ইসলাম

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও দ্বীনের চার বুনিয়াদ সম্বন্ধে সম্বন্ধে আকীদা

এক হাদীছে বলা হয়েছেঃ অর্থাৎ, অতিশীঘ্রই আমার উম্মত তেহাত্তর ফিরকায় (দলে) বিভক্ত হয়ে পড়বে, তম্মধ্যে মাত্র একটি দল হবে মুক্তিপ্রাপ্ত (অর্থাৎ, জান্নাতী) আর বাকী সবগুলো ফিরকা হবে জাহান্নামী। জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কারা ? রাসূল (সাঃ) উত্তরে বললেনঃ তারা হল আমি ও আমার সাহাবীগণ যে মত ও পথের উপর আছি তার অনুসারীগণ।{সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৪১, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৭৬৫৯, আল মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং-৪৮৮৯, কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-১০৬০}

এ হাদীছের মধ্যে যে মুক্তিপ্রাপ্ত বা জান্নাতী দল সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদেরকেই বলা হয় “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত।” নামটির মধ্যে ‘সুন্নাত’ শব্দ দ্বারা রাসূল (সাঃ)-এর মত ও পথ এবং ‘জামা‘আত’ শব্দ দ্বারা বিশেষভাবে সাহাবায়ে কেরামের জামা’আত উদ্দেশ্য। মোটকথা রাসূল (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরামের মত ও পথের অনুসারীদেরকেই বলা হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। ইসলাম ধর্মে বিভিন্ন সময়ে যেসব সম্প্রদায় ও ফিরকার উদ্ভব হয়েছে, তন্মধ্যে সর্বযুগে এ দলটিই হল সত্যাশ্রয়ী দল। সর্বযুগে ইসলামের মৌলিক আকাইদ বিষয়ে হকপন্থী গরিষ্ঠ উলামায়ে কেরাম যেভাবে কুরআন, হাদীছ ও সাহাবায়ে কেরামের মত ও পথের অনুসরণ করে আসছে, এ দলটি তারই অনুসরণ করে আসছে। এর বাইরে যারা গিয়েছে, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত বহির্ভূত বিপথগামী ও বাতিলপন্থী সম্প্রদায়। এরূপ বহু বাতিল সম্প্রদায় কালের অতল গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, যারা রয়েছে তারাও বিলীন হবে, হকপন্থী দল চিরকাল টিকে থাকবে।

দ্বীনের চার বুনিয়াদ সম্বন্ধে আকীদা

দ্বীনের বুনিয়াদ অর্থাৎ, যে সমস্ত জিনিসের উপর শরী’আতের বুনিয়াদ, তা হল চারটি। এই চারটি দ্বারা যা প্রমাণিত নয়, তা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়। বুনিয়াদ চারটি এই ঃ

১. কুরআন।

২. হাদীছ/সুন্নাত। হাদীছ/সুন্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূল (সাঃ)-এর কথা কাজ ও সমর্থন। প্রথমটাকে সুন্নাতে কওলী, দ্বিতীয়টাকে সুন্নাতে ফে’লী এবং তৃতীয়টাকে সুন্নাতে তাকরিরী বলে।

রাসুল (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদার পবিত্র যুগের অনুসরণীয় আমলসমূহ হাদীছের এবং শরী‘আতের দলীল সমূহের অন্তর্ভুক্ত। তারাবীর বিশ রাকআত এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

কুরআন হাদীছের ভাষ্য সমূহ কে জাহেরী অর্থে গ্রহণ করতে হবে যতক্ষণ জাহেরী অর্থ থেকে ফিরে যাওয়ার মত কোন কারণ না পাওয়া যাবে। বিনা কারণে জাহেরী অর্থ পরিত্যাগ করে বাতেনী অর্থ গ্রহণ করা এলহাদ বা ধর্ম ত্যাগ ও ধর্মবিকৃতির নামান্তর।

৩. ইজ্‌মা। যেসব বিষয়ে নবী (সাঃ)-এর উম্মতের ইজ্‌মা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা হক এবং সঠিক। ইজ্‌মা দলীল হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ হল কুরআনের আয়াত : তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। (সূরাঃ ৩-আলু ইমরানঃ ১১০) অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে : কারও নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি এই রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং এই মু’মিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তাহলে সে যেদিকে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। (সূরাঃ ৪-নিছাঃ ১১৫)

এখানে বোঝানো হয়েছে – মুমিনগণ যে পথে চলে সেটা হক। এর ব্যতিক্রম চললে জাহান্নামের পথ সুগম হবে। এ বক্তব্য ইজ্‌মা দলীল হওয়াকে বোঝায়।

ইজ্‌মা দলীল হওয়ার ব্যাপারে হাদীছ থেকে প্রমাণ হল : বিভ্রান্তির উপর আমার উম্মতের ঐক্যমত্য হবে না

অন্য এক হাদীছে আছে : জামা’আতের উপর আল্লাহর সাহায্য রয়েছে। আর যে জামা’আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জাহান্নামে পতিত হবে।

৪. চতুর্থ বুনিয়াদ হল কিয়াস। অর্থাৎ, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের কিয়াস। তাদের কিয়াস মানার অর্থ তাদের তাকলীদ করা। তাকলীদের সারকথা হল কোন বুযুর্গ ও বিজ্ঞ আলেম ব্যক্তির হক্কানিয়্যাতের প্রতি আস্থা রেখে -যে, তিনি কুরআন ও হাদীছ মোতাবেক এ উক্তিটি করেছেন এবং সে মোতাবেক তিনি এ কাজটি করেছেন- তাঁর কথা ও কাজের অনুসরণ করা।

কিয়াস বলা হয় : আভিধানিকভাবে কিয়াস্-এর অর্থ হল পরিমাপ, অনুপাত ও তুলনা করা। যেমন একটা স্যাণ্ডেলকে আরেকটার সাথে পরিমাপ করে দেখলে বলা হয় সে এক স্যাণ্ডেলকে আরেকটার উপর কিয়াস করেছে। উসূলে ফেকাহ্-এর পরিভাষায় কিয়াস বলা হয় (কুরআন হাদীছে বর্ণিত) কোন মূল বিধান থেকে (কুরআন হাদীছে বর্ণিত হয়নি-এমন) কোন শাখা বিষয়ের হুকুম ও কারণকে পরিমাপ বা অনুমান করে নেয়া। অর্থাৎ, ঐ শাখা বিষয়ের হুকুম ও কারণ ঐ মূল বিধান থেকে বের করে নেয়া।

কিয়াসের বুনিয়াদ কখনো হয় কুরআনের উপর। যেমন কুরআনে উল্লেখিত শরাবের উপর বর্তমান গাঁজা, ভাং, আফিম ও হেরোইনকে কিয়াস করে এগুলোকে হারাম বলা।

কিয়াসের বুনিয়াদ কখনো হয় হাদীছের উপর। যেমন হাদীছে এসেছে গম, যব, খোরমা, লবণ এবং স্বর্ণ ও রূপা- এই ছয় প্রকার মালামালকে নগদে কমবেশ করা ব্যতীত বিক্রয় করতে হবে, বেশী গ্রহণ করা সূদ হবে। এর মধ্যে একই প্রকার এর একটাকে নগদ প্রদান ও অন্যটাকে বাকী রাখাও নিষেধ হবে। কারণ তাতে যে পক্ষ বাকী রাখল সে যেন বেশী গ্রহণ করল। এ হাদীছে উল্লেখিত ছয় প্রকার মালামালের হুকুমের সাথে ঐ সব মালামালের হুকুমও কিয়াস করা হবে যা এই ছয় প্রকারের বাইরে তবে একই প্রকার ভুক্ত।

কিয়াসের বুনিয়াদ কখনো হয় ইজমার উপর। যেমন উম্মতের সর্বসম্মত মত হল কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে সহবাস করলে তার মা ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যায়। এখন ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এর উপর কিয়াস করে বলেছেন কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে যেনা করলেও ঐ নারীর মা ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *