গানবাজনা ও সংগীতের সংজ্ঞা ও ইতিহাস
গান কী বা গান কাকে বলে সর্বপ্রথম আমাদের সে কথাটি জেনে নেয়া প্রয়োজন।
গান হচ্ছে মনের ভাবকে কথা, সুর ও তালের মাধ্যমে প্রকাশ করা ৷
ফের্সো বিল্লিনির মতে— ‘গান হচ্ছে ধ্বনির মাধ্যমে ভাব ও আবেগকে প্রকাশ করার কৌশল। (ফের্সো বিল্লিনি : মেনুয়েলি ডি মিউজিকা (মিলানো, বিকোর্ডি ১৮৫৩) পৃ- ২৪)
বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান’-এর মতে- ‘মনের ভাবকে কথা, সুর ও তালের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার নাম গান। (মোবারক হোসেন খান : সংগীত সাধক উস্তাদ আয়েত আলী খার তৃতীয় পুত্র এবং উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভাতিজা। ১৯৩৮ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জিলার শিবপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। সংগীত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ এবং ১৯৮৬ সালে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন।- বাংলা একাডেমী ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সংগীত দর্পণ’ গ্রন্থে লেখক পরিচিতি)
আরবী ভাষায় গানকে গিনা, নাশীদ এবং সামা’ বলা হয়।
গান, গীত ও সংগীত
গান ও গীত সমার্থক শব্দ। সংগীত শব্দটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও তার সংজ্ঞা ভিন্ন। তবু অনেকে সংগীতকে গান অর্থে ব্যবহার করে থাকেন।
সংগীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মোবারক হোসেন খান বলেছেন— ‘গান, বাজনা, নাচ। তিনটি কলা বা শিল্প । এই তিনটি কলার মিলন (এর নাম) সংগীত।
‘সংগীত কোষ’–এ সংগীত এর এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে— “কণ্ঠ বা যন্ত্র সংগীতের সঙ্গে তবলা মৃদঙ্গ প্রভৃতি আনদ্ধ যন্ত্রে তাল নির্দেশমূলক বাদনকে সংগীত বলা হয়।
আরেক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে— ‘সংগীত কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে গান। গৈ ধাতু থেকে সংগীত কথাটি নিষ্পন্ন হয়েছে। গৈ ধাতুর অর্থ গান করা। কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে প্রাচীনকালে সংগীত বলতে গীত, বাদ্য ও নৃত্যকে বোঝাত। কিন্তু বর্তমানকালে সংগীত বলতে মুখ্যত কণ্ঠ সংগীতকে বোঝায়। যন্ত্র বাদনকেও সংগীত বলা হয়ে থাকে। তবে নৃত্যকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয় ।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘অভিব্যক্তির যেটুকু সার, তাহাই সংগীত। সংগীতের যে ঝংকার তাহা মুক্ত- অবাধ; বস্তুবিচারের বাঁধন, চিন্তার বাঁধন সংগীতকে বাঁধিতে পারে না ।’
গান ও গীত শব্দ দুটো সমার্থক তার প্রমাণ গীতিকার শব্দের সংজ্ঞা। গীতিকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- “যিনি গানের পদ বা কাব্যাংশ বা মাতু রচনা করেন তাকে গীতিকার বলা হয়।
সংগীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সংগীতের ইতিহাস প্রসঙ্গে মোবারক হোসেন খান বলেন- ‘গান, বাজনা বা নাচের সৃষ্টি হলো কেমন করে তার রহস্য কিন্তু আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। গান, বাজনা ও নাচ— এই তিনটি কলার সমন্বয় সাধন কখন হয়েছে তা-ও কেউ বলতে পারে না। গান আগে সৃষ্টি হয়েছে না বাজনা আগে, আবার বাজনা আগে, না নাচ আগে— কার পূর্বে কার সৃষ্টি এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে একথা বলা যায়, মানুষ সৃষ্টির সাথে গানের সৃষ্টির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের সুর ব্যবহার করতো। সেই সুর থেকে বিবর্তনের মাঝ দিয়ে গানের উদ্ভব। স্বর তাই সুরের উৎস।
আরবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবের আগে থেকেই কবিতা ও সংগীত চর্চা ছিলো। তাঁর আবির্ভাবের পরও ছিলো। তবে তা সীমিত পর্যায়ে। কারণ আলকুরআন তাদের হৃদয়ে এমন দোলা দিয়েছিলো যে, তাদের কাছে আলকুরআনের মুকাবিলায় সকল কবিতা ও গান ম্লান মনে হতো।
তবু বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানে যেমন দুই ঈদ এবং বিয়ে শাদীতে সীমিত পর্যায়ে কিছু গান, ছড়া গান গাওয়ার প্রচলন ছিলো। সাথে দফ বাজানো হতো। (দফকে বাংলা ভাষায় খঞ্জরী” বলা হয়)। কিশোরী কিংবা দাসী বাঁদীরাই সাধারণত গান করতো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পর খুলাফা-ই রাশিদীনের সময়ও এরূপ চলে আসছিলো। খিলাফাতের পর আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে আল মাহ্দীর (৭৭৫-৭৮৫) পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকভাবে গান বাজনার চর্চা শুরু হয়।
‘বাংলাদেশের প্রাচীন সংগীতের পরিচয় পাওয়া যায় পালবংশের রাজত্ব কালে । অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করে পালবংশ। এ সময়ের রাগ ও প্রবন্ধ শ্রেণীর সংগীত বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়। এ সময়কার রচিত পালা গান গ্রাম্য লোকদের কণ্ঠে গীত হতো। বাংলাদেশে ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির আগমন এবং লক্ষণসেনের পলায়নে বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত।
সংগীতের সম্পূর্ণ দিন বদলের পালা শুরু। আর এ বদল ঘটালেন আমীর খসরু। দিল্লীর সম্রাটের সভা সংগীতজ্ঞ আর সংগীত শাস্ত্রকার। তিনি ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত। কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন। গান শুনিয়ে সম্রাটের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন প্রকারের গান। সংগীত এ আমলে শাস্ত্রীয় রূপ লাভ করলো। আমীর খসরু সঙ্গীতকে পদ্ধতিগত রূপ দিলেন। নিয়ম-কানুন মেনে চলার রীতি প্রবর্তন করলেন। রাগ-রাগিনীর অবয়বে সাজালেন সংগীতকে। এভাবেই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে সংগীতের বিস্তার ঘটে।
কবিতা ও গান
কবিতা ও গান একই জিনিসের রকমফের, নাকি দুটো পৃথক জিনিস এ নিয়ে পণ্ডিতদের বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেছেন কবিতা ও গান একই জিনিস। আবার কেউ বলেছেন এ দুটোর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, গান ও কবিতা একই জিনিস। এ দুয়ের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ সকল গান-ই কবিতা এবং সকল কবিতা-ই গান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে- ‘সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দেই ও সংগীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দেই।
অন্যত্র তিনি বলেছেন- ‘গীত সুরের সাহায্যে প্রত্যেকটি কথাকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ নিবিষ্ট করিয়া দেয়। কথায় যে অভাব আছে সুরে তা পূর্ণ হয় এবং গানে এক কথা বার বার ফিরিয়া গাহিলে ক্ষতি হয় না। যতক্ষণ চিত্ত না জাগিয়া উঠে ততক্ষণ সংগীত ছাড়ে না। এই জন্য প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে গান ছাড়া কবিতা নাই বলিলে হয়।
তিনি আরও বলেন- ‘কবিতায় আছে অগীত সংগীত, তার সীমানায় যদি গীত সংগীতের ব্যবধান অলঙ্ঘ্য হয় তা হলে তো স্বভাবতই গানের সৃষ্টি হতে পারে না।’
তাঁর মতে- ‘কবিতায় যেটা ছন্দ, সংগীতে সেইটেই লয়। এই লয় জিনিসটি সৃষ্টি ব্যাপিয়া আছে, আকাশের তারা হইতে পতঙ্গের পাখা পর্যন্ত সমস্তই ইহাকে মানে বলিয়াই বিশ্বসংসার এমন করিয়া চলিতেছে অথচ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে না। অতএব কাব্যেই কী, গানেই কী, এই লয়কে যদি মানি তবে তালের সঙ্গে বিবাদ ঘটিলেও ভয় করিবার প্রয়োজন নাই ৷ ‘
আরেক দল পণ্ডিতের মতে কবিতা ও গানের মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য রয়েছে । যার কারণে ‘সব গানই কবিতা কিন্তু সব কবিতাই গান নয়।’ আধুনিক যুগের পণ্ডিতগণ বেশির ভাগই এই দলের অন্তর্ভুক্ত। সংগীত বিষয়ক অন্যতম গবেষক পিয়েরের (Pierer) মতে— ‘কাব্যের চেয়ে সংগীতের স্থান উচ্চে, কারণ কাব্য শুধু বুদ্ধিগ্রাহ্য আবেগকে বর্ণনা করতে পারে, আর সংগীত অস্পষ্ট এবং অনির্বচনীয় আবেগ ও অনুভূতিগুলির প্রকাশ করে।
উপরের কথাগুলো আমরা এভাবেও বলতে পারি, কবিতার উপজীব্য হচ্ছে ভাষার উৎকর্ষ, শব্দের কারুকাজ, ভাবের গাম্ভীর্য যা মানুষের বিবেক নামক অনুভূতিকে নাড়া দেয়, আন্দোলিত করে, ভাবনাকে গভীরতায় নিয়ে যায়, ফলে চিন্তা, চেতনা ও রুচিকে পরিশীলিত করে। আর গানের উপজীব্য হচ্ছে সুর, তাল, লয়। শব্দের আলংকারিক গাঁথুনীর চেয়ে সুরের প্রাধান্য সেখানে অনেক বেশি। কবিতা বিবেককে নাড়া দিলেও গান অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবেগকে জাগিয়ে তোলে। শক্তি দুটোরই রয়েছে। কিন্তু গান যে শক্তি প্রয়োগ করে তার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী । পক্ষান্তরে কবিতা যে শক্তি প্রয়োগ করে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।