ইসলামপূর্ব ওপরবর্তী যুগে আরবে কবিতা ও গান
ইসলামপূর্ব যুগে আরবে কবিতা ও গান
ইসলামপূর্ব যুগে কবিতা ছিলো সাহিত্যের উর্বরতম ফসল। গদ্য সাহিত্য তখনও বিকশিত হতে পারেনি। তৎকালিন আরব বেদুঈনরা মুখে মুখে কবিতা আবৃত্তি করতো। কবিতা তাদের জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। সে যুগে বহু সংখ্যক কবির আবির্ভাব ঘটেছিলো। প্রতিটি গোত্র, কাফেলা, সম্প্রদায় ও বংশে একাধিক কবি ছিলো।
কবিতা যেভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিলো, গান ঠিক সেভাবে বিস্তৃতি লাভ করেনি। কারণ কবিতা প্রতিটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের রক্তে মাংসে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মহিলা, কিশোর, কিশোরী কেউই কবিতা চর্চার বাইরে ছিলো না। গানেরও চর্চা ছিলো, তবে তা বিশেষ কিছু শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।
তৎকালিন আরবে কোনো পরিবারে যখন কোনো কবির আবির্ভাব হতো তখন সব গোত্র থেকেই অভিনন্দন বাণী আসতো। ভোজের আয়োজন করা হতো। মহিলারা সমবেত হয়ে অভিনন্দন গীতি গেয়ে শুনাতো।
ঐ সময় প্রায় প্রত্যেক স্বচ্ছল আরবের নিজস্ব গায়িকা ছিলো। তাদের কাছে সব সময় যন্ত্র সংগীতের চেয়ে কণ্ঠ সংগীত অধিকতর সমাদৃত ছিলো। এর পেছনে কবিতার প্রতি বিশেষ অনুরাগও কিছুটা দায়ী।
উটের গতির তালে বেদুঈনরা যে গান রচনা করতো, আরবী ছন্দের উৎপত্তি সে গান থেকেই ৷ উটকে দ্রুত চালানোর জন্য যে গান তারা রচনা করতো তাকে ‘হুদী’ বলা হতো।
কথিত আছে— ‘মুদার ইবনু নাযার নামের এক ব্যক্তি উটের পিঠ থেকে পড়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলো। লোকে তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলো। আর হাতের যন্ত্রণায় সে (হায়রে হাত!) বলে বিলাপ করছিলো। তার গলার সুর ছিলো খুবই মিষ্ট । বিলাপের করুণ সুর সুমধুর ছন্দের সৃষ্টি করেছিলো । উটগুলো তার এ সুমধুর সুর শুনে দ্রুত চলা শুরু করেছিলো। সেখান থেকেই উট চালকের গান ‘হুদী’ এর প্রচলন হয় । রাজায নামক ছন্দে এ গান রচিত হয়।`
‘এ গানের সুর মাধুর্যে এমন ব্যঞ্জনা ব্যাপ্ত ছিলো, যে জন্যে মরুভূমিতে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আরোহীরা ক্লান্তিবোধ করতো না। উষ্ট্রের পদচারণায়ও গানের অনুপ্রেরণা ছিলো অতি মাত্রায়।
এভাবেই আরবদের মধ্যে গান এবং সুরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। ইসলাম পূর্ব যুগের গান ও কবিতার বৈশিষ্ট্য ছিলো শৌর্য-বীর্য, প্রেম-প্রীতি, বিরহ-মিলন, সুখ- দুখ, হাসি-কান্না, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির নিখুঁত চিত্র কবিতা ও গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা। এজন্যই বলা হয়েছে- কবিতা আরবদের দিনপঞ্জী।
তবে এই যুগে অশ্লীলতা, পরকীয়া, নারীদেহের অশ্লীল বর্ণনা, লাম্পট্য, হত্যা, লুণ্ঠনের বর্ণনাসহ অনেক অবান্তর বিষয়বস্তুরও ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এ যুগের কবিদের মধ্যে ‘আস সাবউল মুআল্লাকাত’ বা ‘সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা’র রচয়িতা সাতজন কবিই হলেন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এদের নাম ও খ্যাতি অল্প সময়ের মধ্যেই সারা আরবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কারণ তাঁরা ছিলেন প্রতিযোগিতায় জয়ী কীর্তিমান সুপুরুষ কবি। যদিও তৎকালীন আরবে কবি ও গীতিকারের অভাব ছিলো না।
উল্লেখ্য যে, প্রতি বছর মক্কার অদূরে উকায নামক জায়গায় মেলা বসতো। সেখানে দেশ-বিদেশের কবিরা এসে কবিতা পাঠ করতেন। যে কবিতাটি সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে গণ্য হতো সেটি কা’বা শরীফের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত মোট সাত জন কবির কবিতা কা’বা শরীফের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলো । সেগুলোকে একত্রে ‘আস সাবউল মুআল্লাকাত’ বা ‘সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা’ বলা হতো। যে সাতজন প্রসিদ্ধ কবির কবিতা ঝুলানো হয়েছিলো তাঁরা হলেন- ১. ইমরুউল কায়স (মৃত্যু- ৫৪০ খ্রিস্টাব্দ, প্রথম মুআল্লাকাহ্)। ২. তারাফা ইবনু আল আব্দ আল বাকরী (মৃত্যু ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, দ্বিতীয় মুআল্লাকাহ্)। ৩. যুহাইর ইবনু আবী-সুলামা (মৃত্যু-৬১২ খ্রিস্টাব্দ, তৃতীয় মুআল্লাকাহ্)। ৪. লাবীদ ইবনু রবী‘আহ্ (মৃত্যু- ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ, চতুর্থ মুআল্লাকাহ্)। ৫. আমর ইবনু কুলসুম (মৃত্যু সন অজ্ঞাত, পঞ্চম মুআল্লাকাহ্)। ৬. আনতারা ইবনু শাদ্দাদ (মৃত্যু- ৬১৫ খ্রিস্টাব্দ, ষষ্ঠ মুআল্লাকাহ্)। ৭. হারিস ইবনু হিল্লিযা (মৃত্যু ৫৮০ খ্রিস্টাব্দ, সপ্তম মুআল্লাকাহ্)।
এছাড়া স্বনামধন্য আরও অনেক কবি ছিলেন। যেমন- নাবিগা যুবয়ানী, আলআশা কায়স, আলকামাহ্, আবিদ ইবনুল আল আবরস, হাতিম তাঈ, সমবাল ইবনু আদীয়া, উমাইয়া ইবনু আবীসাল্ত প্রমুখ। ইসলামপূর্ব যুগে মহিলারাও কবিতা রচনা করতেন ।
ইসলাম পরবর্তী যুগে আরবে কবিতা ও গান
তৎকালিন আরবে কাব্যচর্চা, কবিতা আবৃত্তিই ছিলো প্রধান সাহিত্য চর্চা। সংগীত চর্চা ছিলো, তবে তা কাব্য চর্চা বা কবিতা চর্চার মতো এত ব্যাপক ছিলো না । গরীব শ্রেণীর পেশাদার কিছু লোকজন সংগীতের সাথে জড়িত ছিলেন। সাধারণত দাসী বাঁদীরাই গান বাজনা করে বিত্তশালী ও গোত্রপতিদের মনোরঞ্জন করে বেড়াতো। তার কিছু প্রভাব শিশু কিশোরদের মাঝেও দেখা যেত। তাছাড়া হুড়া গানের মত করে অনেকে সুর করে কবিতাও আবৃত্তি করতো। তবে বিশেষ বিশেষ দিনে গোত্রের লোকজন একত্রিত হয়ে আমোদ ফূর্তি করতো। সেখানে মদপান, নাচ ও গান হতো।
আরবদের গান বাজনা সম্পর্কে The Legacy of Islam গ্রন্থে বলা হয়েছে- ‘গীতি কবিতা (قصيدة -কাসীদাহ্) ছাড়াও কণ্ঠ সংগীতের পদ্যরীতির মধ্যে খণ্ড কবিতা (قطعة-কিতআহ), রোমান্টিক গান (غزل -গযল) এবং অধিকতর জনপ্রিয় ‘মাওয়ালী’ (উক্তি) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গানের সঙ্গে যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতো তার মধ্যে আবশ্যিকভাবে ছিলো লিউট (বীণা, আরবী নাম عود বা أعواد), প্যান্ডোর (طنبور), সন্টারী (قانون) কিংবা বাঁশী مزمار ,شاهين, قصب)
অপরদিকে ড্রাম (طبل), ট্যাম্বুরিন (دف) কিংবা ওয়ালস্ (قضب) সংগীতের ছন্দ জোরদার করে তুলতো। এছাড়াও ছিলো অনেক ছোটখাট বাদ্যযন্ত্র, কিন্তু এগুলো প্রায়ই কণ্ঠ সংগীতের গৌরচন্দ্রিকা বা বিরতিকালিন সময়ে যন্ত্র সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
উক্ত গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে- “স্বাধীন লোকদের মধ্যে উৎসব উপলক্ষে সর্বপ্রকার বাদ্যযন্ত্র দেখা যেতো। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে খঞ্জরী (دف) বিশেষ জনপ্রিয় ছিলো।
যুগ যুগ থেকে চলে আসা অশ্লীল, যৌন উদ্দীপক, পরকীয়ার রগরগে বর্ণনা সম্বলিত কবিতা ও গান এবং বিভিন্ন দেবদেবীর নামে রচিত বন্দনা গীত যা শির্কের দোষে দুষ্ট সে সবকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিষিদ্ধ করেছেন।
কবিতা সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- لان يمتلئ جوف أحدكم فيحا خير له من أن يمتلئ شعرا ـ ‘তোমাদের কারও পেট কবিতা দ্বারা পূর্ণ করার চেয়ে পুঁজ দ্বারা পূর্ণ করা অনেক ভালো। আয়িশা (রা) এ হাদীস শুনে বলেছেন- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কবিতা বলতে সেসব কবিতাকে বুঝিয়েছেন, যাতে তাঁর কুৎসা বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু রাশীক তাঁর উমদা গ্রন্থে এ হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- ‘এখানে সেই ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যার অন্তরে কবিতা এমনভাবে বদ্ধমূল হবে এবং সে এমনভাবে মত্ত হয়ে যাবে যার ফলে কবিতা তাকে দীন থেকে গাফেল করে দেবে এবং সেই কবিতা তাকে আল্লাহর যিকর, নামায ও কুরআন তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখবে।
আর এক্ষেত্রে শুধু কবিতা নয় বরং যে জিনিসের ভূমিকা এরূপ হবে তাই-ই নিষিদ্ধ। যেমন- (গান-বাজনা) জুয়া খেলা ইত্যাদি। আর যেসব কবিতার ভূমিকা এ ধরনের নয় বরং তা সাহিত্য, কৌতূক ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয় তাতে কোনো দোষ নেই।