ইসলাম

“আল্লাহ”-এর উপর ঈমান

বিশুদ্ধতম মতানুসারে “আল্লাহ” শব্দটি সৃষ্টিকর্তার ইস্মে যাত বা সত্তাবাচক নাম।অর্থাৎ, “আল্লাহ” ঐ চিরন্তন সত্তার নাম, যার অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী, যিনি সমন্ত গুণাবলীর অধিকারী।

“আল্লাহ্” তা’আলার উপর ঈমান বলতে আল্লাহা যাত বা সত্তা ও তাঁর সিফাত বা গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস করা এবং মেনে নেয়াকে বুঝায় :

(ক) আল্লাহর সত্তা (যাত) ও তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা ।

আল্লাহর অস্তিত্বের যুক্তিগত প্ৰমাণ :

আল্লাহর অস্তিত্বের যুক্তিগত প্রমাণ দিয়ে বলা হয় ঃ আমরা জানি যে, জগতের সবকিছু (আল্লাহর যাত ও সিফাত ব্যতীত আসমান যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যকার সবকিছু) অনিত্ব বা সৃষ্ট। আর সব অনিত্ব বা সৃষ্ট বস্তুর জন্য সৃষ্টিকর্তা আবশ্যক। অতএব জগতের জন্যেও একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যক।

আল্লাহর অস্তিত্বের দলীল সম্পর্কে মনীষীদের কয়েকটি উক্তি

কতিপয় যিন্দীক (নাস্তিক গোছের লোক) হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) কে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তোমরা আমাকে একটা বিষয় একটু ভাবতে দাও। কতিপয় লোক আমাকে এই মর্মে একটা সংবাদ দিল যে, একটা সমুদ্রে ব্যবসার মালামাল বোঝাই একটা নৌকা কোন মাঝি ছাড়াই আপনা আপনি চলছে, সমুদ্রের ঢেউ চিরে সন্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। কারও কোনরূপ পরিচালনা ছাড়াই ইচ্ছামত সেটি তার গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে।

একথা শুনে তারা ইমাম সাহেবকে বলল কোন বদ্ধ পাগল ছাড়া এমন কথা কেউ বলতে পারে না। তখন ইমামে আযম আবূ হানীফা (রহঃ) বললেন : তাহলে এই মহা উর্ধ্বজগত ও অধঃজগত এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী এই বিশাল সৃষ্টিরাজির কোন সৃষ্টিকর্তা থাকবে না তা কি করে হয়? তখন লোকগুলো লা-জওয়াব হয়ে যায়।

হযরত ইমাম শাফিই (রহঃ) কে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই দেখ তুত গাছের পাতা। প্রত্যেক পাতার স্বাদ ও গুণ অভিন্ন। কিন্তু এই তুত গাছের পাতা রেশম পোকা আহার করলে সে পাতা রেশম হয়ে বের হয়, মধু পোকায় আহার করলে তা মধু হয়ে বের হয়ে আসে, গরু-ছাগলে আহার করলে গোবর হয়ে বের হয় আর হরিণে আহার করলে মৃগনাভী কস্তুরী হয়ে বের হয়। অথচ বস্তু এক।তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই সুক্ষ্ম কারিগরি কার ? নিশ্চয়ই এর পেছনে একজন কারীগর রয়েছেন।তিনিই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) কে স্রষ্টার অস্তিত্বের দলীল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি একটি ক্ষুদ্র আকারের মসৃণ দূর্গ দেখতে পাই, যাতে আসা-যাওয়ার কোন পথ এমনকি কোন ছিদ্র পর্যন্ত ছিল না। তার উপরটা দেখতে রূপার ন্যায় শুভ্র আর ভিতরটা স্বর্ণের ন্যায়। তারপর এক সময় সে দূর্গটি বিদীর্ণ হয় এবং তার দেয়াল ফেটে ফুটফুটে একটি বাচ্চা বের হয়ে আসে। অর্থাৎ, ডিমের ভিতর থেকে বাচ্চা বের হয়ে আসে।

ইমাম আহমদ ইব্‌নে হাম্বল (রহঃ) বোঝাতে চেয়েছেন যে, এমন একটি দূর্গ সদৃশন ডিম থেকে বের হয়ে সে তার শত্রু মিত্রকে চিনতে সক্ষম হয়। তাই সে চিল কাকের উপদ্রবকালে মায়ের ডানায় আশ্রয় নেয়। যে বাচ্চা ডিমের ভিতর কোন দানাপানি দেখেনি, সে বের হয়ে এসেই নিজের খাদ্য চিনতে পারে। ডিমের ছিদ্রহীন বদ্ধ ঘরে এই বাচ্চাটিকে এতসব কে শিখালো ? যিনি শিখিয়েছে। তিনিই আল্লাহ, তিনিই সৃষ্টিকর্তা।

এক চরকাওয়ালী বুড়িকে জিজ্ঞেস করা হয়, জীবন তো শেষ হলো চরকা কেটে কেটে, স্রষ্টার পরিচয় পেয়েছো কি ? সে উত্তরে বলে, হ্যাঁ, এই চরকাই তো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যতক্ষণ ঘুরাই, কেবল ততক্ষণই ঘুরে। নয়তো স্থির হয়ে যায়। তাই বুঝতে বাকী নেই যে, এই ক্ষুদ্র চরকার জন্য যদি চালকের আবশ্যক হয়, তবে এই বিরাট বিশ্ব-ভূবনের জন্য কি চালকের দরকার নেই ?

আল্লাহর অস্তিত্বের দলীল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কয়েকটি উক্তি

ডঃ জন ক্লীভল্যান্ড কথর‍্যান বলেন, “বিশ্বের অন্যতম প্রধান পদার্থ বিজ্ঞানবিদ লর্ড কেলভীন নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছেন, “আপনি যদি খুব গভীরভাবে চিন্তা করেন,তাহলে বিজ্ঞান আপনাকে আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য করবে।” আমাকে অবশ্য স্বীকার করতে হচ্ছে যে, আমিও তার এই উক্তির সাথে সম্পূর্ণ একমত।

তিনি আরও বলেন, “রসায়ন শাস্ত্র এই তথ্য প্রকাশ করে যে, জড় পদার্থ ক্রমশঃ বিলুপ্ত হচ্ছে। কতক খূব ধীরে ধীরে আবার কিছু অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। কাজেই বলা চলে, জড় পদার্থের অস্তিত্ব শাশ্বত নয়।

অতএব, নিশ্চয়ই জড় পদার্থের একটা আরম্ভও রয়েছে। এখন কথা হচ্ছে এই জড়জগত যখন নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারেনি, তখন স্বীকার করতে হয় যে, সৃষ্টির এই কাজ নিশ্চয় অজড় কোন প্রতিনিধি দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে এবং এই প্রতিনিধি নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষার অধিকারী।

ডোনাল্ড হেনরী পোটার বলেন, “আমার বক্তব্য হল, যদি এই ধারাবাহিক সৃষ্টি সম্পর্কিত থিউরী সমর্থন করতে হয়, তাহলে আমি অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করব।” তিনি আরও বলেন, “প্রকৃতির উৎপত্তি সম্পর্কে যে কোন কিছুই বিবেচনা করা হোক না কেন, একজন বৈজ্ঞানিক হিসেবে সকল বিষয়ে সক্রিয় বিবেচনা করা হোক না কেন, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে সকল বিষয়ের প্রধান ভূমিকায় আল্লাহকে বসিয়ে আমি পরম সন্তুষ্টি লাভ করি। প্রতিটি ছবিতে (ক্ষেত্রে) আল্লাহ্ হচ্ছেন মূল চরিত্র। আর যে সব প্রশ্নের আজও জবাব দেয়া হয়নি, একমাত্র তিনিই তার জবাব।”

পল ক্ল্যারেন্স ইবার সোল্ড বলেন, “ইংরেজ দার্শনিক ও রাজনীতিক ফ্যান্সিস বেকন তিন শতাব্দীরও আগে বলেছিলেন, সামান্য দর্শন জ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকে নিয়ে যায় । আর গভীর দর্শন জ্ঞান তাকে ধর্মের পথে টেনে আনে।”

পল ক্ল্যারেন্স আরও বলেন, “মানব জাতির অভ্যূদয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষকে লক্ষ দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তার চাইতেও বেশী সংখ্যক চিন্তাশীল অনুসন্ধিৎ সুপ্রতিটি ব্যক্তিস্বতন্ত্র এইসব রহস্যময় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, কোন্ সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষা, কোন্অনন্ত শক্তিশালী মানুষ এই অন্তহীন মহাবিশ্বকে পরিচালনা করেন ? জীবন ও মানুষের অভিজ্ঞতার মূলে অথবা বাইরে কি আছে ?

আল্লাহ কোন অর্থেই শারীর নন। তাই শারীরিক উপলব্ধি দিয়ে তাঁকে বোঝানো মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এই সঙ্গে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক প্রমাণ বিদ্যমান। এবং তিনি যে বুদ্ধি, জ্ঞান ও শক্তিতে বর্ণনাতীত, তাঁর সৃষ্টি সে কথাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “মানুষ ও এই মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ শূন্যতা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়নি ৷ নিশ্চয় এসবের আরম্ভ আছে এবং তজ্জন্য একজন আরম্ভকর্তাও রয়েছেন”।

মারলিন বুকস ক্রীডার বলেন, “সাধারণ মানুষ হিসেবে এবং বিজ্ঞানের অধ্যয়ন ও গবেষণায় জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তি হিসেবে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার মনে আদৌ সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন। তবে তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। গবেষণাগারের নিয়ম মাফিক পারা যায় না তাঁকে কোন প্রকার বিশ্লেষণ বা পুংখানুপুং- খরূপে বিস্তার করে দেখা। তিনি হচ্ছেন অপ্রাকৃতিক, আত্মিক, প্রজ্ঞাবান, সৃজনশীল, সর্বশক্তির আধার।”

মারলিন বুকস ক্রীডার বলেন, “তাঁর (আল্লাহ্) অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যদিও আমরা সাধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি না, তবুও আমরা মানুষ ও প্রকৃতিতে তাঁর অস্তিত্বের অগণিত প্রমাণ ছড়িয়ে আছে, তা নিয়ে গবেষণা করতে পারি। আমার মনে হয়, ঐ সব প্রমাণ যেমন সুস্পষ্ট তেমনি বিশ্বাসজনক।”

জর্জ আর্ল ডেভিস বলেন, “একজন পদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে এই মহাবিশ্বের অ-িবশ্বাস্য জটিল কাঠামোর যৎকিঞ্চিৎ দেখার সুযোগ হয়েছে আমার, যার ক্ষুদ্রতম পরমাণুর অভ্যন্তরীণ প্রাণস্পন্দন বৃহত্তম নক্ষত্রের বিশাল কর্মতৎপরতার তুলনায় কোন অংশেই কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। যেখানে প্রতিটি আলোকরশ্মি, প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক বিক্রিয়া, প্রতিটি প্রাণীর প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য একই অপরিবর্তনীয় আইনাবলীর নির্দেশ মোতাবেক আত্মপ্রকাশ ও নিজস্ব পথে পরিচালিত হয়ে থাকে।”

তিনি আরও বলেন, (প্রতিপক্ষের ধারণা মতে) “যদি একটি মহাবিশ্ব নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বাধ্য হয়েই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, এই বিশ্বই খোদা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ্র অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। তবে এখানে এক অদ্ভুতরূপে আল্লাহকে কল্পনা করা হচ্ছে – আল্লাহ্র আধ্যাত্মিক ও জড় উভয়রূপে । আমি কিন্তু এমন এক আল্লাহ্র কথা চিন্তা করতে পছন্দ করি, যিনি নিজের সঙ্গে কোন সাদৃশ্য রেখে একটি জড় জগতকে সৃজন করেন নি। কিন্তু তাঁরই সৃষ্টি সেই বিশ্বের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে আছেন ।’

ডঃ অস্কার লিও ব্রউয়ার বলেন, “মহাবিশ্বের বিশাল আকার এবং নক্ষত্র-মণ্ডলী ও অগণন সংখ্যা ও কল্পনাতীত জড়পিণ্ডের ওজন সম্পর্কিত আমাদের আলোচনা ফিরে এসে এবং এই সকল নক্ষত্র গ্রহ পরিচালনাকারী আইনাবলীর বিধিতত্বের কথা চিন্তা করে যখন দেখি, আমাদের কমিউনিষ্ট বন্ধুরা যাদের নিয়ে গোটা মানব জাতির একটা বিরাট অংশ গড়ে উঠেছে, তারা “আল্লাহ্ যে আছেন”- এ চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন, তখন সত্যিই অদ্ভুত লাগে না কি ? অকমিউনিষ্ট বিশ্বেরও শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশ আল্লাহকে অবজ্ঞা করে প্রকারান্তরে আল্লাহ্র অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছেন দেখলে তাও তেমনি অদ্ভুত লাগে না কি ?”

তিনি আরও বলেন, “নাস্তিকতার অর্থ হচ্ছে দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ । বৈজ্ঞানিক হিসেবে আমি এর কোনটিই চাই না । থিউরী হিসেবে আমি নাস্তিকতাকে অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত বলে মনে করি ৷”

ডঃ ইরভিং উইলিয়াম নবলচ বলেন, “আমি আল্লাহতে বিশ্বাসী। যে জন্য বিশ্বাস করি তার কারণ হচ্ছে, আমি মনে করি না সর্বপ্রথম ইলেকট্রোন অথবা প্রথম প্রোটোন অথবা প্রথম পরমাণু বা প্রথম এনিমো-এসিড অথবা প্রথম প্রোটোপ্লাজম অথবা প্ৰথম বীজ অথবা সর্বপ্রথম মস্তিস্কটির জন্মের জন্য কেবল দৈব দায়ী। আমার কাছে এসব কিছুর মূলে আল্লাহর পবিত্র অস্তিত্বই একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “বিখ্যাত মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানবিদ অলিবার ওয়েনডেল এক সময় বলেছিলেন যে, “জ্ঞান যতই বাড়তে থাকে, বিজ্ঞান ততই ধর্মকে ভ্রুকুটি করা থেকে বিরত হয়। বিজ্ঞানকে উপযুক্ততার সাথে বুঝতে পারলে দেখা যাবে, সর্বশক্তিমানে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে বিজ্ঞানই অধিক থেকে অধিকতর সম্ভাবনাময় করে তোলে ।”

ডঃ মার্লিন গ্র্যান্ট স্মীথ বলেন, “আমার কথা হচ্ছে এ আল্লাহ্ কোন এক অনির্বচনীয়, চঞ্চলমতি স্বর্গীয় বা ইথারীয় সত্তা নয়। অনেক যুগে আর অনেক স্থানে অতি উৎসাহী সব মন থেকে উদ্ভুত কাল্পনিক সাজানো গল্পের চেয়ে অনেক সুসামঞ্জস্য সত্তা। অধিকন্তু এক আল্লাহ্ হচ্ছেন বাইবেলে বর্ণিত আল্লাহ্ যাঁকে সকল পয়গম্বর ও তাঁদের বাণীর প্রচারকগণ বিশ্বাস এবং বর্ণনা করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “মানুষের আবির্ভাবের পর থেকে সকল যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ অশিক্ষিত সরল অথবা জ্ঞানীআর বৈজ্ঞানিকগণ এ সাক্ষ্য দিয়ে এসেছেন যে, তারা যথার্থই তাদের অন্তরাত্মায় আল্লাহর উপস্থিতি উপলব্ধি করেছেন। আমরা তাদের সে সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে কি করব ? বর্জন করব ? অবজ্ঞা করব ?

অগণিত মানুষ যে “অবর্ণনীয় আনন্দ গৌরব” লাভ করেছেন, আমরা কি তাকে দৃষ্টির আড়াল করে চাপা দিয়ে রাখব ? শহীদ আর ধর্মপ্রাণ ও ধর্মের বাণী প্রচারের জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছে, তাঁদের যে ঈমান নিঃসঙ্গতার মধ্যে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে, অহরহ কষ্ট স্বীকার করিয়েছে, সকল নির্যাতন সহ্য করিয়েছে, মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করতে দিয়েছে, আমরা কি সে সম্পর্কে নির্লজ্জের মত উদাসীন থাকতে পারি ? পারি আপন মনে এ কথা বলতে সে সবই ভুল ? আমার কথা হচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ্ আছেন এবং যারা তাঁকে অধ্যবসায় সহকারে পাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি তাদের জন্য মহা পুরস্কার দাতা।” (হিব্রু ১১ : ৬)

জন এডল্‌ফ বুয়েলার বলেন, “আজকের দিনের বিজ্ঞানের বিশ্বাস – যে প্রাকৃতিক আইন আমাদের গ্রহকে পরিচালনা করে, মহাশূন্যের অন্যান্য গ্রহগুলিও সেই একই আইনানুসারে পরিচালিত। যে দিকে আমরা তাকাই, সর্বত্র আমাদের নজরে পড়ে সুকল্পিত পরিকল্পনা, ক্রম এবং সমন্বয়। তাই আমার মনে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, সর্বশ্রেষ্ঠ এক মনীষা এসব কিছুর পরিকল্পনা করেছেন, সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এ মহাবিশ্বকে এর নির্দিষ্ট গন্তব্য পথে পরিচালনা করেছেন।”

ডঃ আলবার্ট ম্যাকস উইনচেষ্টার বলেন, “অনেকের কাছেই বিজ্ঞান ও ধর্ম হচ্ছে দু’টি বিরুদ্ধ শক্তি। কেউ যদি একটিকে আঁকড়ে ধরে, এদের মতে তাহলে অন্যটিকে বর্জন করতে হয়। আজ আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে একথাই বলছি যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে অধ্যয়ন আর গবেষণার পর আল্লাহ্তে আমার বিশ্বাস শিথিল না হয়ে আরো জোরদার হয়েছে এবং পূর্বাপেক্ষা আরও মজবৃত বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি বৈজ্ঞানিক নয়া আবিস্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র মর্যাদা আর শক্তিমত্তা সম্পর্কে যে অন্তর্দৃষ্টি দান করে, তা আরো জোরদার হয়।”

ডোনাল্ড রবার্টকার বলেন, “আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার পক্ষে খোলা মন নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ অসম্ভব। এটা অপর পক্ষে অবৈজ্ঞানিক শোনাবে। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। তারপর আমি খাঁটি বিজ্ঞান সম্মত ধরনের কতিপয় মন্তব্য পেশ করব।

তিনি বলেন, ভূ-রসায়ন সম্পর্কিত গবেষণা ব্যাপক আকারে সমুদয় বস্তুর প্রতি নজর দিতে শিক্ষা দিয়ে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসের কোটি কোটি বছরের প্রতি একবার চিন্তা নিবদ্ধ করতে, যে মহাশূন্য মহাবিশ্বকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে, আরেক বার তার দিকে এবং সর্বশেষ বিশ্বব্যাপী আবর্তনের যে প্রক্রিয়া বিদ্যমান, তাকেও অবলোকন করতে শিক্ষা দেয়। সব কিছুর বিশালত্বই মানুষকে আল্লাহ্র মহত্বকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে, হৃদয়ঙ্গম করতে সাহায্য করে”।

ডঃ ক্লাড এম হ্যাথাওয়ে বলেন, “আল্লাহতে বিশ্বাস সম্পর্কিত আমার যুক্তিসঙ্গত কারণসমূহ সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে আমি বলতে চাই যে, আল্লাহ্তে আমার যে বিশ্বাস-তার অধিকাংশই জীবনের এ বয়সে, যাকে অভিজ্ঞতা বলে উল্লেখ করা যায়, তার উপর প্রতিষ্ঠিত।”

তিনি আরও বলেন, “পরিকল্পনার জন্যে একজন পরিকল্পকের প্রয়োজন। আল্লাহ্তে আমার বিশ্বাসের এ মৌলিক যুক্তিযুক্ত কারণটি আমার ইঞ্জিনিয়ারিং অভিজ্ঞতা দ্বারা অনেকখানি সমর্থিত হয়েছে। অতএব, এমনি অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের চারিদিকে দুনিয়ায় যে কল্পনাতীত পরিকল্পনা ছড়িয়ে আছে, তা দেখে এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অসীম মনীষার অধিকারী পরিকল্পকের কাজ ছাড়া অন্য কিছুর চিন্তাই আসতে পারে না । নিঃসন্দেহে এ একটি পুরানো যুক্তি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ এমন এক যুক্তি, যাকে আধুনিক বিজ্ঞান পূর্বাপেক্ষা আরও অধিকতর অখণ্ডনীয় করে তুলেছে।”

সিসিল বয়েস হ্যাম্যান বলেন, “বিজ্ঞান জগতের যেদিকেই আমি দৃষ্টি ফিরাইনা কেন, সর্বত্র পরিকল্পনা, আইন, ও শৃঙ্খলার – সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর সাক্ষ্য দেখতে পাই । সূর্যোকরোজ্জ্বল রাস্তা দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যান এবং সেই সঙ্গে ফুলের অত্যন্ত খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যগুলো একবার লক্ষ্য করুন, মন দিয়ে রবিন পাখীর মিষ্ট গান শুনুন (আর চিন্তা করুন) পতঙ্গকে আকর্ষণকারী ফুলের যে মধু তা কি আকস্মিকভাবে ফুলের মধ্যে পৌঁছেছে ? পতঙ্গ যে আগামী বছর আরও ফুল জন্মানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল তা কি আকস্মিকভাবে হলো ? অতি ক্ষুদ্র পুষ্পরেণু ফুলের গর্ভকোষের মধ্যে ক্রমশঃ অঙ্কুরিত হয়ে যে বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করে,এটাও কি মামুলি দৈব ব্যাপার বলে উল্লেখ করা চলে ?”

তিনি আরও বলেন, “একবার নক্ষত্র খচিত আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালে সেখানকার সুশৃঙ্খল দৃশ্য দেখে আমাদেরকে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। রাতের পর রাত, ঋতুর পর ঋতু, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মহাশূন্যের সকল জগত আকাশ পথে নিজ নিজ কক্ষে এগিয়ে চলেছে। তারা নিজ কক্ষ পথে নির্দিষ্ট স্থানে এমন নির্ভুলভাবে ফিরে আসে যে, বহু শতাব্দী আগেও সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারতো। এরপরেও কি এমন কোন ব্যক্তি থাকতে পারেন, যিনি এগুলিকে দৈবক্রমে একত্রীভূত জ্যোতিষ্ক জাতীয় পদার্থ বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, উদ্দেশ্যহীনভাবেই এগুলি আকাশ মার্গে বিচরণ করছে ?

নিউটন বলেন, “বিশ্বের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর দিয়ে স্থান ও কালের হাজার হাজার বিপ্লব অতিক্রম করেছে। তা সত্ত্বেও তাতে যে শৃঙ্খলা ও সুনিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়, তা একজন নিয়ন্ত্রক ছাড়া সম্ভব নয়। এ নিয়ন্ত্রকই হলেন সর্বাদি সত্তা, জ্ঞানবান ও শক্তিমান মহান আল্লাহ।”

দার্শনিক হার্বাট স্পেন্সার বলেন, “এ রহস্যগুলো নিয়ে যতই চিন্তা ভাবনা করি ততই সূক্ষ্ম বলে মনে হয় । এতে নিশ্চিত বুঝা যায় যে, মানুষের উপর এমন একটি চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী ক্ষমতা রয়েছে, যেখান থেকে হয়েছে সকল বস্তুর উৎপত্তি।”

ক্যামিল প্রামারিয়ন বলেন, “কোন শিক্ষাগুরুই এটা বুঝতে পারছেন না যে,বিশ্বের অস্তিত্ব কি করে হল এবং কিভাবে তা অটুট রয়েছে ? বাধ্য হয়ে তাঁরা এমন একজন স্রষ্টা স্বীকার করে নিলেন, যিনি সদা বিরাজমান ও সক্রিয়।”

অধ্যাপক লিনি বলেন, “শক্তিমান ও বুদ্ধিমান আল্লাহ নিজ অদ্ভুত কারিগরির মহিমা নিয়ে আমার সামনে এভাবে উদ্ভাসিত হল যে, আমার চোখ দুটি তার প্রতি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এবং আমি পুরোপুরি তন্ময় হয়ে পড়ি। প্রত্যেকটি বস্তুতেই, তা যতই ছোট হোক না কেন, তাঁর অদ্ভুত শক্তি, আশ্চর্য কৌশল ও বিচিত্র অনবদ্যতা পরিলক্ষিত হয়। ,

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *