ইসলাম

তাকলীদের তাৎপর্য

আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ . “হে ঈমানদারগণ! আল্লহর আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর রাসূলের।সূরা নিসা ৫৯।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র হাদীসে ইরশাদ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكُتُم بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُولِهِ.

“হযরত আনাছ ইবনে মালিক (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের জন্য দু’টি বিষয় রেখে গেলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দু’টিকে যথাযথভাবে আঁকড়ে ধরবে ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না। এ দু’য়ের একটি হল আল্লাহর কিতাব, আর অপরটি তার রাসূলের সুন্নাত।মুয়াত্তা মালিক ৩৬৩, মিশকাত, কিতাবুল ই’তিসাম ৩১।

অনুরূপ আরও অসংখ্য আয়াত ও হাদীসের আলোকে এটাই প্রমাণ হয়। যে, মুসলমান হিসেবে সবাইকে কেবল আল্লাহ ও তদ্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই আনুগত্য করতে হবে। আর কেবল আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যই ইসলামের মূল লক্ষ্য। এমনকি স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যও এজন্য অপরিহার্য যে, তিনি তার জীবনের প্রতিটি কাজ ও কথার মাধ্যমে আল্লাহরই পক্ষ থেকে প্রদত্ত শরীয়তের বাস্তব নমুনা উপস্থাপন করেছেন।

তাই আমাদের সর্বত্র অকুণ্ঠচিত্তে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই আনুগত্য করতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য করবে অথবা আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যের সাথে সাথে তৃতীয় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে বাস্তব আনুগত্যের হকদার মনে করবে সে অবশ্যই ইসলামের গণ্ডি থেকে বহির্ভুত বলে গণ্য হবে।

শরীয়তের যাবতীয় আহকাম ও বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে কেবল কুরআন ও সুন্নাহর বিবরণই হল মুসলমানদের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণের কোন অবকাশ নেই। তবে এখানে একটি কথা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য যে, কুরআন-সুন্নাহে বর্ণিত আহকাম দু’ধরনের-

কুরআন-সুন্নাহের আহকাম দু’ধরনের

১. কিছু আহকাম এমন আছে যেগুলোর উদ্দেশ্য ও মর্ম এতই স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট যে, আলিম, গাইরে আলিম নির্বিশেষে সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিও এসব আহকাম বুঝতে সক্ষম হবে। এতে অস্পষ্টতা বা পরস্পর বাহ্যত বিরোধ কিছুই নেই । যেমন, কুরআনে কারীমের ইরশাদ- وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضاً. “তোমাদের কেউ যেন কারও গীবত বা পরনিন্দায় লিপ্ত না হয়।”সূরা হুজুরাত ১২।

অনুরূপভাবে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী- ارْحَمْ مَنْ فِي الْأَرْضِ يَرْحَمْكَ مَنْ فِي السَّمَاءِ. “দয়া কর পৃথিবীবাসীর উপর, তাহলে তোমাদের উপর দয়া করবেন যিনিআসমানে থাকেন।”আল মু’জামুল কাবীর ২/৩৫৬, ফায়ফুল কাদীর ২/৯৩১, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ৪/২৭৭, মুসনাদে তায়ালিসী ৪৪, ৩৩৫, ইমাম হাকিম বলেছেন হাদীসটির সনদ সহীহ।ইমাম যাহাবীও সহীহ বলে রায় দিয়েছেন।

উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসটি এতই স্বচ্ছ ও স্পষ্ট যে, যে কোন আরবী জানা ব্যক্তি অনায়াসে এর মর্ম অনুধাবন করতে পারবে।

২. পক্ষান্তরে অসংখ্য আহকাম এমনও রয়েছে যেগুলোর উদ্দেশ্য ও মর্ম অনুধাবন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত ও একাধিক অর্থবোধক উপস্থাপনা অথবা আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক বৈপরিত্যের কারণে জটিলতা হয়ে থাকে । যেমন, কুরআনে কারীমের ইরশাদ- وَالْمُطَلَّقَاتُ يتربصن بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قَرُوءٍ. “তালাকপ্রাপ্তা নারী তিন কুরু পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।”সূরা বাকারা ২২৮।

এ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ইদ্দতের সময়সীমা তিন কুরু বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আরবী ভাষায় কুরু শব্দটি হায়িয (মহিলাদের ঋতুস্রাব) এবং তুহর (দুই স্রাবের মধ্যবর্তী পবিত্রতার সময়) উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং প্রথম অর্থে ইদ্দতের সময়সীমা হবে তিন হায়িয। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় অর্থ ধরলে সে সময়সীমা দাঁড়াবে তিন তুহর। এমতাবস্থায় আমরা কোন অর্থে আমল করব?

অনুরূপভাবে হাদীসে পাকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ . “মুক্তাদীর জন্য ইমামের কিরা’আতই যথেষ্ট।”মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৩৫, ফায়যুল কাদীর ১১/৫৯৭৯।

এ হাদীস দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, ইমামের কিরা’আত পড়া অবস্থায় মুক্তাদীর কিরা’আত পড়ার প্রয়োজন নেই; বরং নীরব ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- لا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأُ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ .“সূরায়ে ফাতিহা যে পড়ে না তার নামায হবে না।”

এ হাদীসের আলোকে ইমাম মুক্তাদী উভয়ের জন্যই সূরায়ে ফাতিহা পড়া বাধ্যতামূলক বলে কেউ কেউ মনে করেন। হাদীসদ্বয়ের এ বাহ্যিক বিরোধ নিরসনকল্পে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা ও জটিলতা রয়েছে।

সম্মানিত পাঠকবর্গকে চিন্তা করতে হবে যে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে আহকাম ও বিধি-বিধান আহরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিলে এর সামাধানকল্পে আমরা কি করব? নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব? নাকি কুরআন-সুন্নাহর এসব বিষয়ে আমাদের প্রথিতযশা মহান পূর্বসূরীদের মতামত অবলম্বন করব?

ইনসাফের দৃষ্টিতে বলতে গেলে প্রথম পন্থাটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক। পক্ষান্তরে দ্বিতীয়টি হল বাস্তব সম্মত ও অত্যন্ত নিরাপদ। কেননা- ইলম, হিকমত, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, স্মৃতিশক্তি, ইনসাফ, ধার্মিকতা, তাকওয়া ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা ও নিঃস্বতা এতই প্রকট যে, প্রথম যুগের মহামনীষীগণের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করাও এক ধরনের বড় অজ্ঞতা বৈ কিছু. নয়। তদুপরি প্রথম তিন যুগের মুজতাহিদ আলিমগণ ছিলেন পবিত্র কুরআন অবতরণের সময় ও পরিবেশের নিকটতম প্রতিবেশী। এ উভয়বিদ নৈকট্যের সুবাদে কুরআন-সুন্নাহর উদ্দেশ্য ও মর্ম অনুধাবন করা ছিল তাদের জন্য সহজসাধ্য।

পক্ষান্তরে নবুওয়াতের স্বর্ণালীযুগ থেকে আমাদের যুগের দীর্ঘ ব্যবধানের কারণে কুরআন-সুন্নাহর পটভূমি, অবতরণের অবস্থা এবং সে যুগের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ভাবধারা ও বর্ণনাধারা সম্পর্কে নির্ভুল ও স্বচ্ছ ধারনা লাভ করা বর্তমানে অসম্ভব না হলেও নিঃসন্দেহে কষ্টসাধ্য এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদসংকুল।

এ সকল কারণে জটিল সমস্যাপূর্ণ ও সুক্ষ্ম মর্মের আহকামের ক্ষেত্রে নিজেদের ইলম ও প্রজ্ঞার উপর নির্ভর না করে খায়রুল কুরুন তথা শ্রেষ্ঠ প্রথম তিন যুগের মুজতাহিদ আলিমগণের উপস্থাপিত ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সে মুতাবিক আমল করাই হল নিরাপদ ও যুক্তিযুক্ত। আর এরই নাম তাকলীদ।

মোটকথা, কুরআন-সুন্নাহ থেকে আহকাম ও বিধি-বিধান আহরণের ক্ষেত্রে সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিলেই শুধু ইমাম ও মুজতাহিদের তাকলীদের প্রয়োজন। পক্ষান্তরে স্পষ্ট ও জটিলতামুক্ত আহকামের ক্ষেত্রে কেউই তাকলীদের প্রয়োজন মনে করে না।

সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল গণী নাবলূসী (রহ.) লিখেছেন-“সর্বসম্মত ও অবশ্যম্ভাবীরূপে দীন হিসেবে অবধারিত আহকাম ও মাসায়িলের ক্ষেত্রে ইমাম চতুষ্টয়ের কারও তাকলীদের প্রয়োজন নেই। যেমন- নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্ব ইত্যাদি ফরয হওয়া এবং যিনা, সমকামিতা, মদ্যপান, চুরি, হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদি হারাম হওয়া দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এসকল বিষয়ে কারও তাকলীদের প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে অস্পষ্ট বা জটিল কিংবা মতবিরোধপূর্ণ আহকাম ও মাসায়িলের ক্ষেত্রেই শুধু তাকলীদের প্রয়োজন।

ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রহ:) লিখেন “কোন নির্দিষ্ট মাযহাব মেনে চলার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে যা মোটেই অস্পষ্ট নয়। বিশেষত বর্তমান যুগে যখন কুরআন-হাদীস সরাসরি বুঝে অনুসরণ করার শক্তি সামর্থ হ্রাস পেয়েছে। আর মন-মানসিকতা কুপ্রবৃত্তিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রত্যেক মতামত সম্পন্ন ব্যক্তি তার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে ।

শাহ সাহেব (রহ.) আরো লিখেন- قطَعَ الْكَيَّالُ الهَرَاسِيُّ بِأَنَّهُ يَجِبُ عَلَى الْعَامِي أَنْ يَلْزَمَ مَذْهَباً مُعَيَّناً .

“গবেষণায় অক্ষম সাধারণ ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে একটি মাযহাব অবধারিত করা ওয়াজিব বলে আল্লামা কাইয়্যাল হারাসী (রহ.) স্থির সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন।

আল্লামা শা’রানী (রহ.) তার বিখ্যাত কিতাব ‘আল-মীযান’-এ লিখেন-“নিজে পথভ্রষ্ট না হওয়া ও অপরকে পথভ্রষ্ট না করার জন্য নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা জরুরী।

মুসলিম শরীফের সর্ব শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ নববী (রহ.) লিখেন, নির্দিষ্ট মাযহাব অপরিহার্য হওয়ার কারণ এই যে, একাধিক বা অনির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণের অনুমতি দেয়া হলে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষজন মাযহাবের সুবিধাজনক যে কোন একটি মাযহাব বেছে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে তা অনুসরণ করবে যা নেহায়েত গর্হিত কাজ। তাই নির্দিষ্ট মাযহাব মেনে চলা বর্তমানে অপরিহার্য।

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *