ইসলাম

আগে জ্ঞান অর্জন নাকি ইবাদত?

জ্ঞান অর্জন আগে, নাকি ইবাদত?—ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ

ভূমিকা

ইসলামে জ্ঞান (ইলম) ও ইবাদত (আমল) উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রশ্ন আসে—কোনটি আগে? জ্ঞান অর্জন, নাকি ইবাদত?

একদিকে, ইসলামে ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ আল্লাহ তাআলা মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে, সঠিক জ্ঞান ছাড়া ইবাদত করলে তা শুদ্ধ হবে না, বরং ভুল পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করব—জ্ঞান ও ইবাদতের মধ্যে কী সম্পর্ক, কখন জ্ঞান আগে, আর কখন ইবাদত আগে।


প্রথম অধ্যায়: ইবাদতের গুরুত্ব ও তার উদ্দেশ্য

১. মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য—ইবাদত

আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন:

🔹 وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

**”আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।”📖(সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, মানুষের আসল কাজ হলো আল্লাহর ইবাদত করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ইবাদত কীভাবে করতে হবে? সঠিক নিয়ম না জানলে ইবাদত কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?

২. সঠিক জ্ঞান ছাড়া ইবাদত করলে বিপদ হতে পারে

অনেক মানুষ মনে করে, “যত বেশি ইবাদত করব, তত বেশি সওয়াব পাব।” কিন্তু যদি সেই ইবাদত শুদ্ধ না হয়, তাহলে তা কোনো মূল্য বহন করবে না।

🔹 হাদিস:

**”যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করবে যা এর অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”**📖 (সহিহ বুখারি: ২৬৯৭, সহিহ মুসলিম: ১৭১৮)

এখান থেকে বোঝা যায়, সঠিক জ্ঞান ছাড়া ইবাদত করলে তা বিদআতে পরিণত হতে পারে, যা ইসলাম সমর্থন করে না।

৩. ইবাদত শুধু নামাজ-রোজা নয়

অনেকেই ইবাদত বলতে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাতকে বোঝেন। তবে ইসলামে ইবাদতের পরিধি অনেক বিস্তৃত।

প্রত্যেক নেক কাজ—যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়—তবে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। যেমন:

  • পিতা-মাতার সেবা করা
  • মানুষের উপকার করা
  • হালাল রিজিক উপার্জন করা
  • ভালো ব্যবহার করা
  • এমনকি বৈধ উপায়ে ঘুমানোও ইবাদত হতে পারে

কিন্তু যদি কেউ ইবাদতের অর্থই না বোঝে, তাহলে কীভাবে সে ইবাদত করবে? তাই জ্ঞান ছাড়া ইবাদত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।


দ্বিতীয় অধ্যায়: কেন ইবাদতের আগে জ্ঞান অর্জন জরুরি?

১. ইলম ছাড়া আমল গ্রহণযোগ্য নয়

কুরআনের নির্দেশ:

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ

“তুমি জেনে রাখো যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আর নিজের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাও।” 📖 (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)

🔹 ইমাম বোখারি (রহ.) তাঁর সাহিহ গ্রন্থে একটি অধ্যায় রেখেছেন:

“বাব: العلم قبل القول والعمل”(অর্থাৎ, “বক্তব্য ও আমলের আগে জ্ঞান জরুরি”)

🔹 ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: “মানুষের জন্য প্রথমে জ্ঞান অর্জন করা জরুরি, তারপর ইবাদত।”

২. ভুল ইবাদতের ভয়াবহতা

🔹 হাদিস:

**”একজন জ্ঞানী আলেম একজন সাধারণ ইবাদতকারীর তুলনায় শয়তানের জন্য হাজারগুণ কঠিন প্রতিপক্ষ।”**📖 (তিরমিজি, হাদিস: ২৬৮১)

🔹 উদাহরণ:

  • কেউ যদি ভুলভাবে অজু করে, তবে তার নামাজ শুদ্ধ হবে না।
  • কেউ যদি হালাল-হারামের জ্ঞান না রাখে, তাহলে সে হয়তো হারাম জিনিস খেয়ে ফেলতে পারে।
  • কেউ যদি সঠিক নিয়ম না জেনে যাকাত দেয়, তাহলে হয়তো তার যাকাতই আদায় হবে না।

তৃতীয় অধ্যায়: কখন জ্ঞান আগে, আর কখন ইবাদত আগে?

কোন পরিস্থিতিতে জ্ঞান আগে?

১. যখন কেউ ইবাদতের মৌলিক নিয়ম জানে না:

যদি কেউ নামাজ, রোজা, হজ, বা যাকাতের সঠিক নিয়ম না জানে, তাহলে প্রথমে শিখতে হবে, তারপর আমল করতে হবে।

২. যখন দ্বীনের ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত হয়:

অনেকে বলে—

“ইসলামে শুধু ৮ রাকাত তারাবিহ আছে, ২০ রাকাত তারাবিহ নেই।”

“শুধু কুরআনই যথেষ্ট, হাদিসের দরকার নেই।”

এ ধরনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে।

৩. যখন কোনো নতুন সমস্যার সমাধান জানা দরকার:

আজকাল অনেক আধুনিক বিষয় এসেছে, যেমন—ব্যাংকের সুদ, ডিজিটাল লেনদেন, শেয়ার মার্কেট ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সঠিক ইসলামিক সমাধান জানা জরুরি।

কোন পরিস্থিতিতে ইবাদত আগে?

১. মৌলিক জ্ঞান অর্জনের পর ইবাদত করতে হবে:

শুধু শেখাই যথেষ্ট নয়, শেখার পর ইবাদত করাও জরুরি।

২. যখন কোনো ফরজ ইবাদতের সময় এসে যায়:

যেমন, ফজরের আজান হলে আগে নামাজ পড়তে হবে, পরে গবেষণা করা যাবে।

৩. যখন কেউ কেবল জ্ঞান অর্জনের অজুহাতে ইবাদত ছাড়তে চায়:

কিছু মানুষ শুধু ইলম চর্চার নামে ইবাদত করতে চায় না। অথচ ইসলাম বলে, ইলম ও আমল উভয়ই করতে হবে।


উপসংহার: জ্ঞান ও ইবাদতের ভারসাম্য

শুধু জ্ঞান থাকলে হবে না, ইবাদতও করতে হবে। আবার শুধু ইবাদত করলেও হবে না, সঠিক জ্ঞানও থাকতে হবে।

🔹 হাদিস:

**”যে ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথ ধরে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করেন।”**📖 (মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)

তাই, প্রথমে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে, এরপর সে অনুযায়ী ইবাদত করতে হবে। তবেই আমরা প্রকৃত মুসলিম হতে পারব।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে যথাযথভাবে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *