‘ইসলাম’ শব্দের সঠিক অর্থ

প্রাসঙ্গিক কথা হিসেবে সতর্ক করার জন্য বলতে হচ্ছে, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবী ইসলাম শব্দের অর্থ করেন ‘শান্তি’। আর কেউ বলেন, ‘ইসলাম অর্থ শান্তির ধর্ম, আর মুসলিম শান্তিপ্রিয়’। এরা জাতির সামনে এ ধরনের ভুল ও বিকৃত বক্তব্য উপস্থাপনের কারণ হচ্ছে, এদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে অথবা ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে এমন বলে।

অনেক মুসলমানও সঠিকটা না জানার কারণে ইসলাম অর্থ ‘শান্তি’ বলে থাকেন। অথচ যারা এমনটা বলেন, তারা কেন এ কথা বলতে পারেন না যে, ‘কেবল প্রকৃত ইসলামের ছায়াতলে এলেই শান্তি নিহিত।’

‘ইসলাম’ শব্দের সঠিক অর্থ ‘কারও কাছে নত হওয়া, মান্য করা, আত্মসমর্পণ করা’; আর মুসলিম মানে সব ক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণকারী। এ অর্থই অভিধান, তাফসীর, আকীদা ও ফাতাওয়ার কিতাবসমূহে লেখা হয়েছে।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্বন্ধে কুরআনে এসেছে, ‘যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, “আনুগত্যে নতশির হও”, তখন তিনি (সঙ্গে সঙ্গে) বললেন, আমি রাব্বুল আলামীনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। (সূরা বাকারা , আয়াত: ১৩১)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ লেখেন, ‘এখানে কুরআন মাজীদ ‘আনুগত্যে নতশির হওয়া’র জন্য ‘ইসলাম’ শব্দ ব্যবহার করেছে। ‘ইসলাম’- এর শাব্দিক অর্থ মাথা নত করা এবং কারও পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। আমাদের দ্বীনের নামও ইসলাম। এ নাম এ জন্যই রাখা হয়েছে যে, এর দাবি হলো, মানুষ তার প্রতিটি কথা ও কাজে আল্লাহ তাআলারই অনুগত হয়ে থাকবে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেহেতু শুরু থেকেই মুমিন ছিলেন, তাই এ স্থলে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য তাঁকে ঈমান আনার আদেশ দেওয়া ছিল না; বরং আল্লাহ তাআলার হুকুমের প্রতি আনুগত্য করা।

সুতরাং যে সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য করার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে না, সে প্রকৃত মুসলিম দাবি করতে পারে না! কাজেই আমরা যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিবাহ-শাদিতে, উৎসব-সংস্কৃতিতে, শিক্ষা ও রাজনীতিতে আল্লাহর হুকুমের পরোয়া করছি না, তারা কীভাবে নিজেদেরকে প্রকৃত মুসলিম দাবি করছি ! একটু ভেবে দেখার সুযোগ হবে কি?

ড. কবি ইকবাল রাহ. (মৃ. ১৯৩৮ ঈ.) বলেন, খ্রিষ্টান আর হিন্দু তুমি, চালচলনে বাইরে ঘরে তোমরা কি হে মুসলমান আর, ইহুদ যারে ঘৃণা করে।

বলতে পারো সৈয়দ তুমি, মির্যা তুমি, পাঠান তুমি কিন্তু কি হে বলতে পারো, খাঁটি মুসলমান যে তুমি?

আল্লাহ তাআলা তাঁর হুকুমের বিপরীতে কোনোভাবেই কোনোক্রমেই অন্য কারও অনুসরণ না করার আদেশ দিয়ে বলেন, “(হে মানুষ!) তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের তরফ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ করো। আর তাঁকে ছেড়ে অন্য (মনগড়া বা রাষ্ট্রীয়) অভিভাবকদের অনুসরণ কোরো না। (কিন্তু) তোমরা উপদেশ কমই গ্রহণ করো।’(সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৭২)

আরও বলেন, ‘(হে রাসূল!) আমি আপনাকে দ্বীনের এক বিশেষ বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং আপনি এর অনুসরণ করুন এবং যারা (দ্বীনের বিধানের) জ্ঞান রাখে না, তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না।’(সূরা জাসিয়া ,আয়াত: ১৮)

মুমিনদের কাছে এ সকল আয়াতের দাবি হচ্ছে, নিজেদের পুরো জীবনের প্রতিটি আচরণ-উচ্চারণে ও কথা-কর্মে তারা একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ ও নির্দেশনার অধীন থাকবে এবং জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহরই ফরমাবরদারী করবে ও তাঁরই হুকুমের সামনে আত্মসমর্পণ করবে।

সুতরাং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন, ব্যবসা- চাকুরি ও লেনদেন, অর্থনীতি ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন, উৎসব ও সংস্কৃতি, আইন ও বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা-সহ জীবনের সকল ক্ষেত্র ও সব অঙ্গন নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাতের মতো একমাত্র আল্লাহর নির্দেশনার অধীন থাকবে এবং তাঁরই অনুমোদিত পদ্ধতিতে পালন করতে হবে।

কিন্তু আফসোস! আজকালের অনেক মুসলমান তাওহীদের গুরুত্বপূর্ণ এ দাবি জানেই না। আর কিছু লোক নামাজ-রোযা ও হজ-ওমরার মতো কতিপয় বিষয় পালনের চেষ্টা করলেও অন্য বিষয়গুলোকেও আল্লাহর নির্দেশনার অধীন হিসেবে মানা বা পালনের আবশ্যকীয়তা স্বীকারই করে না। অথচ কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলো মানাও মুসলমানদের কাছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দাবি এবং এ ছাড়া তাদের ঈমান ও ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ।

কবি বলেন,যখন বলি, ‘আমি মুসলমান’ তো কেঁপে উঠি কারণ, আমি জানি ‘লা-ইলাহা’র জটিলতাটি।

সারকথা, এ সবগুলোই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এ সকল বিষয়ে যার যতটুকু কমতি থাকবে, বুঝতে হবে তার তাওহীদ ততটুকু অসম্পূর্ণ। আর যার মধ্যে এ বিষয়গুলো যে পরিমাণ পূর্ণতা পাবে, তার তাওহীদও সেই অনুপাতে পূর্ণাঙ্গ সাব্যস্ত হবে।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ঈমান – আকিদা

লেখকঃ মাওলানা সাঈদ আহমদ উস্তাদঃ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *