তাকলীদের প্রয়োজনীয়তা
যে কোন ধর্ম সম্পর্কে পূর্ণভাবে জানতে বা বুঝতে হলে সে ধর্মের মৌলিক গ্রন্থ পাঠের কোনো বিকল্প নেই। ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে হলে কুরআন ও হাদীস গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। আরও একটি সত্য কথা হলো, শরীয়তের পথে রাহনুমায়ী পেতে হলে অবশ্যই বিশুদ্ধ জ্ঞানের পূর্ণ অধিকারী কারো হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। দীনি বিষয়ে তার প্রতি আস্থা রেখে তার নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া হেদায়াত প্রাপ্তি সম্ভব হবে না।
যাই হোক, আমরা সেই সমর্পণ বা অনুসরণের আলোচনায় একটু পরে আসবো। প্রথমে আমরা জানবো দীনের মৌলিক জ্ঞান কী কী? এরপর জানতে হবে আমরা যার অনুসরণ (তাকলীদ) করবো, তাকে অনুসরণীয় হতে হলে কতটা শর্ত পূরণ করতে হবে।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) বলেন কুরআনে কারীম পাঁচটি জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত।
এক. ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরূহ ও হারাম সম্পৰ্কীয় বিধানাবলী জ্ঞান। চাই সে বিধান ইবাদত সংক্রান্ত হোক, চাই দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার, সংসার পরিচালনা কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক বিধান হোক। এ ইলমের দায়িত্বশীল হলেন ফকীহগণ।
দুই. ইয়াহুদী, খ্রীষ্টান, মুশরিক ও মুনাফিক এই চার স্তরের পথহারা জাতির বিরুদ্ধে বিতর্কের জ্ঞান। এ জ্ঞানে পারদর্শী হলেন আলিম, মুনাযির ও যুক্তিবাদী।
তিন. আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত সম্পর্কীয় জ্ঞান। যে জ্ঞান আল্লাহভুলা বান্দাদের হৃদয়ে আল্লাহর স্মরণ জাগিয়ে দেয়। যেমন, আসমান যমীনের অনুপম সৃষ্টিশীলতার কথা, বান্দার প্রতি তার করুণারাশির আলোচনা, আল্লাহর অপূর্ব গুণাবলীর বর্ণনা ইত্যাদি।
চার. আল্লাহ কর্তৃক যুগবিবর্তন সম্পৰ্কীয় জ্ঞান। যেমন, কখনো তিনি অভিশপ্ত জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। আবার কখনো নেককারদের অপার দানে ভূষিত করেছেন। এছাড়া রয়েছে বিশেষ বরকতময় কিংবা অশুভ দিন-রাত ইত্যাদি।
পাঁচ. মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কীয় জ্ঞান। যথা, হাশর-নশর, হিসাব-কিতাব, মীযান-পুলসিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি।
শেষোক্ত তিন প্রকার জ্ঞানের অধিকারী হলেন ওয়ায়েয ও বক্তাগণ। যাবতীয় আয়াত-হাদীস ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব তাদের।
কুরআনের প্রধান তাফসীর এবং উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা রাসূলে আরাবীর (সা.) হাদীস। ইরশাদ হচ্ছে, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ. “আপনার প্রতি আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে তা ব্যাখ্যা করে শোনান।
কুরআনের সঙ্গে হাদীসের এই ব্যাখ্যামূলক সম্পর্কের আলোকে হাদীসের মৌলিক জ্ঞানও পাঁচ প্রকার। কুরআন ও হাদীসের উল্লিখিত পাঁচ প্রকার জ্ঞানের মধ্যে ফিকহী বা বিধান সম্পর্কীয় জ্ঞান ছাড়া, অপর চার প্রকার জ্ঞান তুলনামূলক হালকা ও সহজ। আরবী ভাষা ও সাহিত্যে অভিজ্ঞ যে কোন মানুষ সহজেই এসব জ্ঞান অর্জন করতে পারে। কিন্তু ফিকহী জ্ঞান সে তুলনায় অনেক গভীর ও সূক্ষ্ম।
তাফসীরে আযীযীর বরাতে মাদারুল হক গ্রন্থকার লিখেছেন, ইলমে ফিক্হ অত্যন্ত কঠিন ও গভীর একটি জ্ঞান শাস্ত্র। ফিক্হর জ্ঞান অর্জনের জন্য কেবল আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য থাকাই যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য প্রয়োজন উচ্চমাপের চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি, মেধা ও বিচক্ষণতা, কুরআন ও হাদীসের অসামান্য বুৎপত্তি, নাসিখ-মানসূখ, মুহকাম, মুতাশাবিহ, উসূল শাস্ত্রীয় তত্ত্ব-জ্ঞান এবং এর সাথে আরো প্রয়োজন তাওয়া-পরহেযগারী আর সংযম ও পবিত্রতার মতো নৈতিক গুণাবলীর দীক্ষা। এই সব অতুলনীয় গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিকেই কুরআন কারীমে ‘যাকির ও মুনীব’ এবং হাদীস শরীফে ‘মুজতাহিদ’ বলা হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এখন তাকলীদের প্রথম কথায় চলে এসেছি। কুরআন সুন্নাহর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালিত করতে হলে আমাদের যে রাহনুমার অনুসরণ করে চলতে হবে, তিনি অবশ্যই হবেন একজন মুজতাহিদ। এজন্য তার মধ্যে ইজতিহাদের শর্তাবলী পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকতে হবে। মুহাক্কিক আলিমগণ ইজতিহাদের মানযিলে পৌঁছার শর্তগুলো বেশ বিস্তারিতভাবেই বর্ণনা করে দিয়েছেন। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, কুরআন-হাদীসে বর্ণিত শরীয়তের বিধানাবলীর সাথে সম্পৃক্ত সমস্ত জ্ঞান একজন মুজতাহিদের জানা থাকা আবশ্যক। এরই সাথে তাকে জানতে হবে ইজমা’র স্থানগুলো কোথায় এবং কিয়াসের শর্তসমূহ কী কী। আরো জানা থাকতে হবে গবেষণার প্রকৃতি-পদ্ধতি, আরবী ভাষা জ্ঞান, নাসিখ-মানসূখ। রাবীদের জীবন বৃত্তান্ত এবং সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীনের বর্ণনাগুলো জেনে ফিকহের অধ্যায়সমূহ সম্পর্কে একজন মুজতাহিদের পূর্ণ ওয়াকিফহাল হতে হবে। ইমাম বগভীও (রহ.) প্রায় একই শর্তের কথা পাঁচভাগে বিভক্ত করেছেন।
উলামায়ে কেরাম এক বাক্যে বলেছেন, অন্য কারো তাকলীদ করা মুজতাহিদের জন্য বৈধ হবে না। ইমাম গয্যালী (রহ.) বলেন, ‘কোন মুজতাহিদ অন্য কারো ইজতিহাদ অনুযায়ী আমল করবে- এ কথা আলিমদের কেউই সমর্থন করেননি।’ এছাড়া ‘মুসাল্লামুস সুব্রত’, ‘মুখতাসারুল উসূল’ প্রভৃতি গ্রন্থে একই কথা বলা হয়েছে। একজন মুজতাহিদের জন্য যেমন অন্য কারো (তাকলীদ) অনুসরণ বৈধ নয়, তদ্রুপ যে মুজতাহিদ নয়, তার জন্যও বৈধ নয় কোন মুজতাহিদের তাকলীদ না করে মন মতো আমল করা।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) লিখেন, ‘যে ব্যক্তির ইজতিহাদের যোগ্যতা নেই তার জন্য একজন মুজতাহিদের শরণাপন্ন হয়ে উপস্থাপিত সমস্যার সমাধান জানা ওয়াজিব।’
‘মাদারুল হক’ গ্রন্থকার আল্লামা শা’রানীর বরাত দিয়ে লিখেছেন “যে ব্যক্তি শরীয়ত সম্বন্ধে বাস্তব উপলব্ধির জগতে পৌঁছেনি তার জন্য কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব।
ইমাম গাজ্জালী (রহ.) লেখেন, “যে ব্যক্তি কোন মুজতাহিদের মাযহাব গ্রহণ করেছে প্রতিটি কাজে সে মাযহাবের অনুসরণ করা তার জন্য ওয়াজিব। আলিমগণ একমত যে, মাযহাবের বিপরীত আমল করা কোনক্রমেই জায়িয হবেনা। ৩
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) থেকে বর্ণিত, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের সুযোগ্য পুত্র বলেছেন, ‘আমার পিতার নিকট আমি জানতে চেয়েছিলাম, এক ব্যক্তির নিকট রাসূল (সা.)-এর হাদীস, সাহাবা (রাযি.)-এর বাণী এবং তাবেয়ীদের বক্তব্যের লিখিত ভাণ্ডার মজুদ রয়েছে। কিন্তু সে জানেনা কোন হাদীসটি দুর্বল বা পরিত্যাজ্য, কোনটির সনদ মজবুত এবং কোনটির মজবুত নয়। নিজের মতামত ও পছন্দের ওপর নির্ভর করে আমল করা বা ফাতওয়া দেয়া তার জন্য জায়িয হবে কি?
তিনি বললেন, আহলে ইলমের নিকট জিজ্ঞেস করা ব্যতীত নিজ পছন্দ মতো আমল করা জায়িয হবে না। সঠিক মতামত জানার পরই কেবল আমল করা যাবে, জায়িয হবে।’
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।