সন্তানের আকীকাহ করা
‘আকীকাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো : ভাঙ্গা, কেটে ফেলা। নবজাত শিশুর চুল কেটে ফেলাকেও ‘আকীকাহ’ বলা হয়। তাছাড়া ঐ জন্তুটিকেও ‘আকীকাহ’ বলা হয় যেটাকে সদ্যজাত শিশুর পক্ষ থেকে জবেহ করা হয়। প্রাচীন আরব সমাজে আকীকাহর রেওয়াজ ব্যাপকভাবে চালু ছিল। এর দ্বারা মবজাত শিশুর জন্মের সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার করা, নবজাত শিশুর প্রতি সকলের দোয়া বা কল্যাণ কামনা করা এবং সন্তানের বংশ-পরিচয় সকলের নিকট প্রকাশ করা ইত্যাদি পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হাসিল হতো। রাসূল স. এর মধ্যে কল্যাণমূলক বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে আল্লাহর নির্দেশে ‘আকীকাহ’ প্রথাকে বহাল রাখেন। তিনি নিজে ‘আকীকাহ’ করেছেন এবং অন্যদেরকেও ‘আকীকাহ’ প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। ‘আকীকাহ’ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ স.-এর কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো :
كُل غُلام مُرتَهَنَّ بِعَقِيقَتهِ تُنْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُمَاطُ عَنْهُ الْأَذَى – “প্রতিটি সদ্যজাত শিশু তার আকীকাহর নিকট বন্দী, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করে তার মাথা কামিয়ে ময়লা দূর করতে হয়।”
অন্য এক হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ : كُل غُلامِ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُسَمَّى عَنْهُ وَيُحْلَقُ رَأْسَهُ
“প্রত্যেক সদ্যজাত শিশু তার আকীকাহর কাছে বন্দী, তার জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করে তার নাম রাখা এবং মাথার চুল কর্তন করা বিধেয়।”
আকীকাহ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ স.-এর আরো কয়েকটি হাদীস : لا أحِبُّ الْعُقُوقَ وَمَنْ وَلَدَ لَهُ وَلَدُ فَأحِبُّ أَنْ يُنْسَكَ عَنْ وَلَدِهِ فَلْيَفْعَلْ – “আকীকাহ’ শব্দ ব্যবহার আমি পসন্দ করি না। তবে যার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সে যেন তার সন্তানের পক্ষ থেকে পশু জবেহ করে। আমি সেটাই পসন্দ করি।” ‘আকীকাহ’ শব্দটির অর্থ ছিন্ন করা, কর্তন করা বা কেটে ফেলা । এ কারণে রাসূলুল্লাহ স. ঐ বিশেষ শব্দটির ব্যবহার পসন্দ করেননি। ” এর দ্বারা ‘আকীকাহর মূল বিষয়টির গুরুত্ব খাটো করা হয়নি।
আরেকটি হাদীস : مَعَ الغُلَامِ عَقِيقَةٌ فَأَهْرِيقُوا عَنْهُ دَمًا وَآمِيْطُوا عَنْهُ الْأَذَى. بخاری، ابو داود، ترمذی وابن ماجة “প্রত্যেক সদ্যজাত শিশুর সাথেই আকীকাহর বিষয়টি জড়িত, অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করে রক্ত প্রবাহিত করো এবং তার মাথার চুল কেটে দাও।”-বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ
রাসূলুল্লাহ স. তাঁর নাতি হযরত হাসান রা. ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর পক্ষ থেকে আকীকাহ করে বললেন : يَا فَاطِمَةُ احْلِقِي رَأْسَهُ وَتَصَدَّقِي بِوَزْنِ شَعْرِهِ فِضَةً – “হে ফাতেমা, এর (হাসান) মাথার চুল কেটে ফেল এবং তার মাথার চুলের ওজন পরিমাণ রূপা সদকা করে দাও।”
হযরত ইমাম মালিক র.-এর বর্ণনা মতে ঃ اِنْ فَاطِمَةَ بِنْتَ رَسُولِ حَلَقَتْ شَعْرَ الْحَسَنِ وَالْحُسَيْنِ وَزَيْنَبَ وَأَمَّ كُلْتُوْمَ وَتَصَدَّقَت بِزَنَةِ ذَلِكَ فِضَّةٌ – “হযরত ফাতেমা, হাসান, হুসাইন, জয়নব ও উম্মে কুলসুমের মাথা মুণ্ডন করেছিলেন এবং তাদের চুলের ওজন পরিমাণ রূপা সদকা করে দিয়েছিলেন।”
রাসূলুল্লাহ স. সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে নবজাত শিশুর পক্ষ থেকে পশু জবেহ করে সন্তানের জন্য উত্তম নাম রাখা এবং তার মাথার চুল কেটে মাথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কথা বলেছেন। এটার নাম আকীকাহ।
আকীকাহর জন্তু জবেহ সম্পর্কে হাদীস শরীফে স্পষ্ট উল্লেখ আছে : عَنِ الْغُلَامِ شَاتَانِ مُكَافَاتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةُ – احمد، ابو داود، نسائی “পুরুষ সন্তানের জন্য দু’টি এবং মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল জবেহ করাই যথেষ্ট।”
আকীকাহ করার জন্য রাসূলুল্লাহ স. যেভাবে তাগিদ দিয়েছেন তা থেকে কোনো কোনো আলেম আকীকাহ করা ওয়াজিব মনে করেছেন। তবে অধিকাংশ ইমাম ও মুজতাহিদের মতে আকীকাহ করা সুন্নাত। হযরত ইমাম আবু হানিফা র. এর মতে নফল। তবে ওয়াজিব, সুন্নত বা নফল যাই হোক আকীকাহ একটি ভাল কাজ।
সন্তান জন্মের পর এটা করা বাবা-মায়ের কর্তব্য। এ উপলক্ষে নবজাতকের নাম রাখা, তাঁর মস্তক মুণ্ডন করা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং পশু যবেহ্ করে তার গোশত বিতরণ করা বা তা রান্না করে আত্মীয়-স্বজন, পরিবার, প্রতিবেশী, গরীব-মিসকীনদের দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে সন্তান জন্মের সুসংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার করা, সন্তানের জন্য দোয়া কামনা করা আল্লাহর শোকর আদায় করা একটি ইসলামী রীতি ।
এটা ইসলামী সংস্কৃতিরও একটি অংশ। সন্তানের প্রতি এটা পিতা-মাতার একটি দায়িত্ব ।