আখেরাত সম্বন্ধে ঈমান
মৌলিক যে সব বিষয়ে ঈমান আনতে হয়, তার মধ্যে একটি হল আখেরাত সম্বন্ধে ঈমান। এই জগতের যেমন শুরু আছে তেমনি এর একটা শেষও রয়েছে। মুত্যুর পর পু-নরায় সকলে জীবিত হবে। দুনিয়ায় কৃত সকল কর্মের জবাবদিহী করতে হবে এবং কর্মের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তি হবে। সকল আসমানী কিতাব পরকালে বিশ্বাসের ব্যাপারে একমত। পরকালে অবিশ্বাস করলে তার ঈমান থাকে না। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ, যারা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না, তাদের সাথে যুদ্ধ কর। (সূরাঃ ৯-তাওবাঃ আয়াত : ২৯)
প্রসঙ্গঃ পুনর্জন্মবাদ
হিন্দুগণ মুসলমানদের ন্যায় পরকালে বিশ্বাস করে না। তারা পুনর্জন্মবাদ এর প্রবক্তা। তারা বলে ঃ যারা ইহজগতে পূণ্য অর্জন করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করে, তারা তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী আবার অন্য কোন দেহে পুনরায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। যেমন বাহাদুর ব্যক্তি বাঘের দেহে, কাপুরুষ খরগোসের দেহে আবির্ভূত হয়। এভাবে প্রত্যেকে তার কৃতকর্ম অনুযায়ী তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার জন্য আবার অন্য কোন দেহে পৃথিবীতে আবির্ভূত হতে থাকে। এক সময় যখন সে পূণ্য অর্জন করে এবং আবিলতা থেকে মুক্তি পায় , তখন তার আত্মা স্বর্গলোকে আত্মিক সুখে মগ্ন হয়। এর বিপরীত যে দেহ শারীরিক আবিলতা তথা অজ্ঞতা ও অসৎ চরিত্র থেকে মুক্তি অর্জন করতে না পারে তার আত্মা পরকালে দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে। এটাকেই তারা পুনঃজন্মবাদ বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
কিন্তু পরজন্মে কে কোন্ অপরাধের কারণে কোন্ দেহে আবির্ভূত হল তা যখন জানতে পারল না, তখন সংশোধনের এই প্রক্রিয়া যুক্তিসংগত ও মনস্তাত্বিক নীতি সমৃদ্ধ নয়। কেননা মনস্তাত্বিক ভাবে কারও সংশোধন তখনই হয় যখন সে জানতে পারে তার অপরাধ কি ? সংশোধনের জন্য কাউকে প্রেরণ করা হল অথচ সে জানতেই পারলনা তার অপরাধ কি, এটা কোনক্রমেই যুক্তিসংগত নয়। তদুপরি মানুষকে যদি অপরাধের কারণে বাঘ ভল্লুক বা শিয়াল কুকুরের আকারে পুনরায় আবির্ভূত হতে হয়, তাহলে তার সংশোধন কিভাবে হবে? পুর্ব জন্মে তার যে অপরাধ হয়েছিল সেটা ছিল মনুষ্য সংক্রান্ত; এখন বন্য প্রাণী হয়ে তার পক্ষে মনুষ্য চরিত্রের ত্রুটি সংশোধন হবে কিভাবে ? এটা কোন যুক্তিতেই বোধগম্য নয় ।
পুনঃজন্মবাদের প্রবক্তা দার্শনিকদের কেউ কেউ পুনর্জন্মবাদের পক্ষে ঐ সব হাদীছ থেকে প্রমাণ পেশ করার প্রয়াস পেয়েছেন, যাতে বলা হয়েছে জাহান্নামীর দেহ ওহুদ পাহাড়ের মত বড় হবে, তাদের শরীরের চামড়া কয়েক গজ পুরু হবে ইত্যাদি । এমনিভাবে জান্নাতীদের দেহ ও হযরত আদম (আঃ)-এর দেহের মত ৬০ হাত দীর্ঘ হবে। তারা বলতে চায় দুনিয়াতে তাদের এই দেহ ছিল না, অথচ এই দেহে তাদের পৃথিবীর আত্মা প্রবিষ্ট হচ্ছে । এটাই হল এক আত্মার অন্য দেহে আবির্ভাব। এটাকেই তো পুনঃজন্মবাদ বলা হয় কিন্তু এই যুক্তি ভ্রান্ত। কারণ ঃ ১. পুনর্জন্মবাদ বলা হয় আত্মার এক দেহ থেকে অন্য দেহে আবির্ভাব। আর এখানে যে দেহে জাহান্নামী ও জান্নাতীদের আত্মার আবির্ভাব হচ্ছে, তা ভিন্ন কোন দেহ নয় বরং তারই দেহ, তবে সেটাকে বর্ধিত করে দেয়া হয়েছে। এই বর্ধিত দেহে তার দুনিয়ার আত্মা আবির্ভূত হচ্ছে। বর্ধিত দেহ আর ভিন্ন দেহের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারার কারণেই জান্নাতী ও জাহান্নামীদের বড় দেহে দুনিয়ার আত্মার আবির্ভাবে পুনর্জন্মবাদের ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে ।
২. তাছাড়া পুনঃজন্মবাদের সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে, আর জান্নাত বা জাহান্নামের দেহ পরকালীন জগতের বিষয়। পরকালীন জগতের বিষয় দিয়ে দুনিয়ার বিষয়ে দলীল দেয়া চলে না।
পুনর্জন্মবাদীরা আরও একটি হাদীছ দ্বারা দলীল দিয়ে থাকে; যাতে বলা হয়েছেঃ অর্থাৎ, মুমিনের আত্মা পাখীর আকৃতি ধারণ করে জান্নাতের বৃক্ষে বিচরণ করবে। এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণ দেয়া চলবে না। কেননা, এ হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে : তারপর পুনরুত্থানের সময় আল্লাহ তাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেবেন। বোঝা গেল অন্তবর্তীকালীন সময়ে যে পাখির মধ্যে সে ছিল সেটা তার দেহ নয় বরং তা হল একটা বাহনের মত।
আখেরাতে ঈমান রাখার মধ্যে যে যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত
আখেরাত বা পরকাল সম্বন্ধে বিশ্বাস করার অর্থ হল – মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে কবর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়, হাশর-নাশর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় জান্নাত জাহান্নাম ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়- যেগুলো সম্পর্কে ঈমান আনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার সব কিছুতেই বিশ্বাস করা। অতএব এ পর্যায়ে মোটামুটি ভাবে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখতে হবে ।
(এক) কবরের সওয়াল জওয়াব সত্যঃ
কবরে প্রত্যেক মানুষের সংক্ষেপে কিছু পরীক্ষা হবে। মুনকার ও নাকীর নামক দুজন ফেরেশতা কবরবাসীকে প্রশ্ন করবে তোমার রব কে ? তোমার দ্বীন কি ? তোমার রাসূল কে? সে নেককার হলে এ প্রশ্নাবলীর উত্তর সঠিক ভাবে দিতে সক্ষম হবে। তখন তার কবরের সাথে এবং জান্নাতের সাথে দুয়ার খুলে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়া হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে সুখে বসবাস করতে থাকবে। আর নেককার না হলে (অর্থাৎ, কাফের বা মুনাফিক হলে) প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরে সে বলবে অর্থাৎ, হায় হায় আমি জানি না! তখন জাহান্নাম ও তার কবরের মাঝে দুয়ার খুলে দেয়া হবে। এবং বিভিন্ন রকম শাস্তি তাকে দেয়া হবে।
কবরে মুনকার নাকীর নামক ফেরেশতাদ্বয়ের আগমন ও প্রশ্ন করা সম্পর্কে হাদীছে বলা হয়েছে : যখন মাইয়্যেতকে কবরস্থ করা হবে, তখন তার কাছে কাল রংয়ের নীল চক্ষু বিশিষ্ট দুজন ফেরেশতা আগমন করবে, যাদের একজনকে বলা হয় মুন্কার, অন্যজনকে বলা হয় নাকীর।
জমহুরের মতে এই সওয়াল জওয়াব মু’মিন গায়রে মু’মিন নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই হবে। তবে সহীহ মত অনুসারে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও শহীদগণকে তাঁদের উচ্চ মর্যাদার প্রেক্ষিতে কবরে প্রশ্ন করা হবে না। সহীহ মুসলিম ও নাসায়ী শরীফের হাদীছ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়।
দুনিয়ার মানুষ সওয়াল জওয়াব শুনতে পায়না বলে সেটাকে অস্বীকার করা যায়না । একজন ঘুমন্ত মানুষ বহু কিছু স্বপ্নে দেখে এবং শোনে, অথচ তার পার্শ্ববর্তী লোকটি তা কিছুই টের পায়না। রাসূল (সাঃ) হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর কথা শুনতেন এবং তাকে দেখতেন অথচ পাশে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম তা কিছুই শুনতে পেতেন না, দেখতে পেতেন না। কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে : মানুষ আল্লাহ্ জ্ঞানের কিছুই আয়ত্ব করতে পারে না, তিনি যতটুকু চান তা ছাড়া। (সূরাঃ ২-বাকারাঃ ২৫৫)
(দুই) কবরের আযাব সত্য :
কবর মূলতঃ শুধু নির্দিষ্ট গর্তকে বলা হয় না, কবর বলতে আসলে বুঝায় মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে হাশরের ময়দানে পুনর্জীবিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালীন জগতকে। এ জগতকে কবর জগত আলমে বরযখ বা বরযখের জগত বলা হয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে : তাদের পশ্চাতে রয়েছে বারযাখ তাদের পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। (সূরাঃ ২৩ মু’মিনুনঃ ১০০ )
মুর্দাকে কবরস্থ করার পর তার দেহে রূহ প্রত্যাবর্তন করে । জমহুর এবং অধিকাংশের মতে রূহের প্রত্যাবর্তন পূর্ণাঙ্গভাবে হয়না বরং দেহ বা দেহের অংশ বিশেষের উপর তার প্রভাব পড়ে।
মৃত্যুর পর মানুষের মরদেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন সে কবর জগতের অধিবাসী হয়ে যায় এবং বদকার হলে তার উপর আযাব চলতে থাকে। কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে : সকাল-সন্ধা তাদের কাছে আগুন পেশ হয়। আর কিয়ামতের দিন বলা হবে হে ফিরআউনী সম্প্রদায়! তোমরা কঠিন শাস্তিতে প্রবেশ কর। (সূরাঃ ৪০-মু’মিনঃ ৪৬)
কুরআনে কারীমে আরও ইরশাদ হয়েছে : তাদের পাপের কারণে তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়। অনন্তর তাদেরকে আগুনে প্রবেশ করানো হয়। (সূরাঃ ৭১-নূহঃ ২৫)
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদেরকে কবরে পরীক্ষায় ফেলানো হবে, অথবা তোমাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হবে। অন্য এক হাদীছে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন : তোমরা আল্লাহর কাছে কবরের আযাব থেকে পানাহ কামনা কর ৷
কবরের এ আযাব মূলতঃ হয় রূহের উপর এবং রূহের সাথে দেহও সে আযাব উপলব্ধি করে থাকে। তাই দেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন, জ্বলে পুড়ে ছাই বা পঁচে গলে মাটি হয়ে যাক না কেন, তার যে অংশ অবশিষ্ট থাকবে, সেটুকু আবার উপলব্ধি করবে। আর মৌলিক ভাবে আযাব যেহেতু রূহের উপর হবে, তাই কবরের আযাব হওয়ার জন্য এই দেহ অবশিষ্ট থাকাও অপরিহার্য নয়।
যিন্দা মুসলমানদের দুআ, দান-খয়রাত ও নামায তিলাওয়াত দ্বারা মুর্দা মুসলমানদের উপকার হয়। তবে কাফেরগণ কারও দুআ খয়রাত দ্বারা উপকৃত হয় না। এর দ্বারা তাদের শাস্তিও লাঘব বা লঘু হয় না। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ঃ তাদের থেকে আযাব লঘু করা হবে না। আর না তারা সাহায্যপাপ্ত হবে। (সূরাঃ ২-বাকারাঃ ৮৬)
(তিন) পুনরুত্থান ও হাশর ময়দানের অনুষ্ঠান সত্য :
কিয়ামতের সময় শিংগায় ফুঁক দেয়ার পর সবকিছু নেস্ত-নাবূদ হয়ে যাবে। কোন উলামায়ে কেরাম বলেনঃ একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব ব্যতীত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার আল্লাহর হুকুমে এক সময় শিংগায় ফুঁকঃ দেয়া হলে আদি অন্তের সব জিন ইনছান ও যাবতীয় প্রাণী পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে চান তারা ছাড়া সকলে বেহুশ হয়ে পড়বে। অতঃপর আবার ফুৎকার দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে। (সূরাঃ ৩৯-যুমারঃ ৬৮)
যুক্তিগতভাবেও পুনরুত্থান সম্ভব। কারণ পুনরুত্থান হল পুনর্বার সৃষ্টি। আর যে খোদা প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি পুনর্বার সৃষ্টি করতে আরও বেশী সক্ষম। যেমন কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে যখন তা পচে গলে যাবে? তুমি বলে দাও, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনি, যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত। (সূরাঃ ৩৬ -ইয়াসীনঃ ৭৮-৭৯)
অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে : তিনি ঐ সত্তা যিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন। অনন্তর আবার তাকে সৃষ্টি করবেন। পুনর্বার সৃষ্টি করা তার জন্য আরও সহজ। (সূরাঃ ৩০-রূমঃ ২৭) আরও বলা হয়েছেঃ যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনর্বার সৃষ্টি করব। (সূরাঃ ২১-আম্বিয়াঃ ১০৪)
কুরআন শরীফে উল্লেখিত সূরা বাকারায় বনী ইসরাঈলের একটি ঘটনায় গাভী যবেহ করতঃ তার এক অংশের ছোয়ায় মৃতের জীবিত হওয়া, হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে চারটি পাখি যবেহ করার পর পুনরায় তাদের জীবিত হওয়া, হযরত উযায়ের (আঃ)-এর মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হওয়া এবং আসহাবে কাহাফের পুনর্জীবিত হওয়ার ঘটনা প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম তার চাক্ষুস প্রমাণ দেখিয়েছেন।
পুনরুত্থান শারীরিক, না শারীরিক-আত্মিক উভয়ভাবে
পুনরুত্থান শারীরিক না শারীরিক-আত্মিক উভয়ভাবে সংঘটিত হবে, এ সম্বন্ধে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মুতাকাল্লিমীনের অধিকাংশের মতে পুনরুত্থান হবে শারীরিক ভাবে। তাদের মতে রূহ বা আত্মাও একটি সুক্ষ্ম দেহ বিশেষ যা শরীরের সর্বত্র মিশে আছে। যেমন গোলাবের পানি গোলাবের সর্বত্র মিশে থাকে। অতএব রূহ ও দেহ উভয়ের সমভিব্যাহারে পুনরুত্থান হল শারীরিক।
দলীল কুরআনে কারীমের আয়াত : অর্থাৎ, হে নফছে মুতমায়িন্না (প্রশান্ত আত্মা)! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে আস সন্তষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। (সূরাঃ ৮৯-আয়াত: ৩০)
এক শ্রেণীর দার্শনিক এই বলে শারীরিক পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে যে, পরকালে এরূপ আসমান যমীন থাকবে না তাই সেখানে এরূপ শরীর নিয়ে জীবন ধারণ সম্ভব নয়। এরূপ সন্দেহের জওয়াব দিয়ে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ অর্থাৎ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যাঁ নিশ্চয়ই তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। (সূরাঃ ৩৬-ইয়াসীনঃ ৮১)
পুনরুত্থান কোন্ দেহের উপর হবে?
পুনরুত্থান হবে শরীরের মৌলিক অংশের উপর ভিত্তি করে যা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে, খাদ্য-খাবার দ্বারা যার প্রবৃদ্ধি ঘটে কিংবা রোগ-ব্যধিতে যার হ্রাস ঘটে তার নয়। অতএব দেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন, কোন প্রাণীর পেটে চলে যাক, জ্বলে পুড়ে ছাই বা পঁচে গলে মাটি হয়ে যাক না কেন, তার যে অংশ অবশিষ্ট থাকবে সেটুকু আযাব উপলব্ধি করবে। আর মৌলিক ভাবে আযাব যেহেতু রূহের উপর হবে, তাই কবরের আযাব হওয়ার জন্য এই দেহ অবশিষ্ট থাকা অপরিহার্য নয়।
শরীরের মৌলিক অংশের উপর ভিত্তি করে পুনরুত্থান সংঘটিত হওয়ার নির্দেশনা পাওয়া যায় নিম্নোক্ত হাদীছ থেকে : অর্থাৎ, সকল বনী আদম ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে তার প্রথম অংশ ব্যতিক্রম; তার থেকে তার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার থেকেই তার পুনর্গঠন হবে।
(চার) আল্লাহ্ বিচার ও হিসাব নিকাশ সত্য :
পুনর্জীবিত হওয়ার পর সকলকে আল্লাহ তা’আলার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :অর্থাৎ, অনন্তর সেদিন তোমাদেরকে নেয়ামত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরাঃ ১০২ তাকাছুরঃ ৮) অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ, নিশ্চয়ই কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর-এগুলোর সবটা সম্বন্ধেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সূরাঃ ১৭-বানী ইসরাঈলঃ ৩৬)
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে : কিয়ামতের দিন পাঁচটা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হওয়ার (অর্থাৎ, হিসাব-নিকাশের) আগে কোন বনী আদমের পা নাড়ানোরও ক্ষমতা থাকবে না। তার জীবন কোথায় ব্যয় করেছিল, তার যৌবন কোথায় ক্ষয় করেছিল, সম্পদ কোথা থেকে আয় করেছিল এবং কোথায় ব্যয় করেছিল আর যা জেনেছিল তার কতটুকু আমল করেছিল।(তিরমিজি)
(পাঁচ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে সওয়াল করা সত্য :
কিয়ামতের দিন আল্লাহ মানুষকে সওয়াল করবেন এটা সত্য। হাদীছে এসেছে : অর্থাৎ, আল্লাহ মু’মিনকে কাছে আনবেন অতঃপর তার দিকে ঝুঁকে তার থেকে তার পাপের স্বীকৃতি নিবেন। তাকে জিজ্ঞাসা করবেন অমুক অমুক পাপ চেন কি? (অর্থাৎ, তুমি এগুলো করেছ কি ?) সে বলবে হ্যাঁ হে আমার প্রতিপালক। অবশেষে যখন তার থেকে তার পাপের স্বীকৃতি নেয়া হবে এবং সে মনে মনে ভাববে আমার ধ্বংসতো অনিবার্য। তখন আল্লাহ বলবেন : আমি দুনিয়ায় তোমার এ সব পাপ গোপন করে রেখেছিলাম, আজও আমি তা ক্ষমা করে দিব। অতঃপর তার নেক আমলনামা তার হাতে দেয়া হবে।
(ছয়) নেকী ও বদীর ওজন সত্যঃ
কিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশের জন্য মিযান বা দাড়িপাল্লা (মাপযন্ত্র) স্থাপন করা হবে এবং তার দ্বারা নেকী বদী ওজন করা হবে ও ভাল-মন্দ এবং সৎ-অসতের পরিমাপ করা হবে। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে : অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন আমি ইনসাফের দাড়িপাল্লা স্থাপন করব। (সূরাঃ ২১-আম্বিয়াঃ ৪৭)
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে ঃ অর্থাৎ, সেদিনকার ওজন সত্য। তখন যাদের নেকীর পাল্লা ভারী হবে, তারা সফলকাম। আর যাদের নেকীর পাল্লা হালকা হবে, তারা এমন লোক যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এভাবে যে, তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি অবিচার করত । (সূরাঃ ৭-আ’রাফঃ ৮-৯)
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিকট সহীহ মত হল- কিয়ামতের দিন আমলকে দেহে রূপান্তরিত করে সেই দেহ ওজন দেয়া হবে কিংবা কোন দেহে রেখে আমলকে ওজন দেয়া হবে। তখন নেককার লোকদের আমল সুন্দর এবং বদকার লোকদের আমল কুৎসিত আকার ধারণ করবে। আল্লামা যাবীদী বলেনঃ আমল ওজন হবে এই মতটিই সহীহ ।
দলীল নিম্নোক্ত হাদীছ সমূহ : ১, হযরত আবুদ্দরদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত – রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন উত্তম চরিত্রের চেয়ে ভারী কিছু ওজনের পাল্লায় রাখা হবে না। (আবু দাউদ , তিরমিজি)
২, হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদীছে হযরত জাবের (রাঃ) আছে : কিয়ামতের দিন ওজনের পাল্লা স্থাপন করা হবে। অতঃপর নেকী ও বদী ওজন দেয়া হবে। বদীর চেয়ে যার নেকী সরিষার দানা পরিমাণও বেশী হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যার নেকীর চেয়ে বদী সরিষার দানা পরিমাণও বেশী হবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ , তিরমিজি)
৩, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে আছে : অর্থাৎ, দেহহীন আমলগুলোকে দেহে রূপান্তরিত করে তা ওজন দেয়া হবে। (আবু দাউদ , তিরমিজি)
মু’তাযিলাগণ আমলের দেহ না থাকায় তার ওজন হওয়াকে অসম্ভব মনে করেছেন। এর জওয়াব অতিবাহিত হল যে, আল্লাহ তা’আলা আমলকে দেহে রূপান্তরিত করবেন। তদুপরি এই যুগে দেহহীন আলো, বাতাস, তাপ ইত্যাদির ওজন হওয়ার বাস্তবতা সামনে এসে যাওয়ায় মু’তাযিলাদের যুক্তি এ যুগে অচল বলে সাব্যস্ত হয়েছে।
(সাত) শাফাআত সত্যঃ
শাফা’আত মশহুর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। মু’তাযিলাগণ এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। কেননা তাদের ধারণায় পাপীকে ক্ষমা করা আল্লাহর পক্ষে সম্ভব নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিকট আল্লাহ তা’আলা কবীরা গোনাহ্ ক্ষমা করতে পারেন যদি সে গোনাহকে হালাল মনে করে করা না হয়। পক্ষান্তরে কোন সগীরা গোনাহ করার কারণেও তিনি বান্দাকে শাস্তি দিতে পারেন।
কুরআনে ইরশদা হয়েছে : আল্লাহর সাথে শরীক করাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। অন্য গোনাহ যাকে তিনি ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরাঃ ৪ নিছাঃ ১১৬) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, এ কি অদ্ভুত আমলনামা ছোট-বড় কোন কিছুকে বাদ দেয়না; বরং সবই হিসাব রেখেছে ! (সূরাঃ ১৮-কাঃ ৪৯)
পরকালে রাসূল (সাঃ), আলেম, হাফেয প্রমুখদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে । রাসূলে কারীম (সাঃ) অনেক প্রকারের শাফা’আত বা সুপারিশ করবেন। তন্মধ্যেঃ
১. হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য। হাশরের ময়দানে কষ্টে সমস্ত মাখলূক যখন পেরেশান হয়ে বড় বড় নবীদের কাছে আল্লাহর নিকট এই মর্মে সুপারিশ করার আবেদন করবে যেন আল্লাহ পাক বিচার কার্য শুরু করে হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে সকলকে মুক্তি দেন, তখন সকল নবী অপারগতা প্রকাশ করবেন। কারণ আল্লাহ তা’আলা সেদিন অত্যন্ত রাগান্বিত থাকবেন। অবশেষে রাসূল (সাঃ) সুপারিশ করবেন। এটাকে শাফা’আতে কুরা বা বড় সুপারিশ বলা হয়। এ ছাড়াও নবী (সাঃ) আরও বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করবেন। যেমন :
২. হিসাব ও সওয়াল সহজ করার জন্য।
৩. কোন কোন কাফেরের আযাব সহজ করার জন্য। যেমন রাসূলের চাচা আবূ তালেবের জন্য এরূপ সুপারিশ হবে।
৪. কোন কোন মু’মিনকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য।
৫. যে সব মু’মিন বদ আমল বেশী হওয়ার কারণে জাহান্নামের যোগ্য হয়েছে- এরূপ মু’মিনদের কতকের জাহান্নামে না পাঠানো বরং ক্ষমা করে দেয়ার জন্য।
৬. কোন কোন মু’মিনকে বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করানোর জন্য।
৭. আ’রাফ তথা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে অবস্থিত প্রাচীরে যারা অবস্থান করবে তাদের মুক্তির জন্য।
৮. বেহেশতে কতক মু’মিনের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য।
মু’তাযিলাগণ প্রথম ও শেষোক্ত প্রকার ব্যতীত অন্য সব প্রকার সুপারিশকে অস্বীকার করেন। কারণ তাদের ধারণায় পাপ করলে কেউ মু’মিন থাকে না আর মু’মিন না হলে তার ক্ষমা হতে পারবে না। অতএব তার জন্য সুপারিশ অর্থহীন।
(আট) আমল নামার প্রাপ্তি সত্য :
রাসূল (সাঃ)-এর সুফারিশের পর কিয়ামতের ময়দানে আমল নামা উড়িয়ে দেয়া হবে। প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে গিয়ে পড়বে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : আমি প্রত্যেক মানুষের কর্ম তার গ্রীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব (আমলনামা) যা সে উন্মুক্ত পাবে। (সূরাঃ ১৭ বানী ইসরাঈলঃ ১৩)
নেককারের আমলনামা তার ডান হাতে গিয়ে পৌঁছবে, আর বদকারের আমলনামা বাম হাতে গিয়ে পড়বে। কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে : তখন যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখ.. আর যাকে তার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, হায় আমাকে যদি আমার আমলনামা দেয়াই না হত! (সুরাঃ ৬৯-হাক্ক্কাঃ ১৯-২৯)
প্রত্যেকে তার জীবনের ভাল-মন্দ ক্ষুদ্র বৃহৎ যা কিছু করেছে সব তার আমলনামায় লিখিত অবস্থায় পাবে। ইরশাদ হয়েছে ঃ তারা বলবে হায় আমাদের দূর্ভোগ এ কি অদ্ভূত আমলনামা ছোট-বড় কোন কিছুকে বাদ দেয়না; বরং সবই হিসাব রেখেছে ! তারা তাদের যাবতীয় আমল উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না। (সূরাঃ ১৮-কাফ ৪৯)
প্রত্যেককে তার আমলনামা পড়তে দেয়া হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর। আজ তোমার হিসাব নেয়ার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ঠ। (সূরাঃ ১৭-বানী ইসরাঈল ১৪)
(নয়) হাউযে কাউছার সত্য :
কবর থেকে উঠার পর কিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেকে পিপাসার্ত থাকবে। তাদেরকে পানি পান করানোর জন্য প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ তা’আলা তাঁদের মর্তবা অনুযায়ী একটি একটি হাওয দান করবেন। এই হাউয থেকে তাঁরা তাদের উম্মতকে পানি পান করাবেন, যার ফলে পিপাসা আর তাদেরকে কষ্ট দিবে না। আমাদের নবী (সাঃ) কে যে হাউয দান করা হবে তার নাম হাউযে কাউছার। হাউযে কাউছার অন্যান্য সকল হাউয থেকে বড় হবে।
হাউযে কাউছার কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : আমি তোমাকে কাউছার দান করেছি। (সূরাঃ ১০৮-কাউছারঃ ১)
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে : আমার হাউয এক মাস সফর করা পরিমাণ বিস্তৃত। তার. কোণগুলো সমান । তার পানি দুধের চেয়ে সাদা। তার সুগন্ধি মেশকের চেয়ে উত্তম। তার পেয়ালা আকাশের নক্ষত্রের চেয়ে বেশী সংখ্যক। কেউ একবার তা থেকে পান করলে আর কখনও সে পিপাসার্ত হবে না।
(দশ) পুলসিরাত সত্য :
হাশরের ময়দানের চতুর্দিক জাহান্নাম দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে। এই জাহান্নামের উপর একটি পুল স্থাপন করা হবে, যা চুলের চেয়ে সরু এবং তলোয়ারের চেয়ে ধারালো হবে। এটাকে বলা হয় পুলসিরাত। সকলকেই এই পুল পার হতে হবে। যে খোদা পাখিকে হাওয়ায় উড়াতে সক্ষম, তিনি এমন পুলসিরাতের উপর দিয়ে মানুষকে চালাতেও সক্ষম।
এই পুরসিরাত হল দুনিয়ার সিরাতে মুসতাকীমের স্বরূপ। দুনিয়াতে যে যেভাবে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর চলেছে, সে সেভাবে পুরসিলাত পার হয়ে যাবে। কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ চোখের পলকে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেটে, আবার কেউ হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে। মোটকথা, যার যে পরিমাণ নেকী সে সেরকম গতিতে উক্ত পুল পার হবে। আর পাপীদেরকে জাহান্নামের আংটা জাহান্নামের মধ্যে টেনে ফেলে দিবে।
পুলসিরাত সম্পর্কে হাদীছে এসেছে : অনন্তর জাহান্নামের উপর পুল স্থাপন করা হবে। শাফা’আত সংঘটিত হবে। লোকেরা বলবে হে আল্লাহ! নিরাপত্তা দাও নিরাপত্তা দাও। রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল পুল কি? তিনি বললেন : পদস্খলন ঘটার এক পিচ্ছিল স্থান। তাতে থাকবে সাঁড়াশি ও আংটা। তখন মু’মিনরা কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ পাখির মত, কেউ দ্রুতগামী অশ্বের ন্যায় এবং কেউ সাধারণ সওয়ারীর গতিতে সে পুল পার হয়ে যাবে। তখন কেউ অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পাবে, আর কেউ জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।
রাসূল (সাঃ) এবং এই উম্মত সর্বপ্রথম এই পুল পার হবে। তারপর অন্যান্যরা পার হবে।হাদীছে ইরশাদ হয়েছে: অর্থাৎ, তখন আমি এবং আমার উম্মত সর্বপ্রথম পার হবো।
(এগার) আ’রাফ সত্য :
আ’রাফ সত্য। আ’রাফ বলা হয় জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে অবস্থিত প্রাচীরকে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে : তাদের উভয়ের (জান্নাতী ও জাহান্নামীদের) মাঝে থাকবে আঁড়। এবং আ’রাফে কিছু লোক অবস্থান করবে, যারা সকলকে তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবে। (সূরাঃ৭-আ’রাফঃ ৪৬)
এটা কোন স্থায়ী জায়গা নয়। যাদের নেকী বদী সমান হবে তাদেরকে সাময়িক এখানে অবস্থান করানো হবে। অবশেষে আল্লাহর মন্জুরী হলে তাদের পাপ ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দেবেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর, তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমরা দুঃখিতও হবে না। (সূরাঃ ৭-আ’রাফঃ ৪৯)
(বার) জান্নাত বা বেহেশ্ত সত্য :
আল্লাহ্ নেক বান্দাদের জন্য আল্লাহ এমন সব নেয়ামত তৈরী করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি, কারও অন্তরে তার পূর্ণ ধারণাও আসতে পারে না। এই সব মহা নেয়ামতের স্থান হল জান্নাত বা বেহেশ্ত। এর কিছুটা বিবরণ দিয়ে এক হাদীছে কুদছীতে বলা হয়েছে : অর্থাৎ, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ শ্রবণ করেনি, আর না কোন মানুষের হৃদয়ে তার কল্পনাও আসতে পারে। তোমরা (এর প্রমাণ স্বরূপ) নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করতে পার (যাতে বলা হয়েছে ) কেউই জানে না তাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর কী লুকায়িত রাখা হয়েছে।
এখানে (আমি প্রস্তুত রেখেছি) শব্দটি স্পষ্টতঃই দলীল যে, জান্নাতের নেয়ামতরাজি পূর্বাহ্নেই সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। মু’তাযিলাগণ বিচার দিবসের পূর্বে এর সৃষ্টিকে ফায়দাহীন মনে করে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। এর উত্তর হল পূর্বাহ্নেই সৃষ্টি হওয়া ফায়দাহীন-এটা ঠিক নয়। বর্তমানেও সেখানে হুর গেলমানদের অবস্থান রয়েছে। তদুপরি পূর্বাহ্নেই সৃষ্টি করার মধ্যে অন্য কোন হেকমতও নিহিত থাকতে পারে যা আমাদের বোধগম্য নয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ঃ তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না, বরং তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। (সূরাঃ ২১ আম্বিয়াঃ ২৩)
জান্নাত কোন কল্পিত বিষয় নয় বরং সৃষ্ট রূপে ও অস্তিত্বশীল হিসেবে তা বিদ্যমান আছে এবং অনন্তকাল বিদ্যমান থাকবে মু’মিনগণও অনন্তকাল সেখানে থাকবেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সর্বসম্মত মত হল জান্নাত জাহান্নাম এখনই সৃষ্টরূপে বিদ্যমান আছে । এমন নয় যে, পরবর্তীতে তা সৃষ্টি করা হবে। দলীল –
১. কুরআনে বলা হয়েছে : তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়; যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। (সূরাঃ ৩-আলু ইমরানঃ ১৩৩)
২. পূর্বে বর্ণিত যে হাদীছে জান্নাতের নেয়ামতরাজি প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে, তাও জান্নাত সৃষ্টরূপে বিদ্যমান থাকার দলীল।
জান্নাতের অবস্থান এখন কোথায় এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে তবে অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে জান্নাত আকাশসমূহের উপর। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ আর সে তাকে (জিব্রাঈলকে) দেখেছিল সিদরাতুল মুন্তাহা-র কাছে; যার নিকট জান্নাতুল মা’ওয়া অবস্থিত। (সূরাঃ ৫৩ নামঃ ১৩-১৫)
নবী করীম (সাঃ) জান্নাতুল ফিরদাউসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন : তার (জান্নাতের) ছাদ হল আল্লাহর আরশ।
১. এ ব্যাপারে ন্যাচারিয়া দলের মতবিরোধ রয়েছে। দেখুন “ন্যাচারিয়া দল” শিরোনাম ৷
২. এ ব্যাপারে ফিরাকায়ে জামিয়া-এর ভিন্ন মত রয়েছে। দেখুন ২৮৭ পৃঃ৷
জান্নাতবাসীদের কখনও মৃত্যু হবে না। জান্নাতবাসীগণ যা পেতে ইচ্ছা করবেন, তাই পাবেন। তাদের জন্য হুর গেলমান ও খাদেম থাকবে।
(তের) জাহান্নাম বা দোযখ সত্য :
পাপীদেরকে আল্লাহ আগুন ও আগুনের মধ্যে অবস্থিত সাপ, বিচ্ছু, শৃঙ্খল প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্তির উপরকণ দ্বারা আযাব দেয়ার জন্য যে স্থান প্রস্তুত করে রেখেছেন, তাকে বলা হয় জাহান্নাম বা দোযখ। দোযখ আল্লাহর সৃষ্ট রূপে বিদ্যমান রয়েছে। এবং অনন্তকাল বিদ্যমান থাকবে। কাফেররা অনন্তকাল তাতে অবস্থান করবে।
কবীরা গোনাহ কারীগণ তওবা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করলেও অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। এক সময় শাস্তি ভোগ করার মাধ্যমে পাপ মোচন হওয়ার পর কিংবা পাপ মোচন হওয়ার পূর্বেই নবীর সুপারিশ ক্রমে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
জাহান্নামের সাতটি স্তর বা দরজা থাকবে। একেক স্তরের শাস্তির ধরন হবে একেক রকম। অপরাধ অনুসারে যে যে স্তরের উপযোগী হবে তাকে সে স্তরে নিক্ষেপ করা হবে। স্তরগুলোর পৃথক পৃথক নাম রয়েছে। যথাঃ ১. জাহান্নাম ২. লায়া ৩. হুতামা ৪. সায়ীর ৫. সাকার ৬. জাহীম ৭. হাবিয়া
জাহান্নামের অবস্থান এখন কোথায় এ ব্যাপারে অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মত হল জাহান্নাম যমীনের নীচে অবস্থিত। তবে এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষ্য এবং পাওয়া যায়না বিধায় এর জ্ঞান আল্লাহর উপরই ন্যাস্ত করা শ্রেয়।
মুফতী শফী সাহেব (রহঃ) লিখেছেনঃ এ সম্পর্কে হাদীছে বলা হয়েছেঃ যমীনের সপ্তম স্তরের নীচে জাহান্নাম রয়েছে। কিভাবে রয়েছে তা আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। ইউরোপ থেকে একবার চেষ্টা করা হয়েছিল যে, মাটি খুড়ে সরাসরি প্রাচ্যের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত রাস্তা করা যায় কি-না। তারা চেষ্টা করে দেখল যমীন খুড়ে চার মাইল পর্যন্ত নীচে যাওয়া যায়, তার নীচে আর যাওয়া যায় না। তার নীচে আর তারা খুড়তে পারে না। তার নীচে এমন শক্ত পাথরের স্তর আসে, যা পৃথিবীর কোন শক্তিশালী মেশিন দিয়েও কাটা সম্ভব নয়। কয়েক জায়গায় এরকম খোড়ার চেষ্টা করে একই অবস্থা দেখা গেল । তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছে- এর ভিতরে মারাত্মক ধরনের কোন দাহ্য পদার্থ রয়েছে, যা একটা কঠিন পাথরের আবরণ দিয়ে ঘেরা। হতে পারে এখানেই আল্লাহ পাক জাহান্নামকে রেখেছেন। কিংবা যদি এটা নাও হয়, তবুও যেভাবেই হোক জাহান্নামকে দুনিয়ার সপ্তম স্তরের নীচে রাখা হয়েছে।
মে’রাজের ঘটনায় রাসূল (সাঃ) জাহান্নাম ও কবরের শাস্তিগুলো দেখেছিলেন আসমানে উঠার পূর্বে। কারণ কবর এবং জাহান্নামের শাস্তিগুলো হবে আসমানের নীচে। সপ্তম আসমানের নীচ পর্যন্ত সমগ্র এলাকা জাহান্নামে পরিণত হবে। এখনও জাহান্নাম আসমানের নীচে দুনিয়াতেই রয়েছে। দুনিয়ার কোন এক জায়গায় ক্ষুদ্র আকারে সংকুচিত অবস্থায় জাহান্নামকে রাখা হয়েছে। কিয়ামতের দিন এটাকে বিস্তৃত করে সপ্তম আসমানের নীচ পর্যন্ত পুরো স্থানকে জাহান্নামে পরিণত করে দেয়া হবে।
তবে জাহান্নাম এখন কোথায় আছে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দলীল পাওয়া যায়না বিধায় এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু না বলাই শ্রেয়।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬