ইবাদত

তাকওয়ার মৌলিক বিষয়সমূহ

তাকওয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যা মানুষের ঈমান, আমল এবং নৈতিকতার মূল চালিকা শক্তি। এটি মূলত আল্লাহর ভয় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি গভীর মনোভাবকে বোঝায়। কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাকওয়ার মৌলিক বিষয়সমূহ নিম্নরূপঃ


১. ঈমান ও তাওহীদ

তাকওয়ার প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হলো ঈমান ও তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ)। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার করে না, সে-ই প্রকৃত মুত্তাকি।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ

“আল্লাহ মু’মিনদের অভিভাবক; তিনি তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন।” (সূরা আল-বাকারা: ২৫৭)

হাদিসে এসেছে: الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ

“ঈমানের ৭০-এর অধিক বা ৬০-এর অধিক শাখা রয়েছে, তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা।” (সহিহ বুখারি: ৯)


২. আল্লাহভীতি ও গুনাহ থেকে বাঁচা

তাকওয়ার মূল চেতনা হলো আল্লাহকে ভয় করা এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। মুত্তাকি ব্যক্তি সবসময় চিন্তা করে যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন এবং তিনি যেকোনো সময় তাকে হিসাবের সম্মুখীন করতে পারেন।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের (নেককারদের) কাছ থেকে (আমল) কবুল করেন।”(সূরা আল-মায়িদাহ: ২৭)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُمَا كُنْتَ

“তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহকে ভয় কর।” (তিরমিজি: ১৯৮৭)


৩. ফরজ ওয়াজিব পালন এবং হারাম থেকে দূরে থাকা

তাকওয়ার অন্যতম ভিত্তি হলো সকল ফরজ ওয়াজিব আমল যথাযথভাবে পালন করা এবং সকল নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। যারা আল্লাহর আদেশ পালন করে এবং নিষেধ এড়িয়ে চলে, তারাই প্রকৃত মুত্তাকি।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا

“রাসুল (সা.) তোমাদের যা দিয়েছেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।”(সূরা আল-হাশর: ৭)

হাদিসে এসেছে: إِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ

“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা কম হয়।” (সহিহ মুসলিম: ৭৮২)


৪. আত্মশুদ্ধি ও নফল ইবাদত

তাকওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আত্মশুদ্ধি করা এবং নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। মুত্তাকি ব্যক্তি নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করে।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا

“যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফল হয়েছে। আর যে একে কলুষিত করেছে, সে ব্যর্থ হয়েছে।” (সূরা আশ-শামস: ৯-১০)

হাদিসে এসেছে: المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ

“সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।” (সহিহ বুখারি: ১০)


৫. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা

তাকওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর দেওয়া সবকিছুতে কৃতজ্ঞ থাকা।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ

“ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়লে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর দিকেই ফিরে যাবো’।” (সূরা আল-বাকারা: ১৫৫-১৫৬)

হাদিসে এসেছে:

عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ لَهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ

“মু’মিনের ব্যাপার আশ্চর্যজনক! তার সবকিছুই কল্যাণকর। যদি সে আনন্দ লাভ করে, তাহলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কষ্টে পড়ে, তাহলে সে ধৈর্য ধারণ করে, যা তার জন্য কল্যাণকর।” (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)


৬. হালাল রিজিক অনুসন্ধান

তাকওয়ার অন্যতম শর্ত হলো হালাল রিজিক উপার্জন করা এবং হারাম থেকে বিরত থাকা।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا

“হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু খাও এবং সৎকর্ম করো।” (সূরা আল-মু’মিনুন: ৫১)

হাদিসে এসেছে: إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا

“নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি শুধু পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন।” (সহিহ মুসলিম: ১০১৫)


উপসংহার

তাকওয়া হলো এক বিস্তৃত জীবনদর্শন, যা মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ঈমান, আল্লাহভীতি, ফরজ পালন, হারাম পরিহার, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, আত্মশুদ্ধি ও হালাল জীবিকা অনুসন্ধান—এই সকল গুণাবলী অর্জন করাই একজন প্রকৃত মুত্তাকি হওয়ার মূল উপায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রকৃত মুত্তাকি বানানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *