সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষাদান করা
সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রধান দায়িত্ব হলো তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষাদান করা ও সচ্চরিত্রবান করে গড়ে তোলা। এর দ্বারা দুনিয়াতে তারা যেমন মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচতে পারে, মান-সম্মান নিয়ে চলতে পারে, আখেরাতেও তেমনি শান্তি ও নাজাত পেতে পারে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : “হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।” -সূরা আত তাহরীম ঃ ৬
উপরোক্ত আয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে ও পরিবারের সকলকে বাঁচাতে হলে ইসলাম অনুযায়ী জীবন গঠন এবং সেভাবে আমল করতে হবে। এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রখ্যাতস মুফাস্সির ইবনে জারীর তাবারী বলেন : “আল্লাহর এ আদেশের প্রেক্ষিতে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমরা আমাদের সন্তানদের দীন ইসলাম ও সমস্ত কল্যাণময় জ্ঞান এবং সচ্চরিত্রবান হবার শিক্ষা দেব।”
হযরত আলী রা. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : “তোমরা নিজেরা শেখো ও পরিবারবর্গকে শেখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতিনীতি ও তাদেরকে সেভাবে আমল করতে শেখাও।” ছেলেমেয়েদেরকে সুশিক্ষিত করা, বিশেষত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদেরকে উন্নত চরিত্রে অধিষ্ঠিত করা পিতা-মাতার দায়িত্ব। একজন পিতা তার সন্তানকে কীভাবে নসীহত করবেন, কী কী উপদেশ ও শিক্ষা দান করবেন আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং সূরা লুকমানে তা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। একে একে এখানে তা উল্লেখ করা হলো।
প্রথম নসীহত ঃ
“হে পুত্র! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক অত্যন্ত বড় যুলুম।”-সূরা লুকমান : ১৩
দ্বিতীয় নসীহত :
“হে পুত্র! কোনো কিছু (পাপ পূর্ণ)) যদি সরিষার পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নীচে, আল্লাহ তাও হাযির করবেন । আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সকল কিছু সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।”
এখানে আল্লাহ তা’আলার পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, তিনি এত সূক্ষ্মদর্শী যে, বিশ্ব-জগতের সবকিছুই তাঁর নখদর্পণে। অতএব বান্দা কোনো কাজ প্রকাশ্যে করুক আর গোপনে করুক, ভাল করুক বা মন্দ করুক, সব খবরই তাঁর গোচরে রয়েছে এবং সকল কাজের পরিণতির ফল তিনি সকলকে দান করবেন। কেউ তাঁর নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। একথা বলে লুকমান তাঁর পুত্রকে শিরক না করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন । প্রত্যেক বাবা-মায়েরই উচিত এভাবে তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে সদুপদেশ দিয়ে তাদেরকে আল্লাহমুখী করে তোলা। অন্যথায় তাদের বিপথগামী হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এবং সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার জন্য আল্লাহ অ’আলা তাদেরকেও পাকড়াও করবেন।
তৃতীয় নসীহত ঃ
“হে পুত্ৰ, নামায কায়েম কর।” আল্লাহর উপর ঈমান আনার পর বান্দার উপর দ্বিতীয় যে কাজটি অবশ্য করণীয় তা হলো নামায কায়েম করা। ঈমানের ক্ষেত্রে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা বা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক না করা যেমন অপরিহার্য, আমলের ক্ষেত্রে নামায হলো তেমনি এক অপরিহার্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। নামায মানুষকে সকল খারাপ চিন্তা, কর্ম ও আচরণ থেকে দূরে রাখে, আল্লাহর স্মরণকে দৃঢ় করে এবং সকল ভাল কাজে সৎ চিন্তা ও উত্তম আচরণে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। তাই মাতা-পিতার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো ছেলেমেয়েদেরকে নামায শিখানো, নামায আদায়ে যথাযথভাবে তাদেরকে তাগিদ দেয়া।
এক হাদীস অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের সাত বছর বয়স হলেই তাদেরকে নামাযের তাগিদ দিতে হবে এবং দশ বছর হলে জোর-জবরদস্তি করে হলেও নামায পড়াতে হবে, প্রয়োজনে খানাপিনা বন্ধ করে দিতে হবে। তবু নামায পড়াতেই হবে। বাবা-মায়ের এটা দায়িত্ব। এখানে জবরদস্তি করা বা খানাপিনা বন্ধ করার কথা বলে মূলত বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে।
নিজের সন্তানকে স্নেহ-আদর যত্ন দিয়ে চেষ্টা করলে সাত বছরের মধ্যেই নামায-কালাম শিখানো এবং পড়ানো কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশেষত অল্প বয়সে শিশুদের মন থাকে কাদামাটির মতই নরম, তখন যেভাবে খুশী তাদেরকে শেখানো বা গড়ে তোলা যায়। হাদীসটি হলো এ রকম :
“তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামায পড়তে আদেশ করো যখন তারা সাত বছর বয়স পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং নামাযের জন্যেই তাদের মারধোর কর, শাসন কর যখন তারা হবে দশ বছর বয়স্ক। আর তখন তাদের জন্যে আলাদা আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করাও কর্তব্য।”
সূরা ত্ব-হা-তেও সন্তান-সন্ততিদেরকে নামায শিক্ষা দেয়া এবং যাতে তারা আল্লাহর অনুগত থেকে সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে সেভাবে গড়ে তোলার জন্য বাবা-মার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে : “এবং তোমার পরিবারবর্গ ও সন্তান-সন্ততিদের নামায পড়বার জন্যে আদেশ করো এবং তা রীতিমত আদায় করায় তাদের অভ্যস্ত করে তোল। (যেন তারা আল্লাহর ভয়, আনুগত্য, নতি ও বিনয় সহকারে আল্লাহর বন্দেগী করার কাজে জীবন যাপন করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পারে এবং কখনই তা থেকে বিচ্যুত হয়ে না পড়ে।” ) ১৩২ আয়াত
চতুর্থ নসীহত ঃ
এবং ভাল কাজে আদেশ আর অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখ । ”
পঞ্চম নসীহত ঃ
“যা কিছু দুঃখ-কষ্ট লাঞ্ছনা আসবে এ কাজ করতে গিয়ে তা সব উদারভাবে বরদাশত করো, কেননা এটা এমন কাজ, যা সম্পন্ন করা একান্তই জরুরী ও অপরিহার্য । ”
ষষ্ঠ নসীহত :
“লোকদের প্রতি অহংকার প্রদর্শন করো না, অহংকার করে ঘৃণা করে লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।”
সপ্তম নসীহত ঃ
“যমীনের উপর গর্ব-অহংকার স্ফীত হয়ে চলাফেরা করো না কেননা আল্লাহ যে কোনো অহংকারী ও গৌরবকারীকে মোটেই পসন্দ করেন না, তাতে সন্দেহ নেই । ”
অষ্টম নসীহত ঃ
“মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে মাঝামাঝি ধরনের চালচলন অবলম্বন করো । ”
নবম নসীহত ঃ
“তোমার কণ্ঠধ্বনি নিচু করো, সংযত ও নরম করো কেননা সবচেয়ে ঘৃণ্য হচ্ছে গর্দভের কর্কশ আওয়াজ। ” নসীহত আকারে হযরত লুকমান তার প্রিয় পুত্রকে যে নয়টি মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছেন তা যেমন মৌলিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক বাবা- মায়েরই এরূপ শিক্ষা তাদের সন্তানকে দান করা প্রয়োজন। উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি পেতে হলে এ ধরনের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
তাই আল্লাহ স্বয়ং হযরত লুকমানেরন মাধ্যমে সকল সন্তানের প্রতি এ বিশ্বজনীন শিক্ষা মানবজাতিকে দান করেছেন। অতএব প্রত্যেক পিতা-মাতাকেই সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেতন ও অতিশয় যত্নশীল হতে হবে।
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ স.-এর দুটি প্রসিদ্ধ হাদীস : ما نَحَل وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نَحْلِ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبِ حَسَن – “কোনো পিতা-মাতা সন্তানকে উত্তম আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা ভাল কোনো দাম দিতে পারে না।”
অন্য আরেকটি হাদীসের ভাষা এ রকম : أكْرَمُوا أَوْلادَكُمْ وَاَحْسَنُوا أَدَابَهُمْ .
“তোমাদের সন্তানদের সম্মান কর এবং তাদের ভাল স্বভাব চরিত্র শিক্ষা দাও।” এভাবে ছেলেমেয়েদেরকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এবং তাদেরকে উত্তম স্বভাব-চরিত্র বিশিষ্ট করে তোলা বাবা-মায়ের পবিত্র দায়িত্ব। আল্লাহ ও রাসূল স.-এর পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
অতএব এ দায়িত্ব যাতে যথাযথভাবে পালন করা যায় সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এর মধ্যে কিছু দায়িত্ব আছে যা ব্যক্তিগতভাবে পালন করা সম্ভব। আবার কিছু দায়িত্ব আছে যা পালনের জন্য সমষ্টিগত প্রচেষ্টা দরকার । যেমন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক পরিবেশ যদি অনুকূলে না হয় তাহলে শত ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের পক্ষে দায়িত্ব পালন সর্বদা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক পরিবেশ ইসলামানুগ করার জন্যও আমাদেরকে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হতে হবে ।
এটা সমষ্টিগত চেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব। এককভাবে কারো পক্ষে শিক্ষাব্যবস্থা বা সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার জন্য ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরিহার্য। অতএব, ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরযে আইন বা অবশ্য কর্তব্য। এটা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সকল মানুষের জন্যই কল্যাণকর। এ কল্যাণের কাজে অংশগ্রহণে অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করা মুসলমানের দায়িত্ব।
এভাবে সবদিক থেকে চেষ্টা অব্যাহত রাখার পরেও এ ব্যাপারে আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করতে হবে। কেননা সবকিছু দেয়ার একমাত্র মালিক তো তিনিই এ ব্যাপারে প্রার্থনার ভাষাও আল্লাহ শিখিয়েছেন । এরশাদ হয়েছে : وَالَّذِيْنَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنِ واجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
“এবং যারা প্রার্থনা করে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর যারা আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর হয়, আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শ স্বরূপ কর।”-সূরা আল ফুরকান : ৭৪
আল্লাহ তা’আলার শেখানো এ দোয়া কত তাৎপর্যপূর্ণ। ঘরের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি যদি এমন হয় যে, তাদের দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় অর্থাৎ তাদের আমল-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র, জ্ঞান ও শিক্ষা যদি সুন্দর হয় তাহলে সেটা দেখে বাবা-মায়ের চেয়ে অধিক পরিতৃপ্ত আর কেউ হতে পারে না । সে পরিবারের চেয়ে সুখী পরিবার আর কী হতে পারে! পক্ষান্তরে স্ত্রী- সন্তান-সন্তুতি যদি উপযুক্ত শিক্ষা ও আমল-আখলাক বিশিষ্ট না হয় তাহলে সে পরিবারে অশান্তি-দুর্ভোগ লেগেই থাকে। তাই বিয়ে করার সময় জ্ঞান- বুদ্ধি ও ভাল স্বভাব-চরিত্র বিশিষ্ট পাত্র বা পাত্রী দেখে বিয়ে করা উচিত । আবার সন্তান-সন্ততিদেরকে তেমনি উপযুক্তভাবে গড়ে তোলায় যত্নবান হওয়া উচিত। যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর নিকট তাদের জন্য সর্বদা দোয়া করাও কর্তব্য।