হাদীস শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি
ইমাম আবু হানীফা রহ. ফিক্হ শাস্ত্রে এবং মাসআলা ইসতিম্বাতের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অনুরূপ হাদীস শাস্ত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। যেমন তাঁর ব্যাপারে ইমাম আমাশের মন্তব্য, তুমি উভয় দিকই (ফিকহ-হাদীস) হাসিল করেছো ।
বস্তুত কোনো ব্যক্তি কুরআন ও হাদীসের গভীর জ্ঞান অর্জন করা ব্যতীত ফিকহের ইমাম হতে পারে না। কেননা, ফিক্হ শাস্ত্র কুরআন-হাদীস থেকেই উৎসারিত। সুতরাং ফিক্হ শাস্ত্রে অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী সর্বজন স্বীকৃত ব্যক্তি ইমাম আবু হাননীফা রহ. এর সম্পর্কে এ কথা ধারণা করা সঙ্গত নয় যে, তিনি হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল ছিলেন। বরং অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি হাদীস শাস্ত্রেও অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি চার হাজার শাইখ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বর্ণনা করেন, হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমার দৃষ্টিতে আর কেউ পড়েনি। সহীহ হাদীস সম্পর্কে তিনি আমাদের চেয়ে অধিক দুরদর্শী ছিলেন।
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. আরও বলেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. যখন দৃঢ়তার সাথে কোনো মতামত পেশ করতেন, তখন তাঁর এ মতের সপক্ষে হাদীস বা আসার সংগ্রহ করার জন্য কূফা শহরের সকল মাশায়িখের কাছে যেতাম, অনেক সময় এর সপক্ষে দুই-তিনটি হাদীস পেয়েও যেতাম।
অতঃপর সেগুলো ইমাম সাহেবের কাছে পেশ করলে তিনি এর মধ্যে অনেকগুলো সম্পর্কে এ কথা বলতেন যে, এই হাদীসটি সহীহ নয়। এটি মারূফ সূত্রে বর্ণিত।
আমি তাকে বলতাম, তবে এ সম্পর্কে আপনার কী জানা রয়েছে, অথচ এ হাদীসটি তো আপনার বক্তব্যের অনুকূল। জবাবে তিনি বলতেন, আমি কূফাবাসীদের ইলম সম্পর্কে ভালোভাবেই জানি।
এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, ইমাম সাহেব হাদীস শাস্ত্রে কী পরিমাণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ইমাম আবু ইউসুফ সারা শহর ঘুরে যা সংগ্রহ করতেন তার চেয়ে বেশি তার কাছে আগে থেকেইরয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রহ. কূফা শহরের ওলামাদের সংগৃহীত সকল ইলম সংগ্রহ করেছিলেন।
খতীবে বাগদাদী তাঁর সনদে বিশ্ব ইবনে মূসা রহ. [মৃত্যু ২৮৮হিজরী] থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমাদের শায়েখ ইমাম আবূ আব্দির রহমান আল মুকরী রহ. যখন ইমাম আবু হানীফার সূত্রে কোনো হাদীস বর্ণনা করতেন, তখন আমাদেরকে বলতেন ইলমে হাদীসের শাহেনশাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তিনি কূফা শহরের ওলামায়ে কিরামের ইলম অর্জন করেই যথেষ্ট করেননি; বরং তিনি কূফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা- -মদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শাইখ থেকে ইলম হাসিল করেন। আর মক্কা-মদীনা যেহেতু স্থানীয়, বহিরাগত সকল ওলামা, মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও ফকীহদের কেন্দ্রস্থল ছিলো, কাজেই এককথায় বলা যায়, মক্কা-মদীনা ছিলো ইমের মারকায। আর তার মতো অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্ন, কর্মঠ ও মুজতাহিদ ইমামের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর মক্কা-মাদীনার ইলম হাসিল করা নিঃসন্দেহে সাধারণ ব্যাপার নয়।
এছাড়া তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্জ পালন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
প্রত্যেক সফরেই তিনি মক্কা-মাদীনার স্থানীয় বহিরাগত ওলামা, মাশায়েখ ও মুহাদ্দিসীনের সাথে সাক্ষাত করতেন। আল্লামা মোল্লা আলী কারী রহ. মুহাম্মাদ ইবনি সামায়াহ এর বরাত দিয়ে বলেছেন, আবু হানীফা রহ. তার রচিত গ্রন্থগুলোতে সত্তর হাজারের ঊর্ধ্বে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর কিতাবুল আসার গ্রন্থটি চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে লিখেছেন।
ইয়াহইয়া ইবনি নাসুর বলেন, একদিন আমি কিতাবে ভরপুর ইমাম আবু হানীফা রহ. এর ঘরে প্রবেশ করি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদীসের কিতাব।
এগুলো থেকে সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করেছি, যেগুলো ফলপ্রদ। ইমাম আবু হানীফা রহ. এর শাগরিদগণ তার বর্ণিত হাদীসগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন কিতাব ও মুসনাদ সংকলন করেছেন, যার সংখ্যা দেশের উর্ধ্বে। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো,
১. ইমাম আবু ইউসুফ কৃত ‘কিতাবুল আসার।’
২. ইমাম মুহাম্মাদ কৃত ‘কিতাবুল আসার আল মারফুআহ’ ও ‘আল আসারুল মারফুআহ ওয়াল মাওকুফাহ।’ এই দুটি কিতাব মূলত ইমাম সাহেবেরই রচনা
৩. মুসনাদুল হাসান ইবনি যিয়াদ আল লু-লুঈ, মুসনাদে হাম্মাদ ইবনি আবু হানীফা ইত্যাদি । অনুরূপ আল ওয়াহাবী, আল হারিসী, আল বুখারী, ইবনুল মুযাফফার, মুহাম্মাদ ইবনি জাফর আল আদল, আবু নাঈম আল ইস্পাহানী, কাজী আবু বাকর মুহাম্মাদ ইবনি আব্দিল বাকী আল আনসারী, ইবনি আবীল আউআম আস-সাদী ও ইবনি খসরু আল বালাখীও ইমাম সাহেবের হাদীসসমূহের বিভিন্ন মুসনাদ রচনা করেছেন।
অতঃপর প্রধান বিচারপতি আবুল মুআইয়িদ মুহাম্মাদ ইবনি মাহমূদ আল খাওয়ারযিমী। (মৃত্যু : ৬৬৫ হিজরী)
উপরোক্ত মুসনাদগুলোর অধিকাংশকে একত্রিত করে ‘জামিউল মাসানীদ’ নামে ফিকহশাস্ত্রের অধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় মহা ‘মুসনাদ গ্রন্থ’ রচনা করেছেন। তার ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘আমি সিরিয়ার অনেকের মুখেই শুনেছি, যারা ইমাম আবু হানীফার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা মুসনাদে শাফিয়ী, মুআত্তা মালিক এর সাথে তুলনা করে ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলে, তিনি হাদীস সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং তাদের ধারনা, ইমাম আবু হানীফা রহ. এর কোনো মুসনাদ নেই এবং তিনি সামান্য কিছু ছাড়া হাদীস রিওয়ায়েত করেননি।
কাজেই আমি দীনের মর্যাদাবোধের লক্ষ্যে ১৫টি মুসনাদকে একত্রিত করার প্রয়াস করলাম, যা ইমাম আবু হানীফার নিকট হতে হাদীস শাস্ত্রের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কিরাম সংকলন করেছেন।
তথ্যসূত্র:
বই : ইমাম আযম আবু হানীফা রহ. এর ঈমানদীপ্ত গল্প
লেখক : মুফতি মাহফুজ মোসলেহ