখলো, সে অন্যের ঘরে এবং লোকটি তাকে ধোকা দিয়েছে তখন সে তার প্রতি খুশি প্রকাশ করে বললো, তোমার সঙ্গে একত্রিত হতে পেরে আমি খুবই ধন্য। সুতরাং কিছু খাবার-দাবার ও আসবাবপত্র জোগাড় করা প্রয়োজন যাতে করে আমরা উভয় একত্রে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। দ্রুত লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র খরিদ করে আনলো। ফিরে এসে দেখলো, মহিলাটি ঘরে নেই। কারণ, সে ভুলবশত ঘরে তালা লাগিয়ে যায় নি। অথচ মহিলাটি যাওয়ার সময় ঘরের কোনো আসবাবপত্র সঙ্গে নেয় নি। তখন লোকটি আধ পাগল হয়ে গেলো এবং গলিতে গলিতে এ বলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো: يَا رُبَّ قَائِلَةٍ يَوْماً وَقَدْ تَعِبَتْ كَيْفَ الطَّرِيْقُ إِلَى حَمَّامِ مِنْجَابِ “হে অমুক! যে একদা ক্লান্ত হয়ে বলেছিলে, মিনজাবের গোসলখানায় কীভাবে যেতে হয়, কোন পথে”? একদা সে উক্ত ছন্দটি বলে বেড়াতে লাগলো এমন সময় জনৈকা মহিলা ঘরের জানালা দিয়ে প্রত্যুক্তি করে বললো, هَل جَعَلْتَ سَرِيعاً إِذْ ظَفِرْتَ بِهَا حِرْزاً عَلَى الدَّارِ أَوْ قُفْلاً عَلَى الْبَابِ “কেন তুমি তাকে পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুত দরোজা বন্ধ করে ফেলোনি অথবা ঘরে তালা লাগিয়ে যাও নি?” তখন তার চিন্তা আরো বেড়ে যায় এবং প্রথমোক্ত ছন্দ বলতে বলতেই তার মৃত্যু হয়। নাঊযু বিল্লাহ।
১২. কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচারের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার তাদেরওপর আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক আযাব নিপতিত হওয়ার এক বিশেষ কারণ।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَا ظَهَرَ فِي قَوْمِ الزِّنَا أَوِ الرِّبَا إِلا أَحَلُّوا بِأَنْفُسِهِمْ عَذَابَ اللهِ “কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচারের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটলে তারা নিজেরাই যেন হাতে ধরে তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার আযাব নিপতিত করলো”
মাইমূনাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا تَزَالُ أُمَّتِى بِخَيْرِ مَا لَمْ يَفْشُ فِيهِمْ وَلَدُ الزَّنَا ، فَإِذَا فَشَا فِيْهِمْ وَلَدُ الزَّنَاءِ فَأَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعَذَابٍ “আমার উম্মত সর্বদা কল্যাণের ওপর থাকবে যতক্ষণ না তাদের মধ্যে জারজ সন্তানের আধিক্য দেখা না দিবে। যখন তাদের মধ্যে জারজ সন্তান বেড়ে যাবে তখনই আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ব্যাপক আযাব দিবেন।