মদ পানের শাস্তি
মদ্যপান ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কঠিন গুনাহ এবং ফৌজদারী অপরাধরূপে গণ্য। এজন্য শরীয়ত অনুযায়ী শাস্তিদান একান্তই কর্তব্য। কুরআন মজীদে এর শাস্তির কথা উল্লেখ নেই। তবে হাদীসের ভিত্তিতে ফকীহগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, মদ্যপায়ীর শাস্তি হচ্ছে দোররা। যদি কারো মদ পান করার বিষয়টি যথানিয়মে প্রমাণিত হয় তবে তাকে আশি দোররা মারা হবে। মদ এক ফোঁটা পান করলেও এ হুকুম প্রযোজ্য হবে। এ দোররাসমূহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারা হবে । মাথা ও মুখমণ্ডলে প্রহার করবে না। প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে দণ্ডাদেশ জারী করার সময় লজ্জাস্থান ছাড়া সর্বাঙ্গ বিবস্ত্র করে তা প্রয়োগ করবে। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৬০]
মদ পান করার বিষয়টি দুই ব্যক্তির সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় এবং তার মুখে এখনো মদের গন্ধ বাকী থাকে অথবা কাউকে যদি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধরে আনা হয় এবং সাক্ষীগণ তার মদ পানের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় তাহলে তাকে দণ্ড প্রদান করা হবে। এমনিভাবে কেউ যদি মদ পান করেছে বলে নিজে স্বীকার করে এবং মুখে মদের গন্ধ অবশিষ্ট থাকে তবে তাকেও দণ্ড প্রদান করা হবে। মদ পরিমাণে কম পান করুক বা বেশি পান করুক তাতে কোন পার্থক্য নেই। মুখ থেকে মদের দুর্গন্ধ খতম হওয়ার পর মদ পানের কথা স্বীকার করলে তার উপর দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না ।
এমনিভাবে নেশা এবং দুর্গন্ধ খতম হয়ে যাওয়ার পর সাক্ষীগণ যদি কারো ব্যাপারে মদ পানের সাক্ষ্য প্রদান করে তবে তার উপরও দণ্ড প্রয়োগ করা হবে না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অথবা মুখে দুর্গন্ধ থাকা অবস্থায় যদি সাক্ষীগণ কাউকে পাকড়াও করে আনে এবং ঐ স্থান থেকে আদালত যে শহরে অবস্থিত সেখানে নিয়ে যেতে যেতে যদি তার মুখের দুর্গন্ধ বিদূরিত হয়ে যায় তবে তাকেও দণ্ড প্রদান করা হবে। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৫৯]
নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি যদি নিজে মদ পানের কথা স্বীকার করে তবে এই ভিত্তিতে তাকে দণ্ড প্রদান করা যাবে না। ফকীহগণ বলেন, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি চিনার উপায় হল, যদি কোন শরাবখোর ব্যক্তি আসমান-জমিনের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারে; পুরুষ মহিলা চিনতে না পারে এবং কী বলে তা তারতম্য করতে না পারে আর অধিকাংশ সময় অহেতুক প্রলাপ বকে তবে তাকে নেশাগ্রস্ত, মাতাল মনে করা হবে। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৫৯]
যদি সাক্ষীগণ কাযী (বিচারক)-এর নিকট কোন ব্যক্তির মদ পান করার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় তবে কাযী সাক্ষীদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, মদ কী জিনিস? তারপর জিজ্ঞাসা করবে, সে কিভাবে তা পান করল? কেননা, হতে পারে তাকে জোরপূর্বক মদ পান করানো হয়েছে। এরপর জিজ্ঞাসা করবে, সে কবে মদ পান করেছে? কারণ, এটা তো অনেক আগের ঘটনাও হতে পারে। তারপর জিজ্ঞাসা করবে, সে কোথায় পান করেছে? কেননা, হতে পারে যে, সে দারুল হরবে তা পান করেছে। যদি সাক্ষীগণ এসব ব্যাপারে যথাযথ বিবরণ দিতে পারে তবে বিচারক উক্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করে রাখবে। অতঃপর তার আদালত তথা ন্যায়পরায়ণতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হবে। বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে কোন ফয়সালা দেওয়া যাবে না। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৫৯]
বালিগ, জ্ঞানবান, বাকশক্তিসম্পন্ন কোন মুসলমান মদ পান করলে তার ব্যাপারে অভিযোগ ও সাক্ষ্য প্রদান করা যাবে। আর এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাকে দণ্ড প্রদান করা হবে। পক্ষান্তরে নাবালিগ, পাগল এবং কাফির ব্যক্তির উপর দণ্ড প্রদান করা যাবে না। কোন বোবা ব্যক্তির উপরও দণ্ড প্রদান করা যাবে না। তবে অন্ধ ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করা হবে। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৫৯]
যদি দারুল ইসলামে কোন মুসলমান মদ পান করে তারপর সে বলে যে, ‘মদ পান হারাম’ আমি এ কথা জানতাম না তবে এ অবস্থায়ও তাকে দোররা মারা হবে। কোন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যাপারে যদি সাক্ষীগণ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সে মদ পান করেছে তবে হুঁশ ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে দণ্ড প্রদান করা যাবে না। কারো মুখ থেকে মদের গন্ধ পাওয়া গেলে তাকে দণ্ড প্রদান করা যাবে না, যদি না সাক্ষীগণ তার মদ পান করার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় অথবা সে নিজে স্বীকার করে। যদি দুইজন সাক্ষীর মধ্যে একজন বলে যে, সে মদ পান করেছে আর অপরজন বলে যে, সে মদ বমি করেছে তবে তাকে দণ্ড প্রদান করা যাবে না। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৫৯]
যদি দুইজন সাক্ষী কারো মদ পানের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মুখ থেকে তখন মদের গন্ধও পাওয়া যায় কিন্তু সময়ের ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় তাহলে তাকে দণ্ড প্রদান করা জায়েয হবে না। এমনিভাবে যদি দুইজন সাক্ষীর একজন বলে যে, সে মদ পান করেছে, আর অপরজন বলে যে, সে এ কথা স্বীকার করেছে, তাহলে তাকেও দণ্ড প্রদান করা যাবে না। অনুরূপভাবে যদি একজন সাক্ষী বলে যে, সে মদের নেশায় আচ্ছন্ন আছে আর দ্বিতীয়জন বলে যে, সে অন্য কোন বস্তুর নেশায় আচ্ছন্ন আছে তবে তাকেও দোররা মারা জায়েয হবে না । [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৬০]
কেউ যদি মদকে পানি, দুধ অথবা অন্য কোন তরল বস্তুর সাথে মিশ্রিত করে তা পান করে তবে এ ক্ষেত্রে মদের পরিমাণ বেশি হলে এক ফোঁটা পান করলেও তাকে হদ মারা হবে। আর যদি মদের পরিমাণ কম হয় তথাপিও তা পান করা হালাল হবে না। তবে নেশাগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত এ জাতীয় পানীয় দ্রব্য পান করলে দণ্ড প্রদান করা হবে না। [আলমগীরী : ২য় খণ্ড : পৃ. ১৬০]
কাউকে জোরপূর্বক মদ পান করানো হলে তাকে দণ্ড প্রদান করা যাবে না। [হিদায়া : ২য় খণ্ড : পৃ. ৫২৮]
মদ পান করার কারণে যাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তাকে লা’নত করা বা ভর্ৎসনা করা জায়েয নেই। হযরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ নামক এক ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর যামানায় মদ পানের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাকে লক্ষ্য করে একদা এক সাহাবী বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি তার প্রতি লা’নত বর্ষণ করুন। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লা’নত করো না। সে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসে। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- وَلكِنْ قُولُوا اللهمَّ اغفِر لَهُ اللّهُمَّ ارْحَمْهُ বরং বল, হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দিন এবং তার প্রতি রহম করুন।
এতে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, শাস্তিপ্রাপ্ত কোন মদখোর ব্যক্তিকে লা’নত করা জায়েয নেই। এমনকি কোন গুনাহগার ব্যক্তিকে তার গুনাহের কথা উল্লেখ করে লজ্জা দেওয়া শরীয়তে নিষিদ্ধ। [আল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ : ৫ম খণ্ড : পৃ. ৩৪]