সন্তানের হক সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ
মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, পুত্র-পৌত্রাদি জন্ম দিয়ে পৃথিবীতে মানব-বংশ বিস্তার করা। পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন, যৌন-ক্ষুধার নিবৃত্ত ও বংশ-বিস্তারের জন্য নারী এবং পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ বলেন : وَمِنْ أَيْتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لايت لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
“এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি ও স্বস্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।”-সূরা আর রূম : ২১
এখানে স্পষ্টতই মানব-সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়েরই অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। যার ফলে উভয়ের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নারী জাতিকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হতো। নারী জাতিকে তারা কখনো ন্যায্য মানবিক অধিকার ও মর্যাদা দিতো না। মেয়ে সন্তানের জন্ম ছিল সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। এ সময়কার আরব সমাজের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন : وَإِذَا بُشِرَ أَحَدُهُمْ بِالأنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًا وَهُوَ كَظِيمٌ : يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِرَبِهِ ، أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُوْنِ أَمْ يَدُهُ فِي التَّرَابِط
“তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখাবয়ব কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয় ৷ তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে (সে চিন্তা করে) হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে (কন্যা সন্তানকে) রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে ! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট !”-সূরা আন নাহল : ৫৮-৫৯
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে জাহিলী যুগের আরব সমাজের কথা বলা হয়েছে। তখন সেখানে কন্যা সন্তানের জন্মকে সবাই অগৌরবের ও অবাঞ্ছিত মনে করতো। অপমানে কন্যা সন্তানের জনকরা অনেক সময় নিজ সম্প্রদায় ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিত। অনেকে জন্মের পর কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করতো। আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় এর নিন্দা করেছেন এবং এ হীন মানসিকতা পরিত্যাগ করতে বলেছেন। শুধু তাই নয়, তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন :۹۸وَإِذَا الْمَوْهُ دَةُ سُئِلَتْ بِأَيِّ ذَنْبُ قُتِلَتْ 8 – التكوير
“জীবন্ত প্রোথিত মেয়েদেরকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে, কোন্ অপরাধে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল ?”-সূরা তাকবীর : ৮-৯
ইসলাম কন্যা ও পুত্র উভয়কে সমান দৃষ্টিতে দেখার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, উভয়কে সমান দৃষ্টিতে দেখার এবং সমান আদর-যত্ন করার জন্য পুরস্কারের সুসংবাদও দিয়েছে। এ সম্পর্কে মহানবী স. বলেন : “যে ব্যক্তির কোনো কন্যা সন্তান রয়েছে এবং তাকে জীবন্ত প্রোথিত করেনি এবং তাকে ঘৃণার চোখেও দেখেনি, তার উপর নিজের পুত্র সন্তানকে অগ্রাধিকারও দেয়নি, তাকে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে দাখিল করবেন।”-আবু দাউদ, কিতাবুল আদব
জাহিলিয়াতের যুগে আরবে কন্যা সন্তানগণ পিতামাতার সম্পত্তির কোনো অংশ পেত না। সমাজে তারা নানাভাবে নিগৃহীত হতো। স্বয়ং কন্যা- সন্তানদেরকে মীরাসের মাল মনে করে পুরুষরা তাদেরকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বণ্টন করে নিত। হিন্দুধর্মসহ পৃথিবীর বহু ধর্মে এখনো পর্যন্ত পিতা-মাতার সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের কোনো অংশ নেই। কিন্তু ইসলাম এ বৈষম্যমূলক অমানবিক বিধানের অবসান ঘটিয়েছে। আল্লাহ তা’আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ : يُوصِيكُمُ اللهُ فِي أَوْلادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ ، فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ ، وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ .
“আল্লাহ তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়েছেন : এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান, কিন্তু কেবল কন্যা দুইয়ের অধিক থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ।”-সূরা আন নিসা : ১১
উপরোক্ত আয়াতাংশে কন্যা সন্তানদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মীরাস বা বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশ দেয়া হয়েছে। যদিও পুত্র সন্তানের তুলনায় কন্যা সন্তানের অংশ অর্ধেক করা হয়েছে অত্যন্ত যুক্তি সঙ্গত কারণে। কারণ মেয়েদের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কম। পিতার সংসারে থাকাকালে কন্যা সন্তানের লালন-পালন, ভরণ-পোষণ ইত্যাদি সব দায়িত্ব পিতাই পালন করে থাকেন। এমন কি, বিয়ে-শাদী দেয়ার খরচাদি পিতাই বহন করেন অথবা পিতার অবর্তমানে ভাইয়েরা বোনের দায়-দায়িত্ব পালন করে। বিয়ের পর স্ত্রীর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পালন করে থাকে স্বামী, কিংবা পুত্র বড় হলে বা কর্মক্ষম হলে সেও মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। পিতার অবর্তমানে মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তো সম্পূর্ণ পুত্রের উপরেই বর্তায়।
এভাবে দেখা যায়, মেয়েদের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব এক রকম নেই বললেই চলে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে থাকলেও তা অত্যন্ত সামান্য। উপরন্তু মেয়েরা বিয়ের সময় যে দেনমোহর পায় তা একান্তভাবে তাদের নিজস্ব। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক অষ্টমাংশের মালিক হয়—এটাও ইসলামের বিধান ।
এভাবে দেখা যায়, মেয়েদের মীরাস প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলাম একান্ত ন্যায়ানুগ ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দুনিয়ার কোনো বিধানেই মেয়েদের প্রতি এমন ন্যায়ানুগ আচরণ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও দৃশ্যত বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে মেয়েদের অংশ ছেলেদের তুলনায় অর্ধেক, এ অযৌক্তিক অভিযোগ তুলে এক শ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষী লোক মেয়েদের প্রতি ইসলাম পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে বলে অপপ্রচার করে থাকে। তারা কোনো যুক্তির ধার ধারে না, ইসলাম সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, অধিকার ও মর্যাদাকে কত ভারসাম্যপূর্ণ, পরস্পর নির্ভরশীল ও সমমর্মিতাপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছে, তা তারা কখনো উপলব্ধি করার চেষ্টা করেনি। হয়ত তারা অজ্ঞ, নয়ত জ্ঞানপাপী, ইসলাম বিরোধিতাই তাদের মূল লক্ষ।
সন্তানের লালন-পালন, তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দান, তাদেরকে ভাল আচার-আচরণ শিক্ষা দেয়া, উন্নত নৈতিক-মানসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, সর্বোপরি, ভাল মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা, প্রত্যেক পিতা- মাতারই পরম এবং পবিত্র দায়িত্ব। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উদ্ধৃত হলো :
حَقُّ الوَلَدِ عَلَى الْوَالِدِ ثَلَاثَةُ أَشْيَاء أَنْ يُحْسِنَ إِسْمَهُ إِذَا وُلِدَ وَيُعَلَّمَهُ الْكِتَابَ إِذَا عَقَلَ وَيُزَوجَهُ إِذَا أَدْرَكَ – تنبيه الغافلين للشيخ السمرقندي،
“পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক হচ্ছে প্রধানত তিনটি : জন্মের পর তাদের জন্য উত্তম নাম রাখা, জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়লে তাদেরকে কুরআন শিক্ষা তথা ইসলাম শিক্ষা দেয়া, আর সে যখন পূর্ণ বয়স্ক হবে, তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করা । ”
হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর তার জন্য একটি ভাল নাম রাখা পিতা-মাতার প্রধান দায়িত্ব। ভাল নাম রাখার মাধ্যমেই সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের মহব্বত, সন্তানকে উত্তম মানুষ রূপে গড়ে তোলার সদিচ্ছা ব্যক্ত হয়ে থাকে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, সন্তানের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বাবা-মা-ই চরম উদাসীন। আজকাল ছেলেমেয়েদের এমন সব নাম রাখা হয় যার দ্বারা তার জাত-পরিচয়, ধর্ম বংশ সম্পর্কে কিছুই বুঝার উপায় নেই। অর্থহীন এমনকি খারাপ অর্থবিশিষ্ট নাম রেখে ছেলেমেয়েকে প্রথমেই অমানুষ হবার পথে ঠেলে দেয়া হয়। এর দ্বারা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের চরম ঔদাসীন্যেরই পরিচয় ফুটে ওঠে।
ভাল, অর্থপূর্ণ নাম রাখা সুন্নাত এবং বাবা-মায়ের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সর্বাধিক উত্তম নাম হলো আল্লাহর গুণবাচক নামের সাথে মিলিয়ে সুন্দর অর্থবাচক নাম। যেমন— আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান, আবদুর রহীম, আবদুল হাফিজ, আবদুল কাইয়ুম, আবদুল কাহ্হার প্রভৃতি । এরপর নবী-রাসূলদের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা। তারপর সাহাবায়ে কেরামের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা অথবা যে কোনো ভাল অর্থপূর্ণ নাম নির্বাচন করা। এতে আশা করা যায়, ভাল অর্থপূর্ণ নামের বদৌলতে সন্তানের মনে একটি ভাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে এবং সে ভাল মানুষ রূপে গড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা লাভ করবে ।
প্রথমত, মনে রাখা দরকার, নাম রাখার মধ্যে জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোনো হিন্দুর নাম শুনলে মনে হবে সে হিন্দু ৷ অনুরূপভাবে কোনো বৌদ্ধ, খৃস্টান বা অন্য কোনো ধর্মীয় লোকের নামের মধ্যেই তাদের পরিচয় সুস্পষ্ট। মুসলমানদের নামও এক সময় তাই ছিল । কিন্তু আজকাল মুসলমান ঘরের সন্তানের কারো কারো এমন সব নাম রাখা হচ্ছে যা থেকে সে মুসলমান কিনা তা বুঝতে অসুবিধা হয়। তাই সন্তানের নাম রাখার ব্যাপারে আমাদের সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই সন্তানের জন্য ভাল অর্থপূর্ণ নাম রাখা মাতা-পিতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত, সন্তানকে কুরআন শিখানো এবং ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া বাবা-মায়ের দ্বিতীয় প্রধান কর্তব্য বলে হাদীসটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। আল কুরআন কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য মহানবী স.-এর মাধ্যমে এ মহাগ্রন্থ প্রেরণ করা হয়েছে। এ গ্রন্থের আলোকে জীবন গঠন করলে মানুষ যথার্থই আশরাফুল মাখলুকাত বা সর্বোত্তম মানুষে পরিণত হতে পারে, মহানবী স.-এর যুগে বিশ্ববাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, কুরআন প্রেরণের একমাত্র উদ্দেশ্য এটাই। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের স্তরে উন্নীত করা। যাঁর উপর নাযিল হয়েছে, তিনি নিজে কুরআনের আলোকে নিজের জীবন গড়ে সমগ্র মানবজাতির মুকুটস্বরূপ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম মানুষে পরিণত হয়েছিলেন এবং জাহিলিয়াতের যুগের বর্বরতম, অসভ্য ও অধঃপতিত মানবগোষ্ঠীকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আগেই বলেছি, কুরআন কোনো সাধারণ গ্ৰন্থ নয় ; অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মত গুটিকতক ধর্মীয় বিধি-বিধানসর্বস্ব কোনো সাধারণ ধর্মীয় গ্রন্থও নয়।
এটা মানুষ তথা সমগ্ৰ বিশ্ব-জগতের স্রষ্টা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সমগ্র মানব জাতির জন্য অবতীর্ণ। এতে স্রষ্টার পরিচয়, সকল সৃষ্টির পরিচয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, জীবনের লক্ষ পরিণতি, কর্তব্য, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সমষ্টিগত জীবন, ব্যবহারিক জীবন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সংক্ষেপে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা এ গ্রন্থে প্রদান করা হয়েছে। অতএব, প্রত্যেক মানুষেরই কুরআন পড়া, কুরআন অনুযায়ী জীবন গঠন ও পরিচালনা করা একান্ত জরুরী।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কুরআন শুধু মুসলমানদের জন্য নাযিল হয়নি। বিশ্ব-প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য এগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে । তবে যেহেতু মুসলমানগণ আল্লাহর উপর, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর কিতাবের উপর ঈমান এনেছে, তাই কুরআন পড়া, বুঝা, কুরআন অনুযায়ী জীবন গঠন করা, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা এবং সকল মত, আদর্শ ও জীবন বিধানের উপর কুরআনকে অগ্রাধিকার প্রদান ও কুরআনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা মুসলমানদের দায়িত্ব ও অপরিহার্য কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুসলমানগণ আজ তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতি চরমভাবে উদাসীন। তাই কুরআন অনুযায়ী জীবন গঠন না করে, কুরআন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা না করে অনৈসলামী বা বাতিল আদর্শ অনুযায়ী জীবন গঠন, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ফলে তারা নামে মুসলমান হলেও বাস্তব জীবনাচারে সম্পূর্ণ ইসলামের বিপরীত আদর্শ অনুসরণ করছে । এর দ্বারা তাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ হতে বসেছে। তাই রাসূলের হাদীস অনুযায়ী সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেয়া, কুরআনের আলোকে সন্তানের জীবন গড়ে তোলা বাবা মায়ের পরম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর দ্বারাই সন্তানের জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্র পেতে পারে সুনাগরিক।
তৃতীয়ত, সন্তানের বিয়ের বয়স হওয়ার পর উপযুক্ত পাত্র বা পাত্রীর সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করাও বাবা-মায়ের কর্তব্য। বিয়ের দ্বারাই জীবনে পূর্ণতা আসে। যথাসময়ে সন্তানের বিয়ে না দিলে সন্তানদের পদস্খলনের সম্ভাবনা থাকে এবং বিয়ের মাধ্যমেই সন্তানের স্বাভাবিক জীবন যাপন, সুস্থ জীবন গঠন নিশ্চিত হয়। তাছাড়া বিয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এর উপর সন্তানের ভবিষ্যত জীবনের সুখ-শান্তি, ভাল-মন্দ, ব্যর্থতা- সফলতা নির্ভর করে। তাই ভাল পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের যথাযথ ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। অতএব হাদীসের এ অংশটিও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ।
উপরোক্ত হাদীসের দ্বারা বুঝা যায়, সন্তানের ভাল নাম রাখা, সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দান, ইসলামের আলোকে সন্তানের মন-মানস, চরিত্র, আমল-আখলাক পরিগঠন ও বয়সকালে বিয়ের ব্যবস্থা করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। এ হাদীস অনুযায়ী সন্তানের প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে সন্তানের জীবন যেমন সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে, পরিবার ও সমাজ তার দ্বারা উপকৃত হবে। কেননা সুনাগরিক সুস্থ, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের পূর্বশর্ত। অন্যদিকে এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে সন্তানের যেমন বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পরিবারেও অশান্তি-বিশৃংখলা দেখা দেয়, সমাজ ও রাষ্ট্রে তেমনি অশান্তি-অরাজকতা সৃষ্টি হয়। সন্তানের প্রতি বাবা-মা এ দায়িত্ব পালন না করলে দুনিয়ায় যেমন অশান্তি, আখেরাতেও তেমনি তাদেরকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। বর্তমানে আমরা প্রায় প্রত্যেক: পরিবারে যে অশান্তি লক্ষ করি তার মূল কারণ খোঁজ করলে দেখা যাবে, সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা না’ দেয়ার ফলে সে সন্তান উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ছে, বড় হয়ে বাবা-মার জীবনকেওৎ নানা অশান্তিতে ভরে দিচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও সে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
বই : মাতা-পিতা ও সন্তানের হক
অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রহমান